০৮:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পদ্মা সেতুর প্রভাব : হুমকির মুখে লঞ্চব্যবসা

  • পদ্মা সেতুতে রেলযোগাযোগ বাড়াচ্ছে চিন্তা
  • রোটেশনে চলে দুইটি করে লঞ্চ
  • যাত্রী কমেছে প্রায় অর্ধেক
  • ১০টি রুটের লঞ্চ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ

সাইফ আশরাফ
সারিসারি লঞ্চ, প্রতিদিন হাজারো মানুষের ভিড়, হাঁকডাক, কুলিদের দৌড়াদৌড়ি। এটাই ছিল রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট নৌ টার্মিনালের চিরচেনা চিত্র। তবে সদরঘাটে এখন আর দেখা মেলে না এই দৃশ্যের। গত বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ শুরু হয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চগুলোতে। জৌলুস হারিয়ে অনেকটা ধুঁকে-ধুঁকে চলছে একসময়ের জমজমাট লঞ্চব্যবসা। আজ মঙ্গলবার থেকে পদ্ম সেতু হয়ে শুরু হচ্ছে রেলযোগাযোগ। ফলে নতুন করে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে লঞ্চ ব্যবসার সাথে জড়িতদের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের বছর পার না হতেই মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বরিশাল বিভাগের ১২টি নৌ-রুটে। লঞ্চ চলাচলের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় রুট এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রী সংকটের মধ্যে রয়েছে বরগুনা-পটুয়াখালীর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো। এমনকি বরিশাল নদী বন্দরেও যাত্রীর খরা নেমেছে। ঢাকা থেকে ভোলা এবং ঢাকা থেকে চাঁদপুর রুটের লঞ্চে যাত্রী থাকলেও বাকিগুলো ঈদকেন্দ্রিক চলাচল করছে। সেগুলোতেও রয়েছে যাত্রীস্বল্পতা। গত বছর ২৫ অক্টোবর পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবং তেলের দাম লিটারে ৩০ টাকা বৃদ্ধির পাওয়ায় লঞ্চে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। এর ফলে লঞ্চের এ রুটে যাত্রী কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। তারপরও রুটে লঞ্চগুলো চালিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন মালিকরা। তবে যাত্রী সংখ্যা আরো কমে যাওয়ায় গত ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে প্রতিদিন দুইটি লঞ্চ সমন্বয় করে চালানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। রোটেশন করে চালিয়েও লাভের মুখ দেখতে পারছেন না লঞ্চ মালিকরা। কোটি কোটি টাকার লঞ্চ কেটে লোহার দামে বিক্রি করার ঘটনাও হচ্ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-বরিশাল নৌরুট এবং অভ্যন্তরীণ ১১টি রুটের মধ্যে ভান্ডারিয়া, টরকি, ঝালকাঠি এবং বরগুনা রুট যাত্রীর অভাবে সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর ৬টি রুটের মধ্যে ৫টি বন্ধ হয়ে গেছে। পটুয়াখালী থেকে দিনে একটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলেও যাত্রীর সংকটে ঈদুল আজহার পরে সেটিও বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বরগুনা থেকেও মাত্র একটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে। সেখানেও যাত্রী সংকটে প্রতিদিনের খরচ উঠছে না।
লঞ্চের মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর তারা যাত্রী সংকটে পড়েছেন। পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যেত। এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা কমে অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বাঁচার তাগিদে সব লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে পারছে সে লঞ্চ চালাচ্ছে। বর্তমানে রোটেশন ব্যবস্থা চালু করে প্রতি ৪ দিন পরে একটি লঞ্চ একটি ট্রিপ পায়। এতে তেল খরচ, স্টাফ বেতন নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। ঈদের সময় যাত্রী বাড়লেও তা আশানরূপ নয়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে এখন চিন্তিত তারা।
গত আগস্টে শপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ) পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করত। সেতু চালুর এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা ১৭ হাজার কমে ৩৩ হাজার হয়েছে। এ হিসাবে ঢাকার লঞ্চযাত্রী কমেছে ৩৪ শতাংশ। আগে ঢাকা থেকে প্রতিদিন অন্তত ৮০টি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যেত। এই সংখ্যা ২০ কমে এখন প্রতিদিন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ছেড়ে যায় ৬০টি লঞ্চ। অর্থাৎ এক বছরে লঞ্চ চলাচল কমেছে ২৫ শতাংশ।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবসায় মন্দার কারণে মালিকেরা এক বছরে অন্তত ২০টি লঞ্চ স্ক্র্যাপ (ভেঙ্গে যন্ত্রাংশসহ লোহালক্কড় বিক্রি) করে ফেলেছেন। এ ছাড়া আরো অন্তত ছয়টি লঞ্চ স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

প্রতিবেদনে যাত্রী ও লঞ্চ চলাচল কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সড়কপথে পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি নাব্যসংকট ও ঢাকার যানজটকেও দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, যথাযথভাবে নদী খনন ও পলি অপসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে অনেক নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া যানজট বিড়ম্বনায় সদরঘাট টার্মিনালে যেতে বহু মানুষের অনীহার কারণেও লঞ্চের যাত্রী কমে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এসসিআরএফ জানায়, আগে ঢাকা থেকে নৌপথে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিগামী লঞ্চের যাত্রী। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে এসব জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করে। ফলে নৌপথে যাত্রী ও লঞ্চ দুটোই কমেছে।
স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং তুলনামূলক নিরাপদ ভ্রমণ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চল তথা ঢাকা-বরিশালগামী যাত্রীদের একসময় প্রথম পছন্দ ছিল নৌপথ। ঈদ ছাড়াও সাধারণ সময় এ রুটের লঞ্চের একটি কেবিন টিকিট পেতে হিমশিম খেতে হতো যাত্রীদের। সরকারি চাকরি পাওয়ার চেয়েও ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চের কেবিন টিকিট পাওয়া কঠিন এমন প্রবাদও ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণের সড়ক পরিবহনে জোয়ার এসেছে। উল্টো হোঁচট খেয়েছে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ ব্যবসা।
গত সেপ্টেম্বরে নাগরিক সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা থেকে বরিশাল বিভাগসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন নৌপথে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ লঞ্চযাত্রী কমেছে। এর মধ্যে গত এক বছরেই কমেছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এই মন্দার কারণে নৌযান মালিকরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন এবং লঞ্চ চলাচল কমে আসছে। ফলে অনেক নৌযানশ্রমিকও দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন। ঢাকা থেকে বরিশাল বিভাগসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন নৌপথে লঞ্চযাত্রীর সংখ্যা কমার পেছনে চারটি প্রধান কারণ, এ সব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানী ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে উন্নত সড়ক যোগাযোগ, মহানগরীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে ঢাকা নদীবন্দরের সদরঘাট টার্মিনাল পর্যন্ত সড়কে দুঃসহ যানজট, প্রয়োজনীয় খনন ও নিয়মিত পলি অপসারণের অভাবে বিভিন্ন নৌপথে তীব্র নাব্যসংকট এবং টার্মিনালসহ এর আশেপাশে ইজারাদারের লোকজন ও কুলি-মজুরের দৌরাত্ম্য।
জাতীয় কমিটি জানায়, ঢাকা থেকে লঞ্চে যাতায়াতকারীদের বড় অংশ বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার যাত্রী। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা শহরের সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুর বিভাগের ২১ জেলার অত্যাধুনিক সড়ক যোগাযোগ হয়েছে। মানুষ স্বল্প সময়ে আরামদায়ক যাতায়াত করতে পারছে। ফলে বরিশালগামী যাত্রীদের একটি বড় অংশ আর লঞ্চে চড়ছে না।
সার্বিক বিষয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক বলেন, সবাই লোকসানে আছে। আগে যেখানে দিনে ৭-৮টা লঞ্চ যেত, এখন রোটেশনে দুইটা করে চালানো হচ্ছে তারপরও টাকা উঠছে না। তেলের দাম বেড়েছে এটা যেমন সমস্যা, আরো বড় সমস্যা ভেজাল তেল। এখন যে তেলটা আমরা পাচ্ছি কেরোসিনের মতো পাতলা। ফলে দ্রুত জ্বলে যাচ্ছে, ২-৩ ব্যারেল তেল বেশি লাগছে আবার ইঞ্জিনেরও ক্ষতি হচ্ছে। লঞ্চের মেইনটেইন খরচ ছাড়াও আমাদের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার বিষয় আছে। সব মিলিয়ে আমরা বিপাকে।
পদ্ম সেতু হয়ে রেলযোগাযোগ শুরু হওয়াতে নতুন করে প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেল চালু হওয়ার পর সেটা বোঝা যাবে। তবে চিন্তা তো কাজ করছেই একটা।
লঞ্চমালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, কোনো রোটেশন নয়। বাঁচার তাগিদে সব লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে পারছে সে লঞ্চ চালাচ্ছে। পদ্মা সেতুর আগে ঢাকা থেকে বরিশাল এবং বরিশাল থেকে ঢাকা রুটে ১০টি লঞ্চ চলাচল করত। এখন রুটিন করে মাত্র দুটি লঞ্চ চলাচল করছে। তাও দুটি লঞ্চেই যাত্রী থাকে খুব কম। এ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে পটুয়াখালী রুটে একটি করে লঞ্চ চলাচল করছে। সেটিতেও যাত্রীস্বল্পতার কারণে লোকসান হচ্ছে। লঞ্চগুলো নিয়মিত ট্রিপ না পাওয়ায় কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যথাসময়ে বেতন না পেয়ে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন বলেও তিনি জানান।
বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক কবির হোসেন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে ৪১টি রুটে নৌযান চলাচল করত। কিন্তু যাত্রীস্বল্পতার কারণে নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলের ১০টি রুটে লঞ্চ চলাচল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি রুটে অঞ্চলভিত্তিক (স্থানীয় রুটে) কিছু লঞ্চ চলাচল করছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে বর্তমানে রোটেশন করে লঞ্চ চলাচল করছে। ঢাকা-বরিশাল রুটে আগে যেখানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি লঞ্চ চলাচল করত, সেখানে এখন মাত্র দুটি লঞ্চ চলছে। তার পরেও যাত্রীস্বল্পতার কারণে লঞ্চ মালিকরা লোকসানে আছেন। তিনি বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কারণে লোকজন তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। এ কারণে এখন অনেকে লঞ্চে যাচ্ছেন না।

জনপ্রিয় সংবাদ

সানজিদা তন্বীর বিয়ের খবর জানালেন ফেসবুকে নিজের হৃদয়গ্রাহী পোস্টে

পদ্মা সেতুর প্রভাব : হুমকির মুখে লঞ্চব্যবসা

আপডেট সময় : ১০:৫৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ অক্টোবর ২০২৩
  • পদ্মা সেতুতে রেলযোগাযোগ বাড়াচ্ছে চিন্তা
  • রোটেশনে চলে দুইটি করে লঞ্চ
  • যাত্রী কমেছে প্রায় অর্ধেক
  • ১০টি রুটের লঞ্চ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ

সাইফ আশরাফ
সারিসারি লঞ্চ, প্রতিদিন হাজারো মানুষের ভিড়, হাঁকডাক, কুলিদের দৌড়াদৌড়ি। এটাই ছিল রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট নৌ টার্মিনালের চিরচেনা চিত্র। তবে সদরঘাটে এখন আর দেখা মেলে না এই দৃশ্যের। গত বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ শুরু হয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চগুলোতে। জৌলুস হারিয়ে অনেকটা ধুঁকে-ধুঁকে চলছে একসময়ের জমজমাট লঞ্চব্যবসা। আজ মঙ্গলবার থেকে পদ্ম সেতু হয়ে শুরু হচ্ছে রেলযোগাযোগ। ফলে নতুন করে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে লঞ্চ ব্যবসার সাথে জড়িতদের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের বছর পার না হতেই মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বরিশাল বিভাগের ১২টি নৌ-রুটে। লঞ্চ চলাচলের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় রুট এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রী সংকটের মধ্যে রয়েছে বরগুনা-পটুয়াখালীর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো। এমনকি বরিশাল নদী বন্দরেও যাত্রীর খরা নেমেছে। ঢাকা থেকে ভোলা এবং ঢাকা থেকে চাঁদপুর রুটের লঞ্চে যাত্রী থাকলেও বাকিগুলো ঈদকেন্দ্রিক চলাচল করছে। সেগুলোতেও রয়েছে যাত্রীস্বল্পতা। গত বছর ২৫ অক্টোবর পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবং তেলের দাম লিটারে ৩০ টাকা বৃদ্ধির পাওয়ায় লঞ্চে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। এর ফলে লঞ্চের এ রুটে যাত্রী কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। তারপরও রুটে লঞ্চগুলো চালিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন মালিকরা। তবে যাত্রী সংখ্যা আরো কমে যাওয়ায় গত ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে প্রতিদিন দুইটি লঞ্চ সমন্বয় করে চালানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। রোটেশন করে চালিয়েও লাভের মুখ দেখতে পারছেন না লঞ্চ মালিকরা। কোটি কোটি টাকার লঞ্চ কেটে লোহার দামে বিক্রি করার ঘটনাও হচ্ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-বরিশাল নৌরুট এবং অভ্যন্তরীণ ১১টি রুটের মধ্যে ভান্ডারিয়া, টরকি, ঝালকাঠি এবং বরগুনা রুট যাত্রীর অভাবে সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর ৬টি রুটের মধ্যে ৫টি বন্ধ হয়ে গেছে। পটুয়াখালী থেকে দিনে একটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলেও যাত্রীর সংকটে ঈদুল আজহার পরে সেটিও বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বরগুনা থেকেও মাত্র একটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে। সেখানেও যাত্রী সংকটে প্রতিদিনের খরচ উঠছে না।
লঞ্চের মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর তারা যাত্রী সংকটে পড়েছেন। পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যেত। এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা কমে অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বাঁচার তাগিদে সব লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে পারছে সে লঞ্চ চালাচ্ছে। বর্তমানে রোটেশন ব্যবস্থা চালু করে প্রতি ৪ দিন পরে একটি লঞ্চ একটি ট্রিপ পায়। এতে তেল খরচ, স্টাফ বেতন নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। ঈদের সময় যাত্রী বাড়লেও তা আশানরূপ নয়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে এখন চিন্তিত তারা।
গত আগস্টে শপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ) পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করত। সেতু চালুর এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা ১৭ হাজার কমে ৩৩ হাজার হয়েছে। এ হিসাবে ঢাকার লঞ্চযাত্রী কমেছে ৩৪ শতাংশ। আগে ঢাকা থেকে প্রতিদিন অন্তত ৮০টি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যেত। এই সংখ্যা ২০ কমে এখন প্রতিদিন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ছেড়ে যায় ৬০টি লঞ্চ। অর্থাৎ এক বছরে লঞ্চ চলাচল কমেছে ২৫ শতাংশ।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবসায় মন্দার কারণে মালিকেরা এক বছরে অন্তত ২০টি লঞ্চ স্ক্র্যাপ (ভেঙ্গে যন্ত্রাংশসহ লোহালক্কড় বিক্রি) করে ফেলেছেন। এ ছাড়া আরো অন্তত ছয়টি লঞ্চ স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

প্রতিবেদনে যাত্রী ও লঞ্চ চলাচল কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সড়কপথে পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি নাব্যসংকট ও ঢাকার যানজটকেও দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, যথাযথভাবে নদী খনন ও পলি অপসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে অনেক নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া যানজট বিড়ম্বনায় সদরঘাট টার্মিনালে যেতে বহু মানুষের অনীহার কারণেও লঞ্চের যাত্রী কমে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এসসিআরএফ জানায়, আগে ঢাকা থেকে নৌপথে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিগামী লঞ্চের যাত্রী। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে এসব জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করে। ফলে নৌপথে যাত্রী ও লঞ্চ দুটোই কমেছে।
স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং তুলনামূলক নিরাপদ ভ্রমণ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চল তথা ঢাকা-বরিশালগামী যাত্রীদের একসময় প্রথম পছন্দ ছিল নৌপথ। ঈদ ছাড়াও সাধারণ সময় এ রুটের লঞ্চের একটি কেবিন টিকিট পেতে হিমশিম খেতে হতো যাত্রীদের। সরকারি চাকরি পাওয়ার চেয়েও ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চের কেবিন টিকিট পাওয়া কঠিন এমন প্রবাদও ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণের সড়ক পরিবহনে জোয়ার এসেছে। উল্টো হোঁচট খেয়েছে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ ব্যবসা।
গত সেপ্টেম্বরে নাগরিক সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা থেকে বরিশাল বিভাগসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন নৌপথে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ লঞ্চযাত্রী কমেছে। এর মধ্যে গত এক বছরেই কমেছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এই মন্দার কারণে নৌযান মালিকরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন এবং লঞ্চ চলাচল কমে আসছে। ফলে অনেক নৌযানশ্রমিকও দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন। ঢাকা থেকে বরিশাল বিভাগসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন নৌপথে লঞ্চযাত্রীর সংখ্যা কমার পেছনে চারটি প্রধান কারণ, এ সব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানী ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে উন্নত সড়ক যোগাযোগ, মহানগরীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে ঢাকা নদীবন্দরের সদরঘাট টার্মিনাল পর্যন্ত সড়কে দুঃসহ যানজট, প্রয়োজনীয় খনন ও নিয়মিত পলি অপসারণের অভাবে বিভিন্ন নৌপথে তীব্র নাব্যসংকট এবং টার্মিনালসহ এর আশেপাশে ইজারাদারের লোকজন ও কুলি-মজুরের দৌরাত্ম্য।
জাতীয় কমিটি জানায়, ঢাকা থেকে লঞ্চে যাতায়াতকারীদের বড় অংশ বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার যাত্রী। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা শহরের সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুর বিভাগের ২১ জেলার অত্যাধুনিক সড়ক যোগাযোগ হয়েছে। মানুষ স্বল্প সময়ে আরামদায়ক যাতায়াত করতে পারছে। ফলে বরিশালগামী যাত্রীদের একটি বড় অংশ আর লঞ্চে চড়ছে না।
সার্বিক বিষয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক বলেন, সবাই লোকসানে আছে। আগে যেখানে দিনে ৭-৮টা লঞ্চ যেত, এখন রোটেশনে দুইটা করে চালানো হচ্ছে তারপরও টাকা উঠছে না। তেলের দাম বেড়েছে এটা যেমন সমস্যা, আরো বড় সমস্যা ভেজাল তেল। এখন যে তেলটা আমরা পাচ্ছি কেরোসিনের মতো পাতলা। ফলে দ্রুত জ্বলে যাচ্ছে, ২-৩ ব্যারেল তেল বেশি লাগছে আবার ইঞ্জিনেরও ক্ষতি হচ্ছে। লঞ্চের মেইনটেইন খরচ ছাড়াও আমাদের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার বিষয় আছে। সব মিলিয়ে আমরা বিপাকে।
পদ্ম সেতু হয়ে রেলযোগাযোগ শুরু হওয়াতে নতুন করে প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেল চালু হওয়ার পর সেটা বোঝা যাবে। তবে চিন্তা তো কাজ করছেই একটা।
লঞ্চমালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, কোনো রোটেশন নয়। বাঁচার তাগিদে সব লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে পারছে সে লঞ্চ চালাচ্ছে। পদ্মা সেতুর আগে ঢাকা থেকে বরিশাল এবং বরিশাল থেকে ঢাকা রুটে ১০টি লঞ্চ চলাচল করত। এখন রুটিন করে মাত্র দুটি লঞ্চ চলাচল করছে। তাও দুটি লঞ্চেই যাত্রী থাকে খুব কম। এ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে পটুয়াখালী রুটে একটি করে লঞ্চ চলাচল করছে। সেটিতেও যাত্রীস্বল্পতার কারণে লোকসান হচ্ছে। লঞ্চগুলো নিয়মিত ট্রিপ না পাওয়ায় কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যথাসময়ে বেতন না পেয়ে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন বলেও তিনি জানান।
বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক কবির হোসেন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে ৪১টি রুটে নৌযান চলাচল করত। কিন্তু যাত্রীস্বল্পতার কারণে নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলের ১০টি রুটে লঞ্চ চলাচল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি রুটে অঞ্চলভিত্তিক (স্থানীয় রুটে) কিছু লঞ্চ চলাচল করছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে বর্তমানে রোটেশন করে লঞ্চ চলাচল করছে। ঢাকা-বরিশাল রুটে আগে যেখানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি লঞ্চ চলাচল করত, সেখানে এখন মাত্র দুটি লঞ্চ চলছে। তার পরেও যাত্রীস্বল্পতার কারণে লঞ্চ মালিকরা লোকসানে আছেন। তিনি বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কারণে লোকজন তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। এ কারণে এখন অনেকে লঞ্চে যাচ্ছেন না।