- ২০১৭ সালে ব্যয় প্রস্তাব ঠিক করে ২০১৯ সালে শুরু হয় নির্মাণযজ্ঞ
- সবশেষ ২ হাজার কোটি টাকা যুক্ত করায় ব্যয় বেড়ে ২৩ হাজার কোটিতে
- বেবিচক চিঠি দিলেও সাড়া দেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান
- উল্টো এক হ্জাার কোটি টাকা বকেয়া বিল দাবি
হযরত শাহজালাল (রাঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কার্গো ভিলেজ ব্যবহারে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আর্থিক খাতের লেনদেনসহ নানা সমস্যায় আটকে আছে বিমানবন্দরের আধুনিক ও নান্দনিক শিল্পকর্মে তৈরি করা থার্র্ড টার্মিনালের ব্যবহার কার্যক্রম। প্রথম ধাপে ২০১৭ সালে এর নির্মাণ ব্যয় প্রস্তাব ১৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করে পতিত সরকার। সে অনুযায়ী ২০১৯ সালে শুরু হয় থার্ড টার্মিনালের বিশাল কর্মযজ্ঞ। ২০২৪ সালে পুরোদমে যাত্রীসেবা দেয়ার কথা থাকলেও চালু হয়নি ঢাকা বিমানবন্দরের এ টার্মিনাল। উল্টো কাজ শেষ করতে না পারায় নতুন করে ব্যয়ের খাতায় যোগ হয় আরও ২ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ কাজে আসছে কিছু পরিবর্তন। ভিভিআইপি জোনসহ কয়েকটি স্থানের সাজসজ্জা ও নতুন সংযোজনে বাড়তি অর্থ দাবি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সবশেষ বাড়তি ২ হাজার টাকা ব্যয় বেড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে গত ১৮ অক্টোবর দুপুরে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি শাখায় ভয়াবহ আগুনে হাজার হাজার কোটি টাকার গুরুত্বপূর্ণ মালামাল পুড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ায় থার্ড টার্মিনাল ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনার সামনে আসে। নবনির্মিত থার্ড টার্মিনালের কার্গো ভিলেজ ব্যবহারে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিলেও সাড়া দেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উল্টো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম জানিয়েছে, বেবিচক কর্তৃপক্ষের কাছে হাজার কোটি টাকা বকেয়া বিল রয়েছে। তা পরিশোধ হলেও বেবিচককে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলমের মতে, যারা প্রকল্পের ব্যয় মূল্যায়ন করেছে, তারা কেন আগে থেকে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেনি; সেটি খুঁজে বের করতে হবে। যৌক্তিক পর্যায়ে না হলে ব্যয় বাড়ানো কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেছেন, নতুন যে অত্যাধুনিক ইমপোর্ট কার্গো ভবন (থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের অংশ) নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি এখনও চালু হয়নি অর্থনৈতিক জটিলতার কারণে। এ নিয়ে যৌথ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। দাবি-দাওয়ার পার্থক্য মিললেই চালু সম্ভভ। কর্তৃপক্ষ সেই চেষ্টা চালাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটের বিমান চলাচল ও যাত্রী সাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে বিগত শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলে ২০১৭ সালে হযরত শাহজালাল (রাঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক ও নান্দনিক শিল্পকর্মে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোহ নেওয়া হয়। তখন প্রাথমিকভাবে এর নির্মাণ ব্যয় প্রস্তাব নির্ধারণ করা হয় ১৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর ব্যয় বাড়িয়ে ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে ২০২২ সালে এর বেড়ে হয় ২১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সবশেষ ২ হাজার টাকা নতুন ব্যয় যোগ হলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচক কর্মকর্তারা জানান, প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা দিয়ে থাকে। তারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসও পরিচালনা করে। ইতোমধ্যেই সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের অধীনে একটি জাপানি কনসোর্টিয়ামকে তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বেবিচক সূত্র জানায়, বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে দুটি টার্মিনালে জায়গা রয়েছে ১ লাখ বর্গমিটারের কিছু বেশি। থার্ড টার্মিনাল চালু হলে এর সঙ্গে যুক্ত হবে আরও ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার স্থান। তিনতলা টার্মিনাল ভবনে থাকছে ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার, ৬৪টি ডিপারচার ও ৬৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন ডেস্ক। নিরাপত্তা নিশ্চিতে থাকবে ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৪০টি স্ক্যানিং মেশিন, ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১৬টি ক্যারোসেল ও ১১টি বডি স্ক্যানার। নান্দনিক এ টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। রানওয়েতে উড়োজাহাজের অপেক্ষা কমাতে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি হাইস্পিড ট্যাক্সিওয়ে। পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দুটি ভবন। একসঙ্গে ১ হাজার ৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবনের নির্মাণকাজ প্রায়ই শেষ। তৃতীয় টার্মিনালের মোট ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজের মধ্যে প্রথম ধাপে চালু হবে ১২টি। বহির্গমনের জন্য মোট ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টারের মধ্যে ১৫টি থাকবে সেলফ সার্ভিস চেক-ইন কাউন্টার। ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারও থাকবে। থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম এর পুরোদমে কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে। তবে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে উন্নয়নমূলক কাজের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর তড়িঘড়ি করে টার্মিনালটির আংশিক উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখনই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২০২৪ সালের অক্টোবরে থার্ড টার্মিনাল থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করা যাবে। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই তৃতীয় টার্মিনালের কাজ যথাসময়ে শেষ করা নিয়ে তৈরি হয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা। অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পর আবার থার্ড টার্মিনালের কাজ স্বাভাবিক গতিতে চলছে। সরকার মনে করছে, চলতি বছরই এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে পুরোদমে যাত্রীসেবা ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কার্যক্রম সচল হয়ে উঠবে।
এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় বাড়তে পারে আরও দুই হাজার কোটি টাকা। নান্দনিকতা ও নির্মাণ সামগ্রীর মান উন্নয়নে এই ব্যয় পরিশোধের তাগাদা দিয়েছে নির্মাণকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি স্বীকার করে মূলত ব্যয় কতটা, তা পর্যালোচনা করে সমন্বয়ের কথা জানিয়েছেন সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান। তবে ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গলদ খুঁজে বের করতে হবে।
এর আগে, ২০২৪ সালে পুরোদমে যাত্রীসেবা দেয়ার কথা থাকলেও এখনও চালু হয়নি অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন থার্ড টার্মিনাল। উল্টো কাজ শেষ করতে না পারায় নতুন করে ব্যয়ের খাতায় যোগ হতে যাচ্ছে আরও ২ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ কাজে আসছে কিছু পরিবর্তন। ভিভিআইপি জোনসহ কয়েকটি স্থানের সাজসজ্জা ও নতুন সংযোজনে বাড়তি অর্থ দাবি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম।
মূলত, বিশাল কর্মযজ্ঞের নানা অংশে ছিল অনিয়ম, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী। এমন ৫ শতাধিক ভেরিয়েশনের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা জানিয়েছে সিভিল এভিয়েশন। বলা হয়, কাজের পাশাপাশি দুর্নীতি খতিয়ে দেখছে দুদক।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, যারা প্রকল্পের ব্যয় মূল্যায়ন করেছে, তারা কেন আগে থেকে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেনি; সেটি খুঁজে বের করতে হবে। তবে ব্যয় বাড়লেও সেটি যৌক্তিক পর্যায়ে হতে হবে। ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়।
এদিকে গত ১৮ অক্টোবর বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর তা দ্রুত সচল করা সম্ভব নয়, এমন আশঙ্কা থেকেই থার্ড টার্মিনালে নির্মিত কার্গো ভিলেজ চালু করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় বেবিচক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেবিচকের কাছে উল্টো হাজার কোটি টাকার বকেয়া বিল চেয়ে বসছে। অন্যথায় তারা টার্মিনালটি বেবিচককে বুঝিয়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাবদ এক হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে বলে দাবি করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম। তবে এই টাকার অঙ্কে আপত্তি জানিয়েছে বেবিচক। এমন পরিস্থিতিতে টাকার অঙ্কের এ গরমিলের কারণে চালু করা যাচ্ছে না থার্ড টার্মিনালের কার্গো ভিলেজ।
গত ২১ অক্টোবর বেবিচক সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নতুন যে অত্যাধুনিক ইমপোর্ট কার্গো ভবন (থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের অংশ) নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি এখনও চালু হয়নি অর্থনৈতিক জটিলতার কারণে। এই ভবন চালু হলে আগুন লাগলে আমরা বাসা থেকেও মনিটর করতে পারতাম। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক গ্যাপ রয়ে গেছে হাজার কোটি টাকার বেশি। আমরা সেই গ্যাপ পূরণে দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে একটি যৌথ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সরকারি টাকা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি-দাওয়ার মধ্যে পার্থক্য মিটলেই নতুন এ কার্গো ভবনটি হস্তান্তর ও চালু করা হবে। আমরা সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
এর আগে বেবিচক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই থার্ড টার্মিনালটির কাজে যেসব অনিয়ম করা হয়েছে ও যেসব কাজ বাকি রয়েছে সেগুলোর জটিলতা নিরসনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসে ঠিক করা হচ্ছে। কাজের পাশাপাশি দুদক তাদের কাজ করছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব টার্মিনালটি চালু করার চেষ্টা চলছে।
























