- দুই ছাত্রসংসদেই শিবিরের নিরঙ্কুশ জয়
- ছাত্রদল, বাম ও জুলাই-ভিত্তিক সংগঠনগুলো কোণঠাসা
- রাজনৈতিক টকশোতেও ঝড় তুলছে এই নির্বাচন
‘একটি সংগঠনের একক আধিপত্যে নেতৃত্বের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে’- সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
‘ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কেউ জিতেছে, কেউ হেরেছে। তবে জুলাই তার নিজস্ব জায়গাতেই আছে’- আখতার হোসেন, সদস্য সচিব, এনসিপি
তিন দশকের বেশি সময় ধরে স্বাভাবিক রাজনীতির বাইরে ও নিষিদ্ধ থেকে একপ্রকার আড়ালে থাকা ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ফিরেছে বড় ধরনের চমক নিয়ে। এক সময়ের বিতর্কিত এই সংগঠন এখন শুধু ফিরে আসেনি বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু-জাকসু নির্বাচনে ভিপি, জিএসসহ বেশিরভাগ পদে বিজয়ী হয়ে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তাদের এই জয় শুধু সংগঠনের জন্যই নয়, ছাত্ররাজনীতির সামগ্রিক গতিপথের জন্যও একটি মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে শিবিরের এই উত্থানে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব অন্যদিকে সরে গেল গেল কিনা তা নিয়ে। বিশেষ করে ‘জুলাই আন্দোলন’-এর পর গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, বাম ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রদল-ঘরানার প্ল্যাটফর্মগুলো নেতৃত্বের প্রধান দাবিদার হিসেবে সামনে ছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে এই সংগঠনগুলোর প্রত্যাশিত ফল না আসায় অনেকেই অবাক হয়েছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টে গিয়ে কি নতুন কোনো বাস্তবতা তৈরি হলো কিনা তা নিয়েও ভাবছেন অনেক বিশ্লেষকরা।

জুলাই আন্দোলন নিয়ে শুরু থেকেই কৃতিত্বের দাবিতে মতবিরোধ ছিল। ইসলামী ছাত্রশিবির দাবি করে আসছিল যে, তারাই ছিল আন্দোলনের মূল সংগঠক ও চালক। আন্দোলনের সময় তাদের নেতাকর্মীরা রাজপথে সক্রিয় ছিলেন এবং নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন এই দাবিও তাদের পক্ষ থেকে ওঠে। ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে শিবির-ঘনিষ্ঠ সাদিক কায়েমকে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু অন্যদিকে, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সাদিক কায়েম বা শিবিরের ভূমিকা স্বীকার করতে নারাজ। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া স্পষ্ট ভাষায় বলেন, সাদিক কায়েম ছিলেন না কোনো সমন্বয়ক। এমনকি ‘জুলাই’ বিষয়ক লেখায় তার ছবি পর্যন্ত রাখা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে শিবিরপন্থীরা। তবে আন্দোলনে শিবিরের কিছু অংশগ্রহণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য এনসিপির নেতারাও স্বীকার করেছেন।
এদিকে, ডাকসু নির্বাচনে ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টি দখল করে নেয় শিবিরের প্যানেল। ভিপি, জিএস ও এজিএসÍতিনটি প্রধান পদেই তারা জয়লাভ করে। শিবিরের ভিপি প্রার্থী পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য ভোটের ব্যবধানে জয়, যেখানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল অনেক পিছিয়ে পড়ে। জি এস পদে বিজয়ী শিবিরের এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ১০,৭৯৪ ভোট। প্রতিরোধ পরিষদের মেঘমল্লার বসু পেয়েছেন ৪,৯৪৯ ভোট এবং ছাত্রদলের প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ৫,২৮৩ ভোট। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশীজন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আব্দুল কাদের ছিল ভোটের দৌড়ে পঞ্চম স্থানে। বাম সংগঠনগুলোর একমাত্র আলোচ্য প্রার্থী ছিলেন প্রতিরোধ পরিষদের মেঘমল্লার বসু।
অপরদিকে, ১১ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতে জয় পেয়েছে শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট। জিএস ও দুই এজিএসসহ অধিকাংশ পদ তাদের দখলে। শুধু ভিপি পদে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রশীদ জিতু। জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রদল ভোটগ্রহণের এক ঘণ্টা আগে নির্বাচন বর্জন করে। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং বাম সংগঠনগুলোর অবস্থান এখানে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়েরত ছাত্র সংসদেই শিবিরের এই নিরঙ্কুশ জয়কে ভোটের বাক্সে ইতিহাস বদলের রূপায়ন হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে, ডাকসু ও জাকসুতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই সাফল্য ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, আন্দোলনের নেতৃত্ব এখন নতুন করে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। কেউ বলছেন, জয়-পরাজয় দিয়েই নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় না। আবার অনেকে আশঙ্কা করছেন, নেতৃত্ব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে চলে যাচ্ছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি বলেও প্রশ্ন তুলেছেন বাম ঘরানার রাজনীতিবিদরা।
এদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, শিবিরের এই প্রত্যাবর্তন এবং বিজয় নিঃসন্দেহে ছাত্ররাজনীতির নতুন এক বাস্তবতা। তারা বলছেন, ডাকসু ও জাকসুর ফলাফল শুধু একটি নির্বাচনী জয়-পরাজয় নয়, বরং এটি ছাত্ররাজনীতির ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। তাদের মতে, শিবিরের এই উত্থান আকস্মিক নয়, বরং এটি ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতির একটি ফল। অন্যদিকে, বামপন্থী ও জুলাই আন্দোলনভিত্তিক সংগঠনগুলোর মাঝে সমন্বয়হীনতা, কৌশলগত দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনের সুযোগেই এই জায়গাটি তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে ছাত্রসমাজের রাজনৈতিক মেজাজে পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ সতর্ক করে দিচ্ছেন, এই জয়কে নেতৃত্বের একমাত্র মানদণ্ড ভাবলে ভুল হবে। বরং শিক্ষার্থীদের এই রায়ের পেছনে রয়েছে নতুন চাহিদা, সংগঠনের মাঠপর্যায়ের কাজ এবং আগামীর নেতৃত্ব নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন যার জবাব সময়ই দেবে বলছেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, নির্বাচনে যারা প্রতিযোগিতা করেছে তারা সবাই জুলাই আন্দোলনের অংশীজন। তবে নেতৃত্ব কোনো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে কিনা, সেটা বিবেচনা করা দরকার।
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ডাকসু নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য মনে করলেও জাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, একটি সংগঠনের একক আধিপত্যে নেতৃত্বের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কেউ জিতেছে, কেউহেরেছে। তবে জুলাই তার নিজস্ব জায়গাতেই আছে।
এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। নেতৃত্বের মূল্যায়ন ইশতেহার ও সাংগঠনিক কাজে নির্ভর করছে।

























