- প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ব্যবহার হচ্ছে জুলাই গণহত্যা
- মামলার সংখ্যা দেড় হাজার, অধিকাংশ মামলায় আসামি ৫ শতাধিক
- জামিন-মুক্তির নেপথ্যে বাণিজ্য
‘হত্যা মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। বেশিরভাগ মামলায় দেখা যাচ্ছে হুকুমের এবং অজ্ঞাত আসামি। এতে বাণিজ্যের একটি সুযোগ থেকে যায়। বর্তমানে মামলাগুলোর যে পরিস্থিতি, তাতে মামলা টেকার সম্ভাবনা ক্ষীণ”
– ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
‘একটি মহল হয়রানির উদ্দেশ্যে মূল আসামির সঙ্গে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে মামলায় আসামি করছেন। তবে তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা আর বাণিজ্যের বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’
– বাহারুল আলম, আইজিপি
এসএম দেলোয়ার হোসেন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে পতন ঘটে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় শরীক জোট সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামল। ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জুলাই গণহত্যার ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ও আদালতে এ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আজ্ঞাবহ সাবেক মন্ত্রী-এমপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অগণিত মানুষের বিরুদ্ধে দেড় হাজার মামলা রুজু করা হয়। এসব মামলার বাদী নিজেও জানে না, চেনে না, কে বা কারা আসামি। জুলাই গণহত্যার মামলায় গণহারে অসংখ্য নিরীহ মানুষকেও আসামি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কে বা কারা এর নেপথ্যে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তাও অষ্পষ্ট। কয়েকটি মামলা তদন্তকালে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে জুলাই গণহত্যা মামলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার আসামি ৫ শতাধিক। বিভিন্ন থানায় ও আদালতে দায়ের করা দেড় হাজার মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের ফাঁদ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। কারও সঙ্গে পূর্বশত্রুতার জের থাকলেও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বাদীপক্ষ ও পুলিশ মিলেমিশে মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার বাণিজ্য শুরু করেছে। এর নেপথ্যে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে জামিনে মুক্তি বা মামলা থেকে নাম প্রত্যাহার করা হচ্ছে। নিরপরাধী ভুক্তভোগীরা বলছেন, এভাবে জুলাই গণহত্যার মামলায় অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। এতে প্রতিমূহুর্ত তাদের পরিবার অজানা শঙ্কায় দিনযাপন করছেন। আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, যেকোন হত্যা মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। বেশিরভাগ মামলায় দেখা যাচ্ছে হুকুমের এবং অজ্ঞাত আসামি। এতে বাণিজ্যের একটি সুযোগ থেকে যায়। বর্তমানে মামলাগুলোর যে পরিস্থিতি, তাতে মামলা টেকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, একটি মহল হয়রানির উদ্দেশ্যে মূল আসামির সঙ্গে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে মামলায় আসামি করছেন। তবে তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীর মিরপুরে গুলিতে বিএনপি কর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণ হত্যার অভিযোগে মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিনেতা ইরেশ যাকেরসহ ৪০৮ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ২০ এপ্রিল নিহতের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন। এই মামলার খবর প্রকাশ্যে আসতেই তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার অনুরাগী এবং শোবিজ তারকা ও পরিচালকরা। অনেকেই দাবি তুলেছেন, শোবিজের এই অভিনেতা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন। এরপরও অভিনেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা।
এদিকে রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি হাসপাতাল) নাক কান গলা বিভাগের চিকিৎসক হাসানুল হক নিপুন। শাহবাগ থানায় দায়ের করা একটি মামলার তিনি আসামি। মুন্সীগঞ্জের ইসমাইল হোসেন মামলাটির বাদী। এজাহারে বাদী কারো নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করেছেন। তবে ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ৫৫ দিন কারাবাস করেন নিরপরাধ এই চিকিৎসক।
ভুক্তভোগী চিকিৎসক হাসানুল হক নিপুন সবুজ বাংলাকে জানান, মিথ্যা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে হামলা ও ভাঙচুরের মামলা করা হয়। পরে কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার সময় এবং মামলার এজাহারের বর্ণনা সম্পূর্ণ ভুয়া।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ হয়ে মারা যান ঢাকার ধামরাইয়ের বনেরচর গ্রামের মনোয়ার হোসেন। কিন্তু তার বোন জেসমিন সুলতানা ওরফে আসমা আক্তার তার ভাইকে গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যা করা হয়েছে দাবি করে চারজন পুলিশ সদস্য ও কয়েকজন ইটভাটার মালিকসহ ধনাঢ্য ৫২ জনের নামে ধামরাই আমলি আদালতে মামলা করেন। মামলা নম্বর ৬১৫/২৪। আদালতের নির্দেশে গত বছর ২১ অক্টোবর ধামরাই থানা পুলিশ মামলাটি নথিভুক্ত করে। মামলায় বাদীর সাবেক স্বামীসহ সাত স্বজনকেও আসামি করা হয়। এর আগে ২৯ আগস্ট ৫০ জনের নামে তিনি আরো একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর ৫১৯/২৪। মামলার বাদীকে ২০০ ধারায় জবানবন্দি পর্যালোচনা করেন আদালত। বাদীর আনা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা না থাকার বিষয়টি প্রতীয়মান হওয়ায় আদালত ২০৩ ধারায় মামলাটি খারিজ করে দেন।
মনোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে করা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ধামরাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুল ইসলাম সবুজ বাংলাকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মামলাটি ভুয়া মনে হওয়ায় কোনো আসামিকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি।
অনুসন্ধানে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় করা এ ধরনের অন্তত ৩৫টি মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হয়রানিমূলক এসব মামলায় কাকে আসামি করা হবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে ভূমিকা রেখেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে এই মামলাগুলোকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী, কোনো কোনো দলের নেতাকর্মী এবং একটি দালাল সিন্ডিকেট দেশজুড়ে বিপুল মামলা বাণিজ্য শুরু করেছে। মামলাপ্রতি এরা লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করছে। আবার কোথাও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে, ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব মামলা করা হচ্ছে।
এসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী দেশে বেশিরভাগ হত্যা মামলা তদন্তে তাদের অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে যেটি অপরিহার্য, নিহত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি এখনো করা হয়নি। এ ছাড়া হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে এজাহারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। আসামিদের নামের পাশে হুকুমদাতা বা নির্দেশদাতা উল্লেখ করা হচ্ছে। আবার যাদের গুলি করে হত্যার কথা বলা হচ্ছে, নির্দিষ্ট করে এজাহারে বলা নেই যে, কে তাদের গুলি করে হত্যা করেছে। আইনগত অনেক ফাঁকফোকর থাকায় তদন্তে অনেক সময় লাগছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ মামলায় বাদী আসামিকে চেনেন না। অথচ এ ধরনের মামলায় জেল খাটছেন অনেক নিরীহ মানুষ। কেউ সাময়িক জামিন নিয়ে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন, হয়রানিমূলক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। আবার মামলার এজাহারনামীয় আসামিদের চিনলেও অজ্ঞাতপরিচয় আসামির তালিকায় থাকা ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলে তাকে চিনছেন না বাদী নিজেই। এসব মামলায় পুলিশ যাকেই ধরছে, তাকেই থানায় নিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেককে মিথ্যা মামলায় কোর্টে চালান দেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়া লীগ সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা হত্যাসহ অন্যান্য মামলার খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেছে এমন তথ্য-চিত্র। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দায়ের করা এসব মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে নাম থাকা আসামিরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, অভিনেতা, অরাজনৈতিক ব্যক্তি, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নিরপরাধ মানুষ এসব মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার প্রতিপক্ষকে মামলার ভয় দেখিয়ে আর্থিক সুবিধা আদায় করেও ফের ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে মামলাকেন্দ্রিক অস্বাভাবিক এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশে। আইন উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইজিপি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব মামলার বিরুদ্ধে কথা বলার পরও থামছে না হয়রানিমূলক মামলা দায়ের। বরং সরকারই বিব্রতবোধ করছেন বলে বিভিন্ন সেমিনারে জানিয়েছেন আইন, স্বরাষ্ট্র, সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা।
মামলার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একেক মামলায় একেক শ্রেণির ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। কোথাও অভিনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী, কোথাও ব্যবসায়ী, কোথাও সাংবাদিক, কোথাও আবার পুলিশ, কোথাও-বা আমলা।
সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি থানায় পুলিশের পাশাপাশি অন্যদেরও মামলা বাণিজ্যে জড়িত হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। মোহাম্মদপুর থানায় খোঁজ নিয়ে এমন চারটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। মামলাগুলো হলো- ৫২১/২৪, ১৮(৯/২০২৪), ১৪(৮/২-২৪) ও ২৪(৮/২০২৪)। এ ছাড়া মিরপুর মডেল থানায় ২৫/৩৬১ এবং শাহআলী থানায় ৫৩৫/২০২৪ নম্বর মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় হত্যার অভিযোগে মূল আসামিদের পাশাপাশি নিরীহ লোকদেরও জড়িয়ে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম সবুজ বাংলাকে জানান, গত ৬ জানুয়ারি রাত ৯টায় তিনি ব্যবসায়ীক কাজে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে যান। তখন কামরাঙ্গীরচর থানা বিএনপি নেতা হাজী রশিদ ও তার ছেলে রকির নেতৃত্বে নিউ মার্কেট থানা যুবদল নেতা সুজন, আশিফ, বুনিয়াদি সুমন, শাহআলম, সেলিম, কাউসার, সোহেল রানা ও চঞ্চলসহ প্রায় ২০ জন দুর্বৃত্ত তাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে প্রথমে ধানমন্ডিতে নিয়ে যায়। এরপর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান ও সুবাস্তু অর্কেডে দু’দফায় আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে খবর পেয়ে কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি তদন্ত ও এসআই হারুন গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। পরবর্তীতে থানা ও ওয়ার্ড বিএনপি নেতাদের নির্দেশে একটি মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রাতভর থানা হাজতে আটকে রাখেন। ওই মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার শর্তে থানার ওসি আমিরুল ইসলাম কয়েক দফায় তার পরিবারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই মামলায় মুক্তি না দিয়ে পরদিন ৭ জানুয়ারি দুপুরের দিকে তাকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন আবেদন করলেও আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। তবে মুক্তি দেওয়া ও মামলা বাণিজ্যের বিষয়ে ওসি আমিরুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ছাড়া চাঁদাবাজি ও হামলার ঘটনায় গত বছরের ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর আদালতের নির্দেশে কামরাঙ্গীরচর থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. আলী আহাম্মদ ও মো. সগির আহমেদ সুজন। কিন্তু আসামিদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী অ্যাড. কামরুল ইসলাম অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছেন। তবে বাকি আসামিরা বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও গভীর সখ্যতার কারণে পুলিশ তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করছে না বলে অভিযোগ করেন বাদীরা।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থানায় দায়ের করা আরেকটি মামলা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। গত বছরের ২৭ আগস্ট মামলাটি করেন দর্শনা থানা এলাকার পরানপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম। মামলার বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে দর্শনা পৌরসভার পরানপুর গ্রামে রবিউল ইসলামের বাড়িতে ঢুকে আসামিরা বাদীকে হত্যার উদ্দেশ্যে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ, বোমা-ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়। এই মামলায় ৬৯ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় ৮০ থেকে ৯০ জনকে। অভিযোগ রয়েছে, এজাহারনামীয় ৬৯ জন আসামির মধ্যে রয়েছেন অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মামলার এক আসামি সবুজ বাংলাকে জানান, মামলা থেকে নাম বাদ দিতে তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। বিষয়টি প্রথমে গুরুত্ব দেননি তিনি। পরে দেখেন এজাহারে তার নাম। মামলাটি নিয়ে এখন তিনি বিপাকে আছেন। আবার মামলায় ভুলবশত আসামি হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম চলে আসায় তাদের নাম প্রত্যাহারে আদালতে লিখিত আবেদন করেছেন বাদী নিজেই। এভাবে পাঁচ আসামিকে জামিন করা হয়েছে।
বাদী রবিউল ইসলাম অভিযোগ করে সবুজ বাংলাকে জানান, এই মামলায় কখন কাকে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে, তা তিনি নিজেও জানেন না। এজাহারনামীয় তেমন কাউকে গ্রেপ্তার করা না হলেও অজ্ঞাতপরিচয় আসামি দেখিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে মামলায় চালান দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শহীদ তিতুমীর সবুজ বাংলাকে বলেন, এই মামলায় গ্রেপ্তারদের মধ্যে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিও আছে। আমরা যাচাই-বাছাই করেই মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করছি।
এদিকে, সৌদিআরব গমনেচ্ছুক কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার দলিল লেখকের সহকারী ইমরান তৌহিদ রানা সবুজ বাংলাকে জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে সৌদি আরব যেতে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্টেশনে পৌঁছালে ঈদগাঁও থানা পুলিশের হাতে আটক হন তিনি। থানার নথিতে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলার তথ্য না পেয়ে ছেড়ে দিতে নগদ এক লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ। মামলা থেকে বাঁচতে ঘরে থাকা দুটি গরু ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। ঈদগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়দানকারী থানার কনস্টেবল রব্বানীর সঙ্গে রফাদফা করে ৭০ হাজার টাকা তুলে দেন। কথা ছিল পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে তাকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তা না করে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশের কাছে। সদর মডেল থানা পুলিশ গত বছরের ৪ ও ৫ আগস্টের সহিংস ঘটনাসহ জেলা বিএনপি অফিসে আগুন লাগানোর মামলার আসামি করে তাকে আদালতে চালান দেয়। ফলে তার আর সৌদি আরব যাওয়া হয়নি। গত ১৯ এপ্রিল কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান রানা।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার কী অপরাধ ছিল? কোনো ধরনের অপরাধ না করে এমনকি কোনো মামলার আসামি না হয়েও আমি আসামি হয়ে গেলাম। ঘরের দুটি গরু হারালাম। সৌদি যেতে মাসিক ২২ হাজার টাকা কিস্তিতে ২ লাখ টাকা তুলেছিলাম। এখন এনজিওর মাসিক কিস্তির সময় এলে চোখে সরষে ফুল দেখি…। এটাই কী আইন বা নিয়তী।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতসহ বিভিন্ন ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত এক হাজার ৫০০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৬০০টি। এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
এসব প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সবুজ বাংলাকে বলেন, যেকোন হত্যা মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। বেশিরভাগ মামলায় দেখা যাচ্ছে হুকুমদাতা বা নির্দেশদাতা এবং অজ্ঞাত আসামি। এতে বাণিজ্যের বড় একটি সুযোগ থেকে যায়। বর্তমানে মামলাগুলোর যে পরিস্থিতি, তাতে মামলা টেকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এদিকে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সবুজ বাংলাকে বলেন, হয়তো একটি মহল হয়রানির উদ্দেশ্যে মূল আসামির সঙ্গে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে মামলায় আসামি করছেন। তবে তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না। নিরপরাধী কেউ যাতে মামলার আসামি, গ্রেফতার বা হয়রানির শিকার না হয়, তদন্ত কর্মকর্তাদের সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি গ্রেপ্তার, জামিন বা মুক্তির ইস্যুতে বাণিজ্যের বিষয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান আইজিপি।
এমআর/সবা






















