দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত রাজধানীর বেইলি রোডের শান্তিনগরের চামেলীবাগের নিজ বাসায় পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও মাকে হত্যার ঘটনায় দীর্ঘদিন ধরে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন ঐশী রহমান। প্রেমিককে নিয়ে বেপরোয়া হয়ে নিজের বাবা-মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন মাদকাসক্ত ঐশী। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিজ্ঞ আদালতের বিচারক তাকে যাবজ্জীবন সাজার রায় দিয়েছেন। অপরদিকে বরগুনার বহুল আলোচিত প্রকাশ্য দিবালোকে প্রেমিকদের সঙ্গে দিয়ে নৃশংসভাবে স্বামী রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। ওই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় বিজ্ঞ আদালতের বিচারক তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুধু দেশেই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। সময়ের ব্যবধানে দেশের পটপরিবর্তনে অনেকেই সেই আলোচিত ঘটনা ধীরে ধীরে ভলে যাচ্ছে। তাদের পরিবারের সদস্যরাও আগের মতো কারাবন্দী ঐশী ও মিন্নির খোঁজ-খবর রাখেন না। মাঝে মধ্যে ঐশী কারকার থেকেই ফোনে তার নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলেন। অপরদিকে মিন্নির খোঁজ-খবর রাখেন তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। বর্তমানে এভাবেই কাশিমপুর মহিলা কারাগারের অন্ধাকর প্রকোষ্ঠে একাকী জীবন কাটাচ্ছেন আলোচিত এ দুটি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ঐশী-মিন্নি। রায় শোনার পর থেকেই কারাগারের সেলে থাকা ঐশী একেবারেই নীরব হয়ে গেছেন। নিজের ভুলটি এখন অনুভব করছেন। অপরদিকে রায় শোনার পর থেকে কারাগারের কনডেম সেলে থাকা মিন্নি নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন তার বাবা। তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা উভয়েই কারাগারের সেলের ভেতর ভালোই রয়েছেন। অসুস্থ হলে কারা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীতে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা-মা হত্যাকাণ্ডে মেয়ে ঐশী রহমানের যাবজ্জীবন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট সকালে রাজধানীর বেইলি রোড সংলগ্ন শান্তিনগরের চামেলীবাগের নিজ বাসা থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের লাশ উদ্ধার করে পল্টন থানা পুলিশ। এর আগেই ওই দম্পতির কন্যা ঐশী বাসা থেকে পালিয়ে যান। ঐশী রহমানের বাবা ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। তার মা ছিলেন স্বপ্না রহমান। পরদিন ১৭ আগস্ট নিহত পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানের ভাই মশিউর রহমান এ ঘটনায় বাদী হয়ে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওইদিনই ঐশী পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে তার বাবা-মাকে খুন করার কথা জানান। ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ঐশী। পরে অবশ্য ওই জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সাক্ষ্য, আলামত ও অন্যান্য যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তা নাকচ করে দেন আদালত। বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ২০১৫ সালে ঐশীকে ফাঁসির আদেশ দেন বিচারিক আদালত। তার বন্ধু রনির দুই বছরের কারাদণ্ডারদেশ দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালতে ঐমীর পক্ষে আপিল করা হয়। ২০১৭ সালের ৬ জুন উচ্চ আদালত শুনানি শেষে ঐশীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। সেই থেকে ঐশী স্থায়ীভাবে কাশিমপুর মহিলা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কয়েদির পোশাকে আছেন। বর্তমানে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাশিমপুরের মহিলা কারাগারে অবস্থান করা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ঐশী রহমান একাকি জীবন কাটাচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ঐশী রহমান যখন তার বাবা-মাকে হত্যা করে, তখন তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন। বাসায় নেশা করার জন্যই ঐশী রহমান কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে এবং পরে কুপিয়ে হত্যা করেন বাবা-মাকে। তবে কারাগারে যাওয়ার পর পুরোপুরি বদলে গেছে আগের জীবন। রায়ের পর থেকে বলতে গেলে একদম নীরব হয়ে যান ঐশী রহমান। নিজের ভুল উপলব্ধি করলেও মাঝে মধ্যে বোবা কান্না করেন।
পরিবার থেকে কেউ সেভাবে আগের মতো ঐশী রহমানের খোঁজও রাখেননি। তবে মাঝে মধ্যে কারাগার থেকে ফোনে পরিবারের সঙ্গে ঐশী যোগাযোগ করেন বলে কারাসূত্রে জানা গেছে।
কারাগারের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিনই ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে ওঠেন ঐশী রহমান। তিনি ফজরের নামাজ দিয়ে দিন শুরু করেন। এরপর দৈনিক নিয়ম করে পত্রিকাও পড়েন। এছাড়াও নানা ধরনের বইপত্র পড়ে সময় কাটান এই তরুণী। কারাগারে মাঝে মধ্যে তাকে স্বনামধন্য লেখকদের বই উপন্যাস পড়তেও দেখেছেন কারারক্ষীরা।
কারাগারের ওই সূত্রটি আরও জানায়, কারাগারে ঐশী রহমান ভালো আছেন। সবসময় নীরব থাকেন। নামাজ-কালাম পড়ে সময় কাটে তার। এছাড়া কিছু বইপত্র পড়েন। পরিবারের কেউ খোঁজখবর নিতে আসে কি-না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, আমি এখানে দায়িত্বে আসার পর এখন পর্যন্ত তার পরিবারের কাউকে আসতে দেখিনি। তবে মাঝে মধ্যে কারাগার থেকে ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন ঐশী রহমান।

বরগুনায় স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে স্ত্রী মিন্নির মৃত্যুদণ্ড
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৬ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্থানীয় নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে একদল যুবক রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। ওইদিনই বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিফাত। এ ঘটনায় দায়ের মামলায় প্রধান আসামি করা হয় নয়ন বন্ডকে।
হামলার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, স্বামী রিফাত শরীফের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে দেশীয় ধারালো অস্ত্রধারী একদল দৃর্বৃত্ত। তখন হামলাকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা এবং চিৎকার করছেন স্ত্রী মিন্নি। ওই মামলায় মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হলেও পরে মামলার তদন্ত নাটকীয় মোড় নেয়। পুলিশের তদন্তে হামলাকারীদের মূল হোতা নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির পরকীয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। জিজ্ঞাসাবাদের পর স্বামী রিফাত শরীফ হত্যায় মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। পরে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বরগুনার আদালত মিন্নিসহ ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। এরপর থেকে মিন্নি কারাগারে বন্দী জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন মিন্নি। পরে তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেই জামিন আবেদনের শুনানি আর হয়নি। বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল আইনজীবীর মাধ্যমে বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় আবারও জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সৈয়দা নাসরিন, মো. শাহিনুজ্জামান ও নাজমুস সাকিব তুষ্টির মাধ্যমে দাখিল করা জামিন আবেদনে মিন্নি উল্লেখ করেছিলেন, তিনি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যার সঙ্গে জড়িত নন, বরং দুর্বৃত্তদের কবল থেকে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, সিরিয়ালে যখন আসবে, তখন মিন্নির জামিন আবেদনের শুনানি হবে।

দেশজুড়ে বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারের কনডেম সেলে (মাধবীলতা) বন্দী রয়েছেন। তবে কারাগারে তিনি ভালো নেই বলে দাবি করেছেন তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর।
তিনি বলেন, আমার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়ে বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন। তার শরীরের নানা ধরনের রোগ বাসা বেঁধেছে। এছাড়াও কারাগারে দেওয়া খাবার সে খেতে পারে না। প্রিজন ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খেতে গেলেও অনেক টাকা লাগছে। ওখানে একটি ডিমের দাম ৮০ টাকা, এক টুকরো পোল্ট্রি মুরগির মাংশের দাম দেড়শ টাকা, একটি ডাবের দাম দেড়শ টাকা। কারাগারে যার টাকা আছে সেই ভালো থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর।
কারাগারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাধবীলতা কনডেম সেলেই থাকেন স্বামী রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। তার সঙ্গে ওই সেলে থাকেন আরও দুইজন ফাঁসির আসামি। তেমন কোনো কাজ দেয়া হয় না তাদের। তাদের দিন কাটে কনডেম সেলে (নির্জন প্রকোষ্ঠে) শুয়ে, বসে গল্প-গুজর আর প্রার্থনা করে।
কাশিমপুর মহিলা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোছা. কাওয়ালিন নাহার জানান, কারাগারে মিন্নি ভালো আছেন। তিনি একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানোর সুযোগ নেই। অসুস্থ হলে কারা বিধি অনুযায়ী তাকে কারা হাসপাতালেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, কারাগারের প্রিজন ক্যান্টিনে খাবারের উচ্চমূল্য প্রসঙ্গে যে অভিযোগটি এসেছে তা সঠিক নয়। সেখানে একটি ডিমের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা। একশ্রেণির দুষ্টুলোক কারাগারের বিরুদ্ধে গুজব এবং প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। তবে কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বন্দীদের সুরক্ষায় কারা কর্তৃপক্ষ সর্বদা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে বলেও দাবি করেন কারাগারের এই কর্মকর্তা।


























