- ৫ আগস্টের পর থেকে হত্যার ঘটনা যেন থামছেই না
সাম্প্রতিক নৃশংস ঘটনায় জনসাধারণ আতঙ্কিত
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য
হত্যাকাণ্ডে সমাজে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আশপাশের মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না-তৌহিদুল হক, অপরাধ বিশেষজ্ঞ
অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা কাজ করছি। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার জন্য আমরা সবচেয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করছি- এ কে এম শহিদুর রহমান, র্যাব মহাপরিচালক
৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে হত্যার ঘটনা থামছেই না। প্রতিদিনই সংবাদে যুক্ত হচ্ছে নতুন হত্যার খবর। সাম্প্রতিক একাধিক নৃশংস ঘটনায় জনসাধারণ আতঙ্কিত। তারা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের আতঙ্কের কথা জানাচ্ছেন। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে বিপুল সংখ্যক দেশীয় অস্ত্রও। সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব হত্যার পেছনে ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক বিরোধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বড় কারণ। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে শঙ্কা ও ভীতি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশি ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় সন্ত্রাসীরা তাদের কার্যক্রম বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। অপরাধীদের মধ্যে ভয়হীনতা ও অতিমাত্রায় নৃশংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য বড় ধরনের বর্বরতা চালাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মাদকাসক্তিকেও এই ভয়াবহতার পেছনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা আরও বলছেন, এই ধরনের নৃশংসতা রোধে সামাজিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে এবং অপরাধীদের বিচারের হার দ্রুত ও নির্ভুল করতে হবে। সর্বোপরি, অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা সময়ের দাবি। রাজধানীর লালবাগের শহীদনগর এলাকায় গণপিটুনিতে তৌফিকুল ইসলাম (২৬) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। নিহত তৌফিকুল শহীদনগর এলাকার বাসিন্দা ইউনুস খানের ছেলে। তার বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মাদক মামলাসহ ৮-১০টি মামলা রয়েছে। গত রোববার সকাল পৌনে ৮টার দিকে সেনা সদস্যরা মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার বামুনশিকড় এলাকায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে দুটি মামলা হয়েছে। শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সকালে নিজ বাড়ি থেকে মিনারুল ইসলাম (৩০), তার স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮), ছেলে মাহিম (১৩) ও দেড় বছরের মেয়ে মিথিলার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে ঋণের কারণে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। তদন্ত চলছে। রাজধানীর বনানীর ‘৩৬০ ডিগ্রি’ সিসা বারে রাহাত হোসেন রাব্বি (৩১) নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় রাব্বিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বনানী থানায় মামলা করেছেন। পুলিশ ইতোমধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে রাব্বিকে ঘিরে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে নাস্তার বিল চাওয়াকে কেন্দ্র করে গোলাপ মিয়া (৩৬) নামের এক যুবক পিস্তল দিয়ে গুলি চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বুধবার (১৩ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়নের নাপিতের বাজারে এ ঘটনা ঘটে। এতে হোটেল মালিকের ছেলে অসীম মিয়া (১৭) ও নারী কর্মচারী সেলিনা বেগম (৪২) গুলিবিদ্ধ হন। সাদুল্লাপুর থানার ওসি তাজউদ্দিন খন্দকার বলেন, অভিযুক্ত গোলাপকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তার ব্যবহৃত অস্ত্র ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত ১১ আগস্ট বিকেল মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারের আধিপত্য নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে শাহ আলম (২০) নামের এক তরুণ নিহত হন। এ সময় আহত হন তিনজন। এ ঘটনায় জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে দুটি চাপাতিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। কদিন আগেই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার তিনটি দোকানে অভিযান চালিয়ে সামুরাই ও চাপাতিসহ প্রায় এক হাজার ১০০টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধারের কথা জানায় সেনাবাহিনী। উদ্ধার অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- সামুরাই, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, বাংলা কুড়াল, চাকু, মিট হ্যামার। গত ৯ আগস্ট রাতে পরিচালিত অভিযানে এসব উদ্ধারের পর সেনাবাহিনী জানায়, এসব অস্ত্রের কোনো গৃহস্থালি ব্যবহার ‘নেই’, দীর্ঘদিন ধরে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রমে’ ব্যবহৃত হয়ে আসতে দেখা গেছে। শেরেবাংলা নগর আর্মি ক্যাম্প সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সম্প্রতি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারীদের উৎপাত ‘বেড়েছে’। বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে এক ধরনের ধারালো ‘সামুরাই’ চাপাতি উদ্ধার হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের বরাতে কোনো একটি স্থান থেকে এ ধরনের ‘সামুরাই’ অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে ভাড়া ও বিক্রি করা হচ্ছে জানতে পেরে এবং গ্রেপ্তার কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গত ৮ আগস্ট সকালে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর পলিথিনে মোড়ানো অলি মিয়া নামে এক যুবকের খণ্ডিত আট টুকরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নৃশংস এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করে র্যাব এবং চট্টগ্রাম থেকে হোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। গত ৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তায় কুপিয়ে ও গলা কেটে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ জানিয়েছে, ছিনতাইকারী চক্রের নারী সদস্য পথচারী বাদশাহকে বিরক্ত করলে বাদশাহ তাকে আঘাত করেন। এ সময় চক্রের অন্যান্য সদস্যরা বাদশাহকে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করেন। ঘটনাটি ভিডিও করছিলেন তুহিন। ভিডিও ধারণের বিষয়টি টের পেয়ে তারা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত র্যাব-পুলিশ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ৬ আগস্ট রাজধানী বংশাল মালিটোলা এলাকায় হীরা নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনার পেছনে মাদক কারবার ও সেবনের বিষয় থাকতে পারে। হত্যার ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রথমে তাকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে ও ইট-পাথরের চাঁই দিয়ে আঘাত করা হয়। মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়ার পর বিবস্ত্র করে শরীরের ওপর উঠে লাফায় দুর্বৃত্তরা। ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগ জানায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যা ও হত্যাচেষ্টা অভিযোগে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে রাজধানীর ৫০ থানায় ৭০৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় পাঁচ হাজার ৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের গত ছয় মাসের অপরাধ পরিসংখ্যানে জানা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৯৩১ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে খুন হন ২৯৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০। মার্চ মাসে খুন হন ৩১৬ জন। এপ্রিলে ৩৩৬ জন, মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন। জুনে ৩৪৪ জন খুন হয়েছেন। এই হিসাবে চলতি বছর প্রতিমাসে গড়ে দেশে খুন হয়েছেন ৩২১ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে ডিএমপিতে খুনের মামলা হয়েছে ২১৭টি, সিএমপিতে ৩৭টি, কেএমপিতে ১৪টি, আরএমপিতে ১১টি, বিএমপিতে ১৮টি, এসএমপিতে ৯টি, আরপিএমপিতে ৪টি ও জিএমপিতে খুনের মামলা হয়েছে ৪১টি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ঘটনার সময় যদি অপরাধীরা মাদকাসক্ত থাকে, তবে তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চরম বর্বরতায় লিপ্ত হয়। এমন হত্যাকাণ্ডে সমাজে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আশপাশের মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। সামাজিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করাই এর সমাধান। র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, আমরা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছি কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখব, কীভাবে অপরাধ দমন করব, কীভাবে সাধারণ মানুষকে একটু স্বস্তিতে চলাফেরা করার সুযোগ দেব, যেন তারা ছিনতাইয়ের সম্মুখীন না হয়, চাঁদাবাজের সম্মুখীন না হয়, দস্যুতার সম্মুখীন না হয়, কোনো অপহরণ না ঘটে, এসব নিয়ে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমরা কাজ করছি। এই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার জন্য আমরা সবচেয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করছি।
























