- আ.লীগ সরকার পতনের পর প্রথম মামলা হয় ১১ আগস্ট
- ডিএমপি’র ৫০ থানায় মোট মামলা রুজু হয় ৭২৯টি
- এখনও অনেক আসামি প্রকাশ্যে ঘুরছে, অনেকেই আত্মগোপনে
- গেল ১৪ মাসে চার্জশিট হয়নি একটি মামলারও
‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যথাযথ আইন প্রয়োগ না হলে, চার্জশিট প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা হবেই’
– ড. তৌহিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাবি
‘অস্থায়ী চার্জশিটের কারণে একদিকে মানুষের হয়রানি ও ভোগান্তি বাড়ার শঙ্কা বাড়ছে, অপরদিকে তদন্ত কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের প্রতি মনোযোগ বেশি থাকে’
– আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এরপরই গত বছরের ২৮ নভেম্বর কবির নামে এক ব্যক্তি রাজধানীর পল্লবী থানার বাইতুন নুর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিনের কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। কিন্তু চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় কবির তাকে মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে চলে যান। ওই দিনই খিলগাঁও থানায় কবিরের বিরুদ্ধে জিডি করেন ভুক্তভোগী হেলাল উদ্দিন। পরে যাত্রাবাড়ী থানার একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হেলালকে আসামি করেন কবির। গত ৭ সেপ্টেম্বর এ মামলায় হেলাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন ৮ সেপ্টেম্বর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এখনও তিনি কারাগারে রয়েছেন। আবার অনেকে জুলাই আন্দোলনে দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হয়েও ভোল পাল্টে বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় নিজ নিজ এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করছে না। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ১১ আগস্ট প্রথম মামলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে রাজধানীর ৫০টি থানায় মোট মামলা রুজু করা হয় ৭২৯টি। গেল ১৪ মাসে মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা একটি মামলারও চূড়ান্ত অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি। এভাবেই চলছে মামলার তদন্ত ও প্রতিবেদন দাখিল কার্যক্রম। এতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে ন্যায়বিচারের আশায় দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হকের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যথাযথ আইন প্রয়োগ না হলে, চার্জশিট প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা হবেই। রাষ্টপক্ষের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলছেন, জুলাই আন্দোলনের মামলাগুলোর মধ্যে ১৫টির মতো চার্জশিট তৈরি হয়েছে। শিগগিরই আপনারা সেটি দেখতে পারবেন। তদন্তকাজে কোনও দেরি বা গাফিলতি নেই। তবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলামের মতে, অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদন বিষয়টি শুনতে ভালো মনে হলেও এর ভেতরে অনেক ফাঁকফোকর আছে। অস্থায়ী চার্জশিটের কারণে একদিকে মানুষের হয়রানি ও ভোগান্তি বাড়ার শঙ্কা বাড়ছে, অপরদিকে তদন্ত কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের প্রতি মনোযোগ বেশি থাকে। চার্জশিট প্রদানের জন্য পুলিশকে সময় বেঁধে দেওয়া উচিত ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে চলে যায় সাবেক সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সরকারি আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মাঠপর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা। পরে মাঠে ফিরে আসে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ফ্যাসিবাদের তকমা লাগিয়ে একের পর নিরীহ ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে আটকে রেখে মামলার ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণের মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়। চালানো হয় ব্যাপক নির্যাতন। গত ৬ জানুয়ারি রাত ৯টায় ব্যবসায়ীক কাজে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে যান ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। তখন কামরাঙ্গীর চর থানা বিএনপি নেতা হাজী রশিদ ও তার ছেলে রকির নেতৃত্বে নিউ মার্কেট থানা যুবদল নেতা সুজন, আশিফ, বুনিয়াদি সুমন, শাহআলম, সেলিম, কাউসার, সোহেল রানা ও চঞ্চলসহ প্রায় ২০ জন দুর্বৃত্ত তাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে প্রথমে ধানমন্ডিকে নিয়ে যায়। এরপর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান ও সুবাস্তু অর্কেডে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে খবর পেয়ে কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি তদন্ত ও এসআই হারুন গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে কামরাঙ্গীর চর ৩১ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। পরবর্তীতে বিএনপি নেতাদের নির্দেশে একটি মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠায়। ওই মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার শর্তে থানার ওসি আমিরুল ইসলাম কয়েক দফায় দেড় লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে গত ১০ জুন বিকেলে খিলক্ষেত থানাধীন উত্তর নামাপাড়া বোটঘাট এলাকার ক ২২৮/৬/১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা চাকরিজীবি মোহাম্মদ সহিদুল ইসলামের ফ্ল্যাটে মব সৃষ্টি করে হামলা, মারধর ও লুটপাট চালিয়েছে খিলক্ষেত ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার ডাকাতি মামলার অভিযুক্ত আসামি শিমুলের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আফজাল হোসেন মুক্তার, খালেক, জাহাঙ্গীর ও ইসমাইলসহ ২০ জন যুবক। ঘটনার দিন দুর্বৃত্তরা ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিলে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এরপর প্রাণভয়ে ৫ লাখ টাকা দিতে রাজি হন ভুক্তভোগীর পরিবার। এ সময় ঘর থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা লুটে নেয়। একই সঙ্গে ফ্ল্যাটের ২টি সিসিটিভি ও ডিভিআর খুলে লুটে নিয়ে যায়। এরপর বাকি টাকার জন্য ঘরে থাকা এটিএম কার্ডসহ তাদের গার্ড দিয়ে স্থানীয় একটি বুথে নিয়ে আরও ৫০ হাজার টাকা তুলে নেয়। পরে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক প্রাইম ব্যাংকের বাকি ৪ লাখ টাকার একটি চেক (চেক নম্বর-৪৬০৯৬৮৩) লিখিয়ে নিয়েছে। পরবর্তীতে ১০০ টাকা মূল্যমানের পরপর ৩টি সাদা স্ট্যাম্পে পাথর ক্রয় বাবদ পাওনা টাকা উল্লেখ করে জোরপূর্বক সই নিয়ে অন্যান্য মালামাল লুটপাট চালিয়ে সন্ধ্যার আগেই পালিয়ে যায়। ঘটনার সময় সিসিটিভি ভেঙে ফেলায় কোন প্রমাণ না থাকায় গৃহকর্ত্রী কৌশলে মোবাইলে ১ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ ধারণ করেন। মব সৃষ্টি করে তল্লাশি ও লুটপাটের এমন একটি ভিডিও ভাইরালও হয়েছে। ঘটনার পরপরই তারা বিষয়টি খিলক্ষেত থানা পুলিশ ও স্থানীয় পূর্বাচল সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে ১১ জুন রাতে পুলিশ তলব করলে তারা থানায় গিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই আজিজ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ভিডিও ক্লিপের সূত্র ধরে গত ১৯ জুন দিবাগত মধ্যরাতে সন্দেহভাজন মব সৃষ্টিকারী আফজাল হোসেন মুক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিদেরও ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে। তবে এ ঘটনার ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্তরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ কাউকেই গ্রেপ্তার না করায় ভুক্তভোগীর পরিবার ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। এদিকে চাঁদাবাজি ও হামলার ঘটনায় গত বছরের ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর আদালতের নির্দেশে কামরাঙ্গীরচর থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. আলী আহাম্মদ ও মো. সগির আহমেদ সুজন। ওই মামলায় আসামি করা হয় সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ডিএসসিসি’র সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন, পারভেজ হোসেন বিপ্লব, কবির, ময়লা জয়নাল, মশিউর, লালচাঁন সুমন, জাবেদুল ইসলাম জাবেদ, তাইজুদ্দিন আহমেদ রনি ও সিরাজ তালুকদারসহ ১৪ জনকে। এছাড়া ধানমন্ডি থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য মামলা নং ৩ (২/৩/২০২৫)। আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অ্যাডভোকেট কামরুল, আমিনুল জামাল দেওয়ান, নুর হোসেন বেপারী, ময়লা জয়নাল, মশিউরসহ ১০০ জনের বিরুদ্ধে। যাত্রাবাড়ী থানার বিস্ফোরক দ্রব্য মামলা নং ১০৫ (২৬/৩/২০২৫)। এ মামলায় ১৫৫ নম্বর আসামি কামরাঙ্গীরচরের ইদ্রিস ওরফে কাঠ ইদ্রিস, ১৫৭ নম্বর আসামি মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ মোল্লা, ১৫৮ আসামি নাজির হোসেন রঞ্জু ওরফে কাঠ নাজির। লালবাগ থানার মামলা নং ৩২১/২০২৪। আসামি হলেন- সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ হোসেন, ক্যাডার পারভেজ হোসেন বিপ্লব,, শিমুল মাদবর, রহমান, ইয়ামিন, মহিউদ্দিন, শরাফত কাজী, কালা আলী, মাহবুবুল হক রনি ও ফয়সালসহ আরও অনেকে। এদের মধ্যে শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করলেও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন এড. কামরুল ইসলাম। বাকি আসামিরা সাভার, আমিনবাজার, গাবতলী, গাজীপুরের টঙ্গীর আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা, তুরাগ, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ, ভোলা ও বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন জেলায় আত্মগোপনে থেকে মাঝেমধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জোটবদ্ধ হয়ে ঝটিকা মিছিল করে সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে আবার পালিয়ে যাচ্ছেন। খিলক্ষেত থানার মামলা নং ডাকাতি মামলা নং ২০ (১০/১১/২০০৭ই ্১৬ (১৬/১/২০০৮) মনিরুজ্জামান শিমুল, খিলক্ষেত থানার মব সৃষ্টি মামলা নং ৫ (১৩ /৬/২০২৫ আসামি আফজাল হোসেন মুক্তার গ্রেপ্তার হলেও মূল পরিকল্পনাকারী মনিরুজ্জামান শিমুল, মির্জা ফখরুলের ছোট ভাই মির্জা ফয়সাল এর পিএস পরিচয়ধারী খালেক, ইসমাইল ও জাহাঙ্গীর এবং বংশালের আবদুল্লা আল নেহাল ও চাঁনখারপুলের শাকিলসহ অন্যান্য আসামিরা এখনও প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। পুলিশের দৃষ্টিতে তারা এখনও পলাতক। এছাড়া, শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জয়নগর ইউনিয়ন রাকিবুল হাসান নাগিব মোল্লা, গোপালপুর ইউনিয়নের ছানোয়ার মাদবর, সাবেক চেয়ারম্যানের সহযোগী আসাদ হাওলাদার, দিলু মেম্বার, সেনেরচর ইউনিয়নের মনির বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে নারায়ণগঞ্জের গুতিয়াব মৌজায় গড়ে তোলা সী-শেল পার্কের মূল কর্ণধার কুখ্যাত ভূমিদস্যু ও মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত আমান উল্লাহর নেতৃত্বে অতিসম্প্রতি মেজর সাদেক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পতিত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী সী-শেল পার্কের ৫ তলা ভবন বিশিষ্ট আবাসিক হোটেলে অবস্থান নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পতনসহ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরবর্তীতে সেনা সদর দপ্তর মেজর সাদেককে সাময়িক বরখাস্তসহ এ ঘটনায় তদন্ত আদালত গঠন করেছে। বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগের দোসরখ্যাত আমান উল্লাহ ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা, হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে রাজধানীর বাড্ডাসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত ৬টি মামলা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গ্রেপ্তার এড়াতে ব্যবসায়ীক অজুহাতে বিদেশে আত্মগোপনে রয়েছেন আহমেদ আবর সোবহান ও সায়েম সোবহান আনভীর। তবে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর জুলাই গণহত্যা মামলার অন্যতম আসামি আমান উল্লাহ নিজেকে এখন বিএনপি-জামায়াতের সহচর দাবি করে গ্রেপ্তার এড়াতে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মাস্টারমাইন্ড আমান উল্লাহ এখন তার প্রধান অফিস রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের ১১৩/বি নম্বর হোল্ডিংস্থ উত্তরা সী-শেল রেষ্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি প্যালেসে অফিস করেন ও বসেন। সেখানেও রয়েছে তার সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। তবে অদৃশ্য কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে জুলাই আন্দোলনে হামলা, হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার বা আইনের আওতায় না আনায় তদন্ত কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠছে।
ঢাকা মহানগরের আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন বলেন, জুলাই আন্দোলনের মামলায় দেরিতে চার্জশিট দাখিলের সুযোগে অনেকে মামলা-বাণিজ্য করছে। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত শত্রুতার সুযোগ নিয়ে অনেককে জুলাই আন্দোলনের মামলায় আসামি করা হচ্ছে। চার্জশিট দিতে দেরি হওয়ায়, কেউ কেউ অপরাধী না হয়েও জেল খাটছেন। আবার যাদের নাম এজাহারে যুক্ত করা হয়েছে, তারাও আতঙ্কে আছেন। এর ফলে তারা পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম মামলাটি হয় ১১ আগস্ট। এরপর গত ১৪ মাসে রাজধানীর ৫০ থানায় মোট মামলা হয়েছে ৭২৯টি। কিন্তু একটি মামলারও চূড়ান্ত চার্জশিট এখনও আদালতে দাখিল করা হয়নি। তবে গত বছরের ২২ অক্টোবর জুলাই আন্দোলন-সংক্রান্ত গুলশান থানার একটি মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের নারাজির কারণে সেই মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ফলে ওই চার্জশিট কার্যকারিতা হারায়। দিকে গত ৯ সেপ্টেম্বর সাধারণ মানুষের হয়রানি রোধে অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদনের জন্য পরিপত্র জারি করে সরকার। সূত্র বলছে, এরপর আদালতে ৭২টি মামলার অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এসব মামলায় ৩৭৩ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
চার্জশিট বিলম্বের কারণ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, জুলাই আন্দোলনের মামলাগুলোর মধ্যে ১৫টির মতো চার্জশিট তৈরি হয়েছে। তদন্তকাজে কোনও দেরি বা গাফিলতি হচ্ছে না।
রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী শামসুদ্দোহা সুমন বলেন, গুলশান থানার একটি মামলায় সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে একটি চার্জশিট আদালতে এসেছিল। চার্জগঠনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা নারাজি দিয়েছি। পরে আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি ফেরত পাঠান। এছাড়া আর কোনও চার্জশিট আমরা পাইনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হকের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যথাযথ আইন প্রয়োগ না হলে, চার্জশিট প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা হবেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদন বিষয়টি শুনতে ভালো মনে হলেও এর ভেতরে অনেক ফাঁকফোকর আছে। অস্থায়ী চার্জশিটের কারণে একদিকে মানুষের হয়রানি ও ভোগান্তি বাড়ার শঙ্কা বাড়ছে, অপরদিকে তদন্ত কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের প্রতি মনোযোগ বেশি থাকে। চার্জশিট প্রদানের জন্য পুলিশকে সময় বেঁধে দেওয়া উচিত ছিল।

























