কুমিল্লার মেয়ে তিনি। বহুমুখী প্রতিভা। একসঙ্গে ছয়-ছয়টি খেলায় পারদর্শী। কথা বলার সময় মুখে সারাক্ষণই হাসি লেগেই থাকে! পল্টনের শহীদ (ক্যাপ্টেন) এম মনসুর আলী জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কুস্তি প্রতিযোগিতা।’ আসর শেষ হওয়ার পর জাতীয় পুরুষ ও নারী দলের কোচ শিরিন সুলতানাকে দেখা গেল দুই দলকে একসঙ্গে কুস্তির মারপ্যাঁচ শেখাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে একটি রেসিং সাইকেল নিয়ে হাজির হলেন এক তরুণী। জানা গেল, এই নারী কুস্তিগীরদের সঙ্গে তার আগে থেকেই জানাশোনা, তাদের দেখতে এসেছেন।

কথা হয় তার সঙ্গে। তার নাম তানজিনা মিতু। মূলত কারাতে ও উশু খেলোয়াড়। তবে তায়কোয়ান্দো, সাভাতে এবং কুস্তিও খেলেন। বছর দুয়েক হলো সাইক্লিংও করছেন। এবারের রোজার ঈদের পরে একা একা সাইকেল চালিয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন। সময় লেগেছে ১২ দিন। রাতে থেকেছেন ডাকবাংলো এবং সার্কিট হাউজে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কুস্তি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিন আজাদসহ আরও অনেকে।

তানজিনা জানান, ‘খেলাধুলা করার জন্য পরিবার থেকে কখনই কোন বাধা পাইনি। বরং তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছি। এই যে সাইকেলটা দেখছেন, এটা বাবা (ব্যবসায়ী) আমাকে আড়াই লাখ টাকায় কিনে দিয়েছেন।’
ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সে ইংরেজিতে অর্নাস নিয়ে পড়াশোনা করা তানজিনার সাইক্লিং নিয়ে ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘জানি না, আল্লাহ জানে (হাসি)।’ তানজিনার কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত জবাব। তবে একটু ভেবে লক্ষ্যের কথা জানালেন অবশেষে, ‘সাইক্লিংয়ে এখনও জাতীয় পর্যায়ে খেলিনি। তবে আমার একটাই শখ-আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া।’ এর জন্য তো প্রচুর অর্থ দরকার। তার কী হবে? ‘সেটা আমার ফ্যামিলি দেখবে। তাদের সাপোর্ট আছে বলেই আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। এজন্য নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি। তারা আমাকে বলেন, তোমার ইচ্ছামতো খেলাধুলা কর। ভালো রেজাল্ট কর। বাবা তো মাঝে মধ্যেই হুমকি দেন, খেলায় ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে বাড়িতে আসার দরকার নেই। এমনকি তারা আমাকে নিজের পছন্দমতো বিয়েও করতে বলেছেন!’ তানজিনার ভাষ্য।

পাড়া-প্রতিবেশী এবং বাইরের লোকজন তানজিনার খেলাধুলা করা নিয়ে নেতিবাচক কথা বললেও সেগুলো পাত্তা দিতে বয়েই গেছে তানজিনার! বরং এসব কথাগুলোকে নিজের জন্য ‘দোয়া’ মনে করেন! এগুলো থেকে খুঁজে নেন ভালো ফল করার অনুপ্রেরণা।
সাইক্লিং বাদে বাকি চার খেলায় সাফল্যের ফিরিস্তি জানতে চাইলে তানজিনার ভাষ্য, ‘২০২৪ সালে নেপালে গৌতম বুদ্ধ কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে গিয়েছিলাম মেঘনা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায়। সে আসরে স্বর্ণপদক জিতেছিলাম। ভারতে গিয়ে কারাতেতে জিতেছেন তিনটি স্বর্ণপদক। এছাড়া দেশে উশু, তায়কোয়ান্দো, সাভাতে এবং কুস্তিতেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পদক জিতেছি।’

কিভাবে মার্শাল আর্ট রপ্ত করলেন, সেই গল্পও শোনান তানজিনা, ‘ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল ছিলাম। দুষ্টও ছিলাম অনেক। সহপাঠীরা ধরে ধরে আমাকে মারতো! মারামারির প্রতি এক ধরনের নেশা ছিল। কারাতে শিখলাম স্কুলে এবং সোতোকান কারাতে এ্যাসোসিয়েশনে। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। তারপর উশুও শিখলাম (এখন শিখছেন লিটন স্যারের কাছে)।

মার্শাল আর্টের বিদ্যা একবার বাস্তবে কাজে লাগিয়েছিলেন তানজিনা। ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি, ‘সাইক্লিং করতে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জেলায় যাই। সৌভাগ্যবশত এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা বা বিরূপ আবহাওয়ার মুখোমুখি হইনি। আর সাইকেলের চাকা পাংচার হলে বা অন্য কোনো সমস্যা হলে সেটা নিজেই মেরামত করে নিই। তবে একবার খাগড়াছড়ি থেকে কুমিল্লায় যাচ্ছি। একটা লোক আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেছিল। তখন তাকে ধরে পিটিয়েছি!’
সাম্প্রতিককালে ফুটবল-ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলায় বাংলাদেশের মেয়েরা এগিয়ে আসছে এবং বেশ সাফল্যও পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তানজিনার ভাষ্য, ‘এই ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। আমি চাই বাংলাদেশের মেয়েরা খেলাধুলাসহ সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাক। বিশ্বের অন্য মেয়েদের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের মেয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করছে।’
এখন দেখার বিষয়, আগামী দিনগুলোতে বহুমুখী প্রতিভা তানজিনা মিতু ছয় খেলার কোনটিতে কেমন সফলতা অর্জন করতে পারেন।
আরকে/সবা
রুমেল খান 
























