রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার শিলমারী ইউনিয়নের সাধনপুরে বাংলা একাডেমির সাবেক কর্মকর্তা আবদুল মজিদ ১৯৭৮ সালে ২৫ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠা করেন পঙ্গু শিশু নিকেতন। পরে ৬০ বিঘায় উন্নীত করেন। পরবর্তীতে এখানে পঙ্গুদের জন্য গড়ে তোলা হয় গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, পঙ্গু শিশু নিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডিগ্রি কলেজ, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, অন্ধ শিক্ষা কার্যক্রম, পঙ্গু শিশুদের আবাসস্থল, বৃদ্ধাশ্রম ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়াও এখানে রয়েছে পঙ্গু শিশুদের জন্য ফিজিও থেরাপি ও ইলেকট্রো থেরাপির ব্যবস্থা। চিকিৎসার জন্য রয়েছেন চিকিৎসক।
সরকারী কোন সহযোগিতা না থাকায় বর্তমানে পঙ্গু ও আশ্রমের বৃদ্ধাদের নিয়ে বিভিন্ন সঙ্কটে ধুঁকছে পঙ্গু শিশু নিকেতনটি। এখানে পঙ্গু শিক্ষার্থী, অসহায় বৃদ্ধদের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও খাবার, শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশি খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। এখানে কায়েক বছর আগেও ৭০-৮০ জন পঙ্গুর শিক্ষার্থী থাকলেও নানান সঙ্কটের কারণে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ২০ জন পঙ্গু শিক্ষার্থী।
এছাড়াও পঙ্গু শিশু নিকেতনটিতে অবৈতনিক ডিগ্রি কলেজটি ১৯৯৫ ইং সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে সাধারণ অত্যন্ত গরীব প্রকৃতির হওয়ায়
মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর অন্য কোথাও দূরে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা আর্থিক কারনে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। এছাড়া পঙ্গু ছেলেমেয়েদের দিকে বিবেচনা করে অত্র এলাকার উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করতে পঙ্গু শিশু নিকেতন সমম্বিত অবৈতনিক ডিগ্রি কলেজটি স্থাপিত হয় ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এখানকার পঙ্গু শিক্ষার্থীরা বিনা খরচে আবাসন, খাবার ও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। একই সাথে তারা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অপরদিকে, পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার, নির্যাতন অথবা আশ্রয়হীন এমন ১০জন বয়স্ক নারী-পুরুষ থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে। তবে কর্তৃপক্ষের আর্থিক
সঙ্কটের কারণে কোনোমতে পঙ্গু শিক্ষার্থী ও বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোর থাকা, খাওয়া ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর বৈদেশিক ও সরকারি সহায়তা পেলেও ২০১৪ সাল থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ। ট্রাস্টের আবাদি জমি, পুকুর ও
আমবাগান ইজারার আয়ে কোনোভাবে চলে কার্যক্রম। প্রতিবছর ব্যয় হয় অন্তত ১৩ লাখ টাকা। তবে উৎস থেকে আসা আয়ে ব্যয়ের টাকায় ঘাটতি
থাকে। ফলে আয় না থাকলেও ব্যয়ের টাকা জোগাতে হিমসিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের প্রথম দিকে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে
পঙ্গু শিশু নিকেতন সমন্বিত বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ বিএম শাখায় দেয়া হয়েছে চেয়ার টেবিল।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সবুজ শেখ একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। এই প্রতিষ্ঠানে তার আসা প্রায় এক বছর। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ অনেক ভালো কাজ করেন। তারা আমাদের মতো প্রতিবদ্ধীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। একই সাথে শিক্ষা, খাওয়া-দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করেছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলে আমাদের লেখাপড়ার বিঘ্ন ঘটতো। পড়াশোনার জন্য অনেক দূরে যেতে হতো। এতে করে আমাদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে
যেত।
পঙ্গু নিকেতনে থাকা অপর শিক্ষার্থী বলেন, মাটির দেওয়াল পড়ে পা ভেঙ্গে গেছে তার। তার বাড়ি থেকে স্কুল-কলেজ অনেক দূরে। দূর হওয়ায় সেখানে
লেখাপড়া করতে তার কষ্ট হয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুব কাছে কাছে। এছাড়া এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে অসুস্থ হলে চিকিৎসা
পাওয়া যায়।পঙ্গু শিশু নিকেতনের সভাপতি মো. মুরছালাত বলেন, ১৯৪৬ সালে জন্ম নেয় আব্দুল মজিদ এবং ২০১৯ সালে তিনি মারা যান। ১৯৭২ সালে
আবদুল মজিদের একটি কন্যা জন্ম হয়। ৩ বছরের মাথায় হঠাৎ করেই সুস্থ সবল শিশুটি হয়ে পড়ে অসুস্থ। হারিয়ে যায় উত্থান, বাক ও স্মৃতিশক্তি। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। এরপর পাগলপ্রায় অবস্থা হয় আব্দুল
মজিদের। কন্যা বেবী বালীর স্মরণে প্রতিবন্ধী শিশুদের যাপিত জীবনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাবা-মায়ের ২৫ বিঘা জমিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের
থাকার জন্য নির্মাণ করেন টিনের ঘরে নির্মান করে পঙ্গু শিশু নিকেতন ।
তিনি বলেন, জীবিত থাকাকালীন সাদা মনের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মজিদের ব্রত ছিল মানবপ্রেম। এলাকায় শিশু পার্ক, সড়ক নির্মাণের
পাশাপাশি তিনি রোপন করেছেন হাজারো গাছ। তিনি আরো বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায়
না। এখানে আমাদের আয়ের কিছু উৎস আছে যেমন পুকুর, ধানি জমি ও বিভিন্ন ফলের গাছ ইত্যাদি। সেই টাকায় কোনো মতে চলে
প্রতিষ্ঠানগুলো। তারপরেও কমতি হলে বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি সাহায্য করে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সহযোগিতা পাওয়া যায়।
পুঠিয়ার ৫ নম্বর শিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পায় না। ব্যক্তি
উদ্যাগে কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তবে সমাজসেবার রেজিস্ট্রেশন আছে। পঙ্গুদের শিক্ষা, থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা এটি অনেক ভালো উদ্যোগ।
পঙ্গু নিকেতনে সরকারি বা বেরসরকারি এনজিওগুলোর সহযোগিতা পেলে ভালোভাবে চলতো।
পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম নূর হোসেন নির্ঝর বলেন, রাজশাহী জেলা প্রশাসক একটি বরাদ্দ দিয়েছেন। দ্রুত পঙ্গু শিশু নিকেতনে
ওয়াস রুমের কাজ শুরু হবে। আমাদের সাধ্য মতো সহযোগিতার চেষ্টা করি।





















