০৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আইনি পথেই হাঁটছে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন

  • চলতি সপ্তাহের মধ্যে দলগুলো ঐকমত্যে না এলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে
  • আদেশ জারির প্রস্তুতি নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ
  • ঐকমত্যে জনগণের মতামত নিতে হবে, মালিক হওয়ার চেষ্টা করবেন না: আমীর খসরু
  • গণভোট নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী নয় বিএনপি: হামিদুর রহমান

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও সময় নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নাই। বিএনপিসহ সমমনা জোট তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে যেমন সরে এসেছে ঠিক তেমনই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট চাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবীতে ইতিমধ্যে আন্দোলণ শুরু করেছে। অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর গত ১৭ অক্টোবর বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে কেউ খুব বেশী অবাক হয় নাই। কিন্তু অবাকের বিষয় হচ্ছে, ২৪- এর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তারা যখন স্বাক্ষর করলো না। বিষয়টা অস্বাভাবিক বলে মনে করছে অনেকেই।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও তার পরবর্তী গণভোট আয়োজনের দাবিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে রাজপথে নানা কর্মসূচী পালন হচ্ছে। এ দাবিকে সামনে রেখে রাজনীতিতে সরব ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)ও এই বিষয়ে সরব। এই দুই রাজনৈতিক দল ঘোষণা দিয়েছে, তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি এবং এরপর গণভোট আয়োজন না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসবে না। এদিকে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দলগুলোর এমন বিভেদ চলতে থাকলে আগামী দিনে জাতীয় নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়বে সরকারের জন্য। এমনটি যাতে না হয়, সে জন্য দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন প্রধান উপদেষ্টা। চলতি সপ্তাহের মধ্যে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না এলে সরকারকেই নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তখন আদেশ জারির ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর দুটি সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপরই গণভোট এবং নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) ইস্যুতে বিপরীত অবস্থানে চলে যায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এমন অবস্থায় ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক হয়। যেখানে দলগুলোকে আলোচনা করে সাত দিনের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে অনুরোধ জানানো হয়। এরই মধ্যে পাঁচ দিন কেটে গেছে, কিন্তু দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় বসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আলোচনার জন্য জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি তাতে। ঐকমত্যে জনগণের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, সেসব বিষয়ে অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে, নিজে মালিক হওয়ার চেষ্টা করবেন না’। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ট্রেইস কনসাল্টিং নামের একটি সংস্থার আয়োজনে জনতার ইশতেহার শিরোনামের আলোচনাসভায় এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি যেটা চিন্তা করছি সেটা ঐকমত্যের বাইরে গেলেও করতে হবে-কিছু রাজনৈতিক দলের এই মানসিকতা গ্রহণযোগ্য নয়। ঐকমত্যের বিষয়ে আমীর খসরু বলেন, ‘ঐকমত্যে যতটুকু হয়েছে এর বাইরে গিয়ে বাস্তবায়নের জন্য কারো বা কোনো দলের চাপ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব করে একটা বিভক্তির দিকে নেওয়া হচ্ছে। বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি সেসবের বিষয়ে অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে, নিজে মালিক হওয়ার চেষ্টা করবেন না। কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এসব করতে হলে জনগণের রায় নিয়ে আসুন। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদে পাস হওয়ার আগে গণভোটের কোনো সুযোগ নেই। এটা সম্ভব নয়। সংবিধানে এমন বিধান নেই। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা একেবারে দূর করবে। দপ্তরে দপ্তরে ফিজিক্যালি যেন না দৌড়াতে হয় সে ব্যবস্থা করা হবে। ঘরে বসেই ট্রেড লাইসেন্সসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজ সমাধান করার ব্যবস্থা করা হবে। সব ক্ষেত্রে ডি-রেগুলেশন করা হবে। বেসরকারি খাতকে বিকশিত করা হবে।’ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে বিএনপি। গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে এক সংলাপে অংশ নিয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, গণভোট নিয়ে আলোচনায় বসতে তারা প্রস্তুত, কিন্তু বিএনপি এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আজাদ বলেন, ‘আমরা বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। তারা জানিয়েছে, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। আমরা যেকোনো সময় আলোচনা করতে রাজি আছি। প্রয়োজনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও আলোচনায় বসতে উদ্বুদ্ধ করবো। জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, কিন্তু কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে সেটি এখনো নির্ধারিত হয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যখন সরকারের কাছে সুপারিশ দেয়, তখনই সেখানে বিরোধ তৈরি হয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংলাপ ও জনমত প্রকাশ- দুটোকেই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডেমোক্রেসিতে আলোচনা এবং রাজপথে ভয়েস রেইস করা- এই দুটোই চলে। আমরা তো কোনো ভায়োলেন্স করছি না। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবের বিরোধিতা জানিয়ে আজাদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ফোকাস থাকে দল ও প্রার্থীকে ঘিরে। আমাদের দেশে ভোটকেন্দ্র দখলের প্রবণতা আছে। একই দিনে দুটি ভোট দিতে গেলে সময় ব্যবস্থাপনা হবে না, ভোট কাস্টিং কমে যাবে। পরে আবার বলা হবে, জনগণ জুলাই চার্টারের পক্ষে রায় দেয়নি। ফ্যাসিবাদী আমলের প্রশাসন এখনো রয়ে গেছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হয়নি। তাই আগে গণভোট হলে জনগণের আস্থা তৈরি হবে, এরপর জাতীয় নির্বাচন আরও গ্রহণযোগ্য হবে। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ মতের জন্য অপেক্ষার পাশাপাশি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির প্রস্তুতিও চলছে সরকারের ভেতরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে এবং আদেশ জারির বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের দ্বিতীয় প্রস্তাবের আলোকে সরকার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ২৭০ দিনের স্থলে যত দিন লাগে, তত দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করার কথা বলা থাকতে পারে। একই সঙ্গে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব ছাড়া বাকি প্রস্তাবগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিল পাস করবে। এক সংবাদ সম্মেলনে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, দলগুলোকে আলোচনার জন্য সাত দিনের কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সিদ্ধান্ত দিতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সে সিদ্ধান্তের জন্য প্রস্তুতিমূলক অনেক বৈঠক হচ্ছে। তারা (উপদেষ্টা পরিষদ) আশা করে, দলগুলো নিজেরা নিজেরা এই পুরো বিষয়গুলো নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসবে। পুরো জাতি এখন নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে আছে। সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ ঘোষিত সাত দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত না দিলে চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে সব দল নিয়ে বৈঠক করার চিন্তাভাবনা করছেন প্রধান উপদেষ্টা। কারণ, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ পরিকর। সে অনুযায়ী ডিসেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণার চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সমাধান ধীরগতি হলে তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের বিষয়ে সমঝোতার জন্য আলোচনায় বসতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ফোন করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গতকাল শুক্রবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়নি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত ছয় দল এবং এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেছে এনসিপি। সেখানে বাস্তবায়ন ইস্যুতে দলগুলো এক থাকবে বলে জানা গেছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, ‘কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে। তারপরও সরকারের অনুরোধে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা মনে করি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। সিদ্ধান্ত সরকারের কাছে।’

 

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

আইনি পথেই হাঁটছে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন

আপডেট সময় : ০৭:১১:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৫
  • চলতি সপ্তাহের মধ্যে দলগুলো ঐকমত্যে না এলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে
  • আদেশ জারির প্রস্তুতি নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ
  • ঐকমত্যে জনগণের মতামত নিতে হবে, মালিক হওয়ার চেষ্টা করবেন না: আমীর খসরু
  • গণভোট নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী নয় বিএনপি: হামিদুর রহমান

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও সময় নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নাই। বিএনপিসহ সমমনা জোট তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে যেমন সরে এসেছে ঠিক তেমনই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট চাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবীতে ইতিমধ্যে আন্দোলণ শুরু করেছে। অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর গত ১৭ অক্টোবর বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে কেউ খুব বেশী অবাক হয় নাই। কিন্তু অবাকের বিষয় হচ্ছে, ২৪- এর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তারা যখন স্বাক্ষর করলো না। বিষয়টা অস্বাভাবিক বলে মনে করছে অনেকেই।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও তার পরবর্তী গণভোট আয়োজনের দাবিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে রাজপথে নানা কর্মসূচী পালন হচ্ছে। এ দাবিকে সামনে রেখে রাজনীতিতে সরব ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)ও এই বিষয়ে সরব। এই দুই রাজনৈতিক দল ঘোষণা দিয়েছে, তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি এবং এরপর গণভোট আয়োজন না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসবে না। এদিকে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দলগুলোর এমন বিভেদ চলতে থাকলে আগামী দিনে জাতীয় নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়বে সরকারের জন্য। এমনটি যাতে না হয়, সে জন্য দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন প্রধান উপদেষ্টা। চলতি সপ্তাহের মধ্যে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না এলে সরকারকেই নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তখন আদেশ জারির ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর দুটি সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপরই গণভোট এবং নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) ইস্যুতে বিপরীত অবস্থানে চলে যায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এমন অবস্থায় ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক হয়। যেখানে দলগুলোকে আলোচনা করে সাত দিনের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে অনুরোধ জানানো হয়। এরই মধ্যে পাঁচ দিন কেটে গেছে, কিন্তু দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় বসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আলোচনার জন্য জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি তাতে। ঐকমত্যে জনগণের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, সেসব বিষয়ে অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে, নিজে মালিক হওয়ার চেষ্টা করবেন না’। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ট্রেইস কনসাল্টিং নামের একটি সংস্থার আয়োজনে জনতার ইশতেহার শিরোনামের আলোচনাসভায় এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি যেটা চিন্তা করছি সেটা ঐকমত্যের বাইরে গেলেও করতে হবে-কিছু রাজনৈতিক দলের এই মানসিকতা গ্রহণযোগ্য নয়। ঐকমত্যের বিষয়ে আমীর খসরু বলেন, ‘ঐকমত্যে যতটুকু হয়েছে এর বাইরে গিয়ে বাস্তবায়নের জন্য কারো বা কোনো দলের চাপ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব করে একটা বিভক্তির দিকে নেওয়া হচ্ছে। বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি সেসবের বিষয়ে অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে, নিজে মালিক হওয়ার চেষ্টা করবেন না। কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এসব করতে হলে জনগণের রায় নিয়ে আসুন। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদে পাস হওয়ার আগে গণভোটের কোনো সুযোগ নেই। এটা সম্ভব নয়। সংবিধানে এমন বিধান নেই। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা একেবারে দূর করবে। দপ্তরে দপ্তরে ফিজিক্যালি যেন না দৌড়াতে হয় সে ব্যবস্থা করা হবে। ঘরে বসেই ট্রেড লাইসেন্সসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজ সমাধান করার ব্যবস্থা করা হবে। সব ক্ষেত্রে ডি-রেগুলেশন করা হবে। বেসরকারি খাতকে বিকশিত করা হবে।’ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে বিএনপি। গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে এক সংলাপে অংশ নিয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, গণভোট নিয়ে আলোচনায় বসতে তারা প্রস্তুত, কিন্তু বিএনপি এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আজাদ বলেন, ‘আমরা বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। তারা জানিয়েছে, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। আমরা যেকোনো সময় আলোচনা করতে রাজি আছি। প্রয়োজনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও আলোচনায় বসতে উদ্বুদ্ধ করবো। জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, কিন্তু কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে সেটি এখনো নির্ধারিত হয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যখন সরকারের কাছে সুপারিশ দেয়, তখনই সেখানে বিরোধ তৈরি হয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংলাপ ও জনমত প্রকাশ- দুটোকেই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডেমোক্রেসিতে আলোচনা এবং রাজপথে ভয়েস রেইস করা- এই দুটোই চলে। আমরা তো কোনো ভায়োলেন্স করছি না। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবের বিরোধিতা জানিয়ে আজাদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ফোকাস থাকে দল ও প্রার্থীকে ঘিরে। আমাদের দেশে ভোটকেন্দ্র দখলের প্রবণতা আছে। একই দিনে দুটি ভোট দিতে গেলে সময় ব্যবস্থাপনা হবে না, ভোট কাস্টিং কমে যাবে। পরে আবার বলা হবে, জনগণ জুলাই চার্টারের পক্ষে রায় দেয়নি। ফ্যাসিবাদী আমলের প্রশাসন এখনো রয়ে গেছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হয়নি। তাই আগে গণভোট হলে জনগণের আস্থা তৈরি হবে, এরপর জাতীয় নির্বাচন আরও গ্রহণযোগ্য হবে। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ মতের জন্য অপেক্ষার পাশাপাশি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির প্রস্তুতিও চলছে সরকারের ভেতরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে এবং আদেশ জারির বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের দ্বিতীয় প্রস্তাবের আলোকে সরকার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ২৭০ দিনের স্থলে যত দিন লাগে, তত দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করার কথা বলা থাকতে পারে। একই সঙ্গে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব ছাড়া বাকি প্রস্তাবগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিল পাস করবে। এক সংবাদ সম্মেলনে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, দলগুলোকে আলোচনার জন্য সাত দিনের কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সিদ্ধান্ত দিতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সে সিদ্ধান্তের জন্য প্রস্তুতিমূলক অনেক বৈঠক হচ্ছে। তারা (উপদেষ্টা পরিষদ) আশা করে, দলগুলো নিজেরা নিজেরা এই পুরো বিষয়গুলো নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসবে। পুরো জাতি এখন নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে আছে। সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ ঘোষিত সাত দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত না দিলে চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে সব দল নিয়ে বৈঠক করার চিন্তাভাবনা করছেন প্রধান উপদেষ্টা। কারণ, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ পরিকর। সে অনুযায়ী ডিসেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণার চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সমাধান ধীরগতি হলে তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের বিষয়ে সমঝোতার জন্য আলোচনায় বসতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ফোন করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গতকাল শুক্রবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়নি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত ছয় দল এবং এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেছে এনসিপি। সেখানে বাস্তবায়ন ইস্যুতে দলগুলো এক থাকবে বলে জানা গেছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, ‘কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে। তারপরও সরকারের অনুরোধে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা মনে করি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। সিদ্ধান্ত সরকারের কাছে।’