০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কুস্তি কোচ শিরিন সুলতানা : স্বপ্ন ভেন্যুর, লক্ষ্য স্বর্ণপদক

  • রুমেল খান
  • আপডেট সময় : ০৯:১৬:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫
  • 493

যাকে নিয়ে এই লেখার অবতারণা, তাঁকে মাত্র একটি বাক্যেই বিশ্লেষণ করা যায়। সেটি হচ্ছে ‘যোদ্ধা থেকে পথপ্রদর্শক’!

গত ২৩ জুন। বাংলাদেশের কুস্তি অঙ্গনে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথমবারের মতো জাতীয় কুস্তি দলে নারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান শিরিন সুলতানা। শুধু নারী দলের নয়, পুরুষ দলেরও! এশিয়ান ইয়ুথ গেমস, ইসলামিক সলিডারিটি গেমস ও সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমস, এই তিনটি বড় আন্তর্জাতিক আসর আসছে সামনে। এগুলোকে সামনে রেখে ঢাকার মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে শুরু হয় জাতীয় কুস্তি দলের অনুশীলন ক্যাম্প। আর সুইমিং অনুশীলন করা হয় মিরপুরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সুইমিং কমপ্লেক্সে। মোট ৫২ কুস্তিগীরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন কোচ শিরিন। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৮টা এবং বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে কঠোর অনুশীলন। এখান থেকেই গঠন করা হবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত দল।

আবাসিক কুস্তি ক্যাম্পে শিষ্য ও শিষ্যা কুস্তিগীরদের সঙ্গে শিরিন

১৯৮৮ সালে পৃথিবীতে আসা শিরিনের খেলোয়াড়ী জীবন বেশ বর্ণাঢ্যময়। খেলেছেন কুস্তি, উশু, কাবাডি, রোইং ও গলফ। সব খেলাতেই পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ আনসারে ব্যাটালিয়ন সৈনিক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আনসারে ট্যালেন্ট হান্ট কার্যক্রম শুরু হলে সেখানে জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় রেহানা পারভীনের নজরে আসেন। মূলত সেখান থেকেই তার খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু। কুস্তিগীর হিসেবেই তিনি নিজেকে পরিচিত করেছেন।

২০০৯ সালে কুস্তিগীর হিসেবে যাত্রা শুরু শিরিনের। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছিল তার সমান পদচারণা। শিরিনের ক্যারিয়ারের সাফল্যগুলো হচ্ছে-জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে কুস্তিতে টানা তিন বছর স্বর্ণপদক (২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে)। প্রথমবার জুনিয়র, আর শেষের দুবার সিনিয়র প্লেয়ার হিসেবে। এছাড়া ২০১২ সালে সেরা রেসলার পুরস্কার, ভারতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-বাংলা কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক, ২০১৬ সালে গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে ৬৮ কেজিতে পেয়েছিলেন রৌপ্যপদক। ২০১৭ সালে আজারবাইজানের বাকুতে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে অর্জন করেন ব্রোঞ্জপদক। ২০১৮ সালের গোল্ড কোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে হয়েছিলেন চতুর্থ।

আগামী এসএ গেমসে নারী ও পুরুষ জাতীয় কুস্তি দলকে সোনা জেতাতে চান শিরিন

অংশ নেন এশিয়ান ইনডোর এ্যান্ড মার্শাল আর্টস গেমসেও। উশুতে জাতীয় পর্যায়ে ২০১০ ও ২০১১ সালে রৌপ্য এবং ২০১৪ সালে স্বর্ণপদক জেতেন।
জাতীয় রোইং চ্যাম্পিয়নশিপেও স্বর্ণপদক পেয়েছেন টানা চারবার (২০১০-১৩)।

কাবাডিও খেলেছেন শিরিন। বাংলাদেশ আনসারের হয়ে ২০১১ সালে জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১২ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে জাতীয় মহিলা ক্লাব লিগে বিজয়ী হয়ে সোনা জেতে শিরিনের দল। ২০১৫ সালে জাতীয় মহিলা কাবাডিতেও স্বর্ণপদক অর্জন করেন।

কুস্তি, উশু, কাবাডি, রোইং, গলফ … পাঁচ খেলাতেই শিরিনের রয়েছে উল্লেখযোগ্য সফলতা

শিরিন গলফও খেলেছেন। সেখানেও সাফল্য। জিতেছেন সাতটি পদক। এর ছয়টিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, বাকি একটিতে হয়েছেন রানারআপ।
২০১৯ সালে কুস্তি থেকে বিদায় নেন শিরিন। খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা ও অর্জনকে কাজে লাগিয়ে এখন তিনি তৈরি করছেন নতুন প্রজন্মের কুস্তিগীরদের। কোচ হিসেবে সম্পন্ন করেছেন সলিডারিটি কোচেস কোর্স লেভেল-২। এছাড়া শিরিন বাংলাদেশ এ্যামেচার রেসলিং ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্যও বটে (গত জুলাই থেকে)।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় শিরিন সুলতানা গড়ে তুলেছেন পোলট্রি ফার্ম। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি হয়েছেন স্বাবলম্বী। পোলট্রি ব্যবসার পাশাপাশি মাছ, সবজি, মৌসুমি ফল, হাঁস লালন-পালন করছেন।

ফেডারেশনের কাছে শিরিনের একটাই চাওয়া-কুস্তিগীরদের সারাবছর নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলনের জন্য আলাদা একটি ভেন্যু

সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির পুরস্কার, শেরেবাংলা পুরস্কার, হিউম্যান রাইটস পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন।

কদিন আগেই ঢাকার পল্টনের শহীদ (ক্যাপ্টেন) এম মনসুর আলী জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কুস্তি প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতা দেখতে উপস্থিত ছিলেন শিরিন। প্রতিযোগিতা শেষে শিরিন সবুজ বাংলার প্রতিবেদককে জানান, ‘এই টুর্নামেন্টটি কুস্তি ফেডারেশনের একটি নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে খেলোয়াড়রা এসেছে। আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য কিছু খেলোয়াড় বাছাই করব, সেটা তারও অংশ।’

ক্ষুদে কুস্তিগীরদের শক্তি পরীক্ষা করছেন কোচ শিরিন

শিরিন আরও বলেন, ‘আমার অধীনে এখন ৫২ খেলোয়াড় আছে। মেয়ে আছে ১৮ জন, বাকিরা ছেলে। এদের বেশিরভাগই সার্ভিসেস সংস্থার (আনসার ও বিজিবি)। তবে আমি এবার সিভিল কিছু খেলোয়াড়ও রেখেছি এই প্রথমবারের মতো। যেমন ইয়ুথ গেমসে দুজন যাবে। এদের একজন নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার অর্পিতা বিশ্বাস, আরেকজন খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার মোহনা খাতুন। এভাবেই তৃণমূল থেকে থেকে প্লেয়ার এনে আমরা নতুন করে শুরু করতে চাই।’

কোচিং করতে গিয়ে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি না? এই প্রশ্বের জবাবে শিরিনের উত্তর, ‘আমি যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছি, তার একমাত্র সমাধান দিতে পারে বাংলাদেশ সরকার। আজ আমি হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে এসে কুস্তির কার্যক্রম করছি, এটা তো আমার কাম্য না। আমি জাতীয় দলের প্লেয়ার ছিলাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক জিতেছি দেশের জন্য। এবং যারা আমার সঙ্গে ক্যাম্পে আছে, তারা সবাই দেশের জন্য পদক জিততে যতটা পরিশ্রম করে যাচ্ছে, সেটা তখনই স্বার্থক হবে, যখন নিজেদের একটা স্টেডিয়াম থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে চাইবো অন্য ফেডারেশনের যেন নিজস্ব ভেন্যু আছে, তেমনি আমাদের জন্যও একটি ভেন্যু দেওয়া হোক, যেন আমরা সারাবছর সেখানে অনুশীলন করতে পারি।’

শিরিন যখন কুস্তিগীর ছিলেন

শিরিন আরও যোগ করেন, ‘যেমন আজকের কথাই ধরুন। যারা কুমিল্লা থেকে আসছে, তারা একটি গোল্ড মেডেল জিতেছে। এটা নিয়ে তারা কুমিল্লায় ফিরে যাবে। এতে করে তাদের প্রতিভা ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার কবে জুনিয়র বা সিনিয়র পর্যায়ে খেলা হবে, তখন তারা আসবে। আমি সেটা চাই না। আমি চাইবো যারা পড়াশোনা করে, তাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা থাকবে, থাকার ব্যবস্থা থাকবে। যদি এমন ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে শুধু রেসলিং নয়, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের চেহারাই পাল্টে যাবে।’

ফেডারেশনের কাছে শিরিনের যে চাহিদা, সেটা কি তারা পূরণ করতে পেরেছে? ‘বিগত আমলে আমি যখন খেলোয়াড় ছিলাম, তখন ফেডারেশনের যেসব কর্মকর্তা ছিলেন, জানি না তারা কুস্তির আলাদা ভেন্যুর জন্য কোন কর্মকাণ্ড করেছিলেন কি না। এখন যারা কমিটিতে আছেন, তাদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে সব স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে, প্লেয়ারদের স্বার্থে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যেন যোগাযোগটা রক্ষা করে। কুস্তি খেলোয়াড়দের জন্য যেন একটা স্টেডিয়াম তৈরি করে দেন।’ শিরিনের ভাষ্য।

গলফার হিসেবেও সফলতা পেয়েছেন শিরিন

বর্তমানে ক্যাম্পে খেলোয়াড়দের ডায়েট নিয়ে পুরোপুরিই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন শিরিন। খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে শিরিনের ভাষ্য, ‘যখন খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেই, তখন আমি কোচ। যখন খেলোয়াড়দের সঙ্গে ক্যাম্পের রুমে থাকি, তখন আমি তাদের বন্ধু।’

পুরুষ-নারী উভয় দলকেই কোচিং করানোটা কতটা চ্যালেঞ্জের? শিরিনের জবাব, ‘আসলে জীবনটাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জের। আমি সেই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছি দেশের জন্য, দেশের স্বার্থে। আমার এই দেশপ্রেমের জায়গা থেকে দেশের জন্য সামনে যে গেমসগুলো আছে, যেখানে যেন প্লেয়াররা ভালো খেলতে পারে, বিশেষ করে এসএ গেমসের আগের রেজাল্টের চেয়ে ভালো করে যেন স্বর্ণপদক জিততে পারে, সেটাই আমার প্রত্যাশা থাকবে।’

শিষ্যাকে কুস্তির প্যাঁচ শেখাচ্ছেন কোচ শিরিন

জাতীয় দলের কোচ হিসেবে শিরিনের জন্য এটাই প্রথম পরীক্ষা। বিষয়টা কতটা চ্যালেঞ্জের, কতটা উপভোগের? ‘এটা আমার কাছে যতটা চ্যালেঞ্জের, ততটাই উপভাগের। কারণ এখানে যারা প্লেয়ার হিসেবে আছে, তাদের মধ্যে ১০-১২ জন আমার কলিগ ছিল, আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন গেমসে খেলেছি। এখন আমি তাদের কোচ। এটার সঙ্গে তুলনা করা যায় বুয়েটের জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে। যখন তিনি বুয়েট থেকে পাশ করে বের হলেন, তার পরদিনই তিনি বুয়েটের টিচার হয়েছিলেন। ক্লাসে গিয়ে দেখলেন কেউ তার কলিগ, কেউ তার জুনিয়র, কেউ তার সিনিয়র। আমার বেলাতেও অনেকটা এই রকম হয়ে গেছে আর কি! এটা খুবই উপভোগ্য।’

চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে শিরিনের

কিন্তু তার মানে এই না যে তারা শিরিনের কমান্ড ফলো করে না, ‘তারা আমার সব ধরনের কমান্ড ফলো করে।’ শিরিনের ভাষ্য।

ক্যাম্পের ৫২ খেলোয়াড়দের মধ্যে আগামী এসএ গেমসের জন্য আছেন ৩২ জন। এদের মধ্যে ৭ ছেলে ও ৭ মেয়ে সেই গেমসে অংশ নেবেন। এদের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন আরও ৭ ছেলেমেয়ে। শিরিন এদের পেয়েছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কুস্তি প্রতিযোগিতার খেলা দেখে। ক্রীড়া পরিষদ থেকে যে বাজেট পাওয়া গেছে, তার বাইরেও ফেডারেশন থেকে একটা বাজেট যোগ করা হবে। ফলশ্রুতিতে আরও ১০ জনকে ইনক্লুড করবেন শিরিন। ফলে দল হবে ৪২ জনের। শেষ মুহূর্তে এদের মধ্যে থেকে ১৪ জনকে চূড়ান্তভাবে বাছাই করবেন তিনি।

ময়মনসিংহের মেয়ে শিরিন নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও বেশ সফল

সবশেষে শিরিন বলেন, ‘এসএ গেমসে লক্ষ্য থাকবে ছেলে-মেয়ে উভয় দলকে স্বর্ণপদক জেতানোর।’

এখন দেখার বিষয়, আগামীতে শিরিনের চাওয়া (কুস্তির জন্য আলাদা ভেন্যু পাওয়া) এবং লক্ষ্য (এসএ গেমসে দুই দলকে স্বর্ণপদক জেতানো) কতটুকু অর্জিত হয়।

আরকে/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

সপরিবারে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন তারেক রহমান

কুস্তি কোচ শিরিন সুলতানা : স্বপ্ন ভেন্যুর, লক্ষ্য স্বর্ণপদক

আপডেট সময় : ০৯:১৬:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫

যাকে নিয়ে এই লেখার অবতারণা, তাঁকে মাত্র একটি বাক্যেই বিশ্লেষণ করা যায়। সেটি হচ্ছে ‘যোদ্ধা থেকে পথপ্রদর্শক’!

গত ২৩ জুন। বাংলাদেশের কুস্তি অঙ্গনে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথমবারের মতো জাতীয় কুস্তি দলে নারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান শিরিন সুলতানা। শুধু নারী দলের নয়, পুরুষ দলেরও! এশিয়ান ইয়ুথ গেমস, ইসলামিক সলিডারিটি গেমস ও সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমস, এই তিনটি বড় আন্তর্জাতিক আসর আসছে সামনে। এগুলোকে সামনে রেখে ঢাকার মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে শুরু হয় জাতীয় কুস্তি দলের অনুশীলন ক্যাম্প। আর সুইমিং অনুশীলন করা হয় মিরপুরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সুইমিং কমপ্লেক্সে। মোট ৫২ কুস্তিগীরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন কোচ শিরিন। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৮টা এবং বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে কঠোর অনুশীলন। এখান থেকেই গঠন করা হবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত দল।

আবাসিক কুস্তি ক্যাম্পে শিষ্য ও শিষ্যা কুস্তিগীরদের সঙ্গে শিরিন

১৯৮৮ সালে পৃথিবীতে আসা শিরিনের খেলোয়াড়ী জীবন বেশ বর্ণাঢ্যময়। খেলেছেন কুস্তি, উশু, কাবাডি, রোইং ও গলফ। সব খেলাতেই পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ আনসারে ব্যাটালিয়ন সৈনিক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আনসারে ট্যালেন্ট হান্ট কার্যক্রম শুরু হলে সেখানে জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় রেহানা পারভীনের নজরে আসেন। মূলত সেখান থেকেই তার খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু। কুস্তিগীর হিসেবেই তিনি নিজেকে পরিচিত করেছেন।

২০০৯ সালে কুস্তিগীর হিসেবে যাত্রা শুরু শিরিনের। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছিল তার সমান পদচারণা। শিরিনের ক্যারিয়ারের সাফল্যগুলো হচ্ছে-জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে কুস্তিতে টানা তিন বছর স্বর্ণপদক (২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে)। প্রথমবার জুনিয়র, আর শেষের দুবার সিনিয়র প্লেয়ার হিসেবে। এছাড়া ২০১২ সালে সেরা রেসলার পুরস্কার, ভারতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-বাংলা কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক, ২০১৬ সালে গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে ৬৮ কেজিতে পেয়েছিলেন রৌপ্যপদক। ২০১৭ সালে আজারবাইজানের বাকুতে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে অর্জন করেন ব্রোঞ্জপদক। ২০১৮ সালের গোল্ড কোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে হয়েছিলেন চতুর্থ।

আগামী এসএ গেমসে নারী ও পুরুষ জাতীয় কুস্তি দলকে সোনা জেতাতে চান শিরিন

অংশ নেন এশিয়ান ইনডোর এ্যান্ড মার্শাল আর্টস গেমসেও। উশুতে জাতীয় পর্যায়ে ২০১০ ও ২০১১ সালে রৌপ্য এবং ২০১৪ সালে স্বর্ণপদক জেতেন।
জাতীয় রোইং চ্যাম্পিয়নশিপেও স্বর্ণপদক পেয়েছেন টানা চারবার (২০১০-১৩)।

কাবাডিও খেলেছেন শিরিন। বাংলাদেশ আনসারের হয়ে ২০১১ সালে জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১২ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে জাতীয় মহিলা ক্লাব লিগে বিজয়ী হয়ে সোনা জেতে শিরিনের দল। ২০১৫ সালে জাতীয় মহিলা কাবাডিতেও স্বর্ণপদক অর্জন করেন।

কুস্তি, উশু, কাবাডি, রোইং, গলফ … পাঁচ খেলাতেই শিরিনের রয়েছে উল্লেখযোগ্য সফলতা

শিরিন গলফও খেলেছেন। সেখানেও সাফল্য। জিতেছেন সাতটি পদক। এর ছয়টিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, বাকি একটিতে হয়েছেন রানারআপ।
২০১৯ সালে কুস্তি থেকে বিদায় নেন শিরিন। খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা ও অর্জনকে কাজে লাগিয়ে এখন তিনি তৈরি করছেন নতুন প্রজন্মের কুস্তিগীরদের। কোচ হিসেবে সম্পন্ন করেছেন সলিডারিটি কোচেস কোর্স লেভেল-২। এছাড়া শিরিন বাংলাদেশ এ্যামেচার রেসলিং ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্যও বটে (গত জুলাই থেকে)।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় শিরিন সুলতানা গড়ে তুলেছেন পোলট্রি ফার্ম। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি হয়েছেন স্বাবলম্বী। পোলট্রি ব্যবসার পাশাপাশি মাছ, সবজি, মৌসুমি ফল, হাঁস লালন-পালন করছেন।

ফেডারেশনের কাছে শিরিনের একটাই চাওয়া-কুস্তিগীরদের সারাবছর নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলনের জন্য আলাদা একটি ভেন্যু

সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির পুরস্কার, শেরেবাংলা পুরস্কার, হিউম্যান রাইটস পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন।

কদিন আগেই ঢাকার পল্টনের শহীদ (ক্যাপ্টেন) এম মনসুর আলী জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কুস্তি প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতা দেখতে উপস্থিত ছিলেন শিরিন। প্রতিযোগিতা শেষে শিরিন সবুজ বাংলার প্রতিবেদককে জানান, ‘এই টুর্নামেন্টটি কুস্তি ফেডারেশনের একটি নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে খেলোয়াড়রা এসেছে। আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য কিছু খেলোয়াড় বাছাই করব, সেটা তারও অংশ।’

ক্ষুদে কুস্তিগীরদের শক্তি পরীক্ষা করছেন কোচ শিরিন

শিরিন আরও বলেন, ‘আমার অধীনে এখন ৫২ খেলোয়াড় আছে। মেয়ে আছে ১৮ জন, বাকিরা ছেলে। এদের বেশিরভাগই সার্ভিসেস সংস্থার (আনসার ও বিজিবি)। তবে আমি এবার সিভিল কিছু খেলোয়াড়ও রেখেছি এই প্রথমবারের মতো। যেমন ইয়ুথ গেমসে দুজন যাবে। এদের একজন নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার অর্পিতা বিশ্বাস, আরেকজন খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার মোহনা খাতুন। এভাবেই তৃণমূল থেকে থেকে প্লেয়ার এনে আমরা নতুন করে শুরু করতে চাই।’

কোচিং করতে গিয়ে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি না? এই প্রশ্বের জবাবে শিরিনের উত্তর, ‘আমি যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছি, তার একমাত্র সমাধান দিতে পারে বাংলাদেশ সরকার। আজ আমি হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে এসে কুস্তির কার্যক্রম করছি, এটা তো আমার কাম্য না। আমি জাতীয় দলের প্লেয়ার ছিলাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক জিতেছি দেশের জন্য। এবং যারা আমার সঙ্গে ক্যাম্পে আছে, তারা সবাই দেশের জন্য পদক জিততে যতটা পরিশ্রম করে যাচ্ছে, সেটা তখনই স্বার্থক হবে, যখন নিজেদের একটা স্টেডিয়াম থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে চাইবো অন্য ফেডারেশনের যেন নিজস্ব ভেন্যু আছে, তেমনি আমাদের জন্যও একটি ভেন্যু দেওয়া হোক, যেন আমরা সারাবছর সেখানে অনুশীলন করতে পারি।’

শিরিন যখন কুস্তিগীর ছিলেন

শিরিন আরও যোগ করেন, ‘যেমন আজকের কথাই ধরুন। যারা কুমিল্লা থেকে আসছে, তারা একটি গোল্ড মেডেল জিতেছে। এটা নিয়ে তারা কুমিল্লায় ফিরে যাবে। এতে করে তাদের প্রতিভা ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার কবে জুনিয়র বা সিনিয়র পর্যায়ে খেলা হবে, তখন তারা আসবে। আমি সেটা চাই না। আমি চাইবো যারা পড়াশোনা করে, তাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা থাকবে, থাকার ব্যবস্থা থাকবে। যদি এমন ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে শুধু রেসলিং নয়, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের চেহারাই পাল্টে যাবে।’

ফেডারেশনের কাছে শিরিনের যে চাহিদা, সেটা কি তারা পূরণ করতে পেরেছে? ‘বিগত আমলে আমি যখন খেলোয়াড় ছিলাম, তখন ফেডারেশনের যেসব কর্মকর্তা ছিলেন, জানি না তারা কুস্তির আলাদা ভেন্যুর জন্য কোন কর্মকাণ্ড করেছিলেন কি না। এখন যারা কমিটিতে আছেন, তাদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে সব স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে, প্লেয়ারদের স্বার্থে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যেন যোগাযোগটা রক্ষা করে। কুস্তি খেলোয়াড়দের জন্য যেন একটা স্টেডিয়াম তৈরি করে দেন।’ শিরিনের ভাষ্য।

গলফার হিসেবেও সফলতা পেয়েছেন শিরিন

বর্তমানে ক্যাম্পে খেলোয়াড়দের ডায়েট নিয়ে পুরোপুরিই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন শিরিন। খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে শিরিনের ভাষ্য, ‘যখন খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেই, তখন আমি কোচ। যখন খেলোয়াড়দের সঙ্গে ক্যাম্পের রুমে থাকি, তখন আমি তাদের বন্ধু।’

পুরুষ-নারী উভয় দলকেই কোচিং করানোটা কতটা চ্যালেঞ্জের? শিরিনের জবাব, ‘আসলে জীবনটাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জের। আমি সেই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছি দেশের জন্য, দেশের স্বার্থে। আমার এই দেশপ্রেমের জায়গা থেকে দেশের জন্য সামনে যে গেমসগুলো আছে, যেখানে যেন প্লেয়াররা ভালো খেলতে পারে, বিশেষ করে এসএ গেমসের আগের রেজাল্টের চেয়ে ভালো করে যেন স্বর্ণপদক জিততে পারে, সেটাই আমার প্রত্যাশা থাকবে।’

শিষ্যাকে কুস্তির প্যাঁচ শেখাচ্ছেন কোচ শিরিন

জাতীয় দলের কোচ হিসেবে শিরিনের জন্য এটাই প্রথম পরীক্ষা। বিষয়টা কতটা চ্যালেঞ্জের, কতটা উপভোগের? ‘এটা আমার কাছে যতটা চ্যালেঞ্জের, ততটাই উপভাগের। কারণ এখানে যারা প্লেয়ার হিসেবে আছে, তাদের মধ্যে ১০-১২ জন আমার কলিগ ছিল, আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন গেমসে খেলেছি। এখন আমি তাদের কোচ। এটার সঙ্গে তুলনা করা যায় বুয়েটের জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে। যখন তিনি বুয়েট থেকে পাশ করে বের হলেন, তার পরদিনই তিনি বুয়েটের টিচার হয়েছিলেন। ক্লাসে গিয়ে দেখলেন কেউ তার কলিগ, কেউ তার জুনিয়র, কেউ তার সিনিয়র। আমার বেলাতেও অনেকটা এই রকম হয়ে গেছে আর কি! এটা খুবই উপভোগ্য।’

চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে শিরিনের

কিন্তু তার মানে এই না যে তারা শিরিনের কমান্ড ফলো করে না, ‘তারা আমার সব ধরনের কমান্ড ফলো করে।’ শিরিনের ভাষ্য।

ক্যাম্পের ৫২ খেলোয়াড়দের মধ্যে আগামী এসএ গেমসের জন্য আছেন ৩২ জন। এদের মধ্যে ৭ ছেলে ও ৭ মেয়ে সেই গেমসে অংশ নেবেন। এদের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন আরও ৭ ছেলেমেয়ে। শিরিন এদের পেয়েছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কুস্তি প্রতিযোগিতার খেলা দেখে। ক্রীড়া পরিষদ থেকে যে বাজেট পাওয়া গেছে, তার বাইরেও ফেডারেশন থেকে একটা বাজেট যোগ করা হবে। ফলশ্রুতিতে আরও ১০ জনকে ইনক্লুড করবেন শিরিন। ফলে দল হবে ৪২ জনের। শেষ মুহূর্তে এদের মধ্যে থেকে ১৪ জনকে চূড়ান্তভাবে বাছাই করবেন তিনি।

ময়মনসিংহের মেয়ে শিরিন নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও বেশ সফল

সবশেষে শিরিন বলেন, ‘এসএ গেমসে লক্ষ্য থাকবে ছেলে-মেয়ে উভয় দলকে স্বর্ণপদক জেতানোর।’

এখন দেখার বিষয়, আগামীতে শিরিনের চাওয়া (কুস্তির জন্য আলাদা ভেন্যু পাওয়া) এবং লক্ষ্য (এসএ গেমসে দুই দলকে স্বর্ণপদক জেতানো) কতটুকু অর্জিত হয়।

আরকে/সবা