০২:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সীতাকুণ্ডে বাস–ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত

ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বটতলা এলাকায় সোমবার, ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা আবারও দেশের সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুরবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো। দিনের আলো ফুরোতে না ফুরোতে ব্যস্ত মহাসড়কটি পরিণত হয় এক রক্তাক্ত দুর্ঘটনাস্থলে, যেখানে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জীবন হারাতে হয় পাঁচজনকে এবং আহত হন একাধিক যাত্রী।

ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার ঠিক আগে পরিবেশ ছিল স্বাভাবিক—মহাসড়ক ধরে ট্রাক, বাস, প্রাইভেটকার ও পণ্যবাহী গাড়িগুলো নিয়মিত ছুটে চলছিল। যানজটও ছিল না। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যায়। এক বিকট শব্দে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। লোকজন হতবাক হয়ে ছুটে দেখে যে যাত্রীবাহী বাসটি সামনের দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে সড়কের মাঝেই থেমে আছে। সংঘর্ষের তীব্রতায় গাড়িগুলোর সামনের অংশ পুরোপুরি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

 

যাত্রীদের চিৎকার, কাতর আর্তনাদ আর আতঙ্কে এলাকা মুহূর্তেই ভারী হয়ে ওঠে। স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে দ্রুত আটকে পড়া যাত্রীদের বের করার চেষ্টা করেন। বাসের ভেতর থেকে যাদেরকে টেনে বাইরে আনা সম্ভব হচ্ছিল, তাদেরকে স্থানীয় ক্লিনিক ও ওষুধের দোকানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতায় সাধারণ মানুষ কিছুক্ষণের মধ্যেই হিমশীতল হয়ে পড়েন।

খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ভাঙাচোরা গাড়ির ভেতর থেকে পাঁচজনের নিথর দেহ বের করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে কাছের হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতদের মধ্য থেকে গুরুতর অবস্থায় থাকা কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, যেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা শুরু করেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন—আহতদের বেশ কয়েকজনের অবস্থা সংকটাপন্ন এবং মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

দুর্ঘটনার পর দ্রুতই মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। উত্তর–দক্ষিণ দিক উভয় পাশেই শত শত গাড়ির লম্বা সারি তৈরি হয়। যাত্রীরা গাড়ির ভেতর উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন; কেউ কেউ গাড়ি থেকে নেমে দুর্ঘটনাস্থল পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। পুলিশের হাইওয়ে টহল দল ঘটনাস্থলে এসে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। ক্ষতিগ্রস্ত বাস ও ট্রাক সরাতে উদ্ধারযান আনা হয়, যা সম্পূর্ণ করতে বেশ সময় লাগে।

এলাকাবাসী দাবি করছেন, বটতলা অংশটি মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। ভারী যানবাহনগুলো এখানে অতিরিক্ত গতিতে চলে, আবার কিছু অংশে হঠাৎ বাঁক থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে বেশি। তারা আরও বলেন, সন্ধ্যার সময় আলোর স্বল্পতা ও চালকদের ক্লান্তিও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায়—“দুই গাড়ির চালকই বুঝতে পারেননি কীভাবে মুহূর্তে সামনে এসে পড়েছে অন্য গাড়িটি।”

নিহতদের পরিচয় এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। পুলিশ জানায়, তাদের কাছে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল ফোন, ব্যাগসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে এবং পরিচয় শনাক্তকরণ চলছে। নিহতদের স্বজনেরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে, কেউ কেউ ফোনে খবর পেয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

 

দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমে আসে শোকের ঢেউ। মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, প্রতিদিন সড়কে প্রাণহানির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, অথচ উন্নত নজরদারি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সড়ক কর্তৃপক্ষ কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে।

এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল যে বাংলাদেশের ব্যস্ততম মহাসড়কটিতে প্রতিটি মুহূর্তই ঝুঁকিপূর্ণ। জীবিকার জন্য বের হওয়া মানুষগুলো কখন যে এভাবে ফিরবে না, কেউ বলতে পারে না। পাঁচটি পরিবার এই সন্ধ্যায় তাদের প্রিয়জন হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়েছে, অসংখ্য মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালগুলোর বিছানায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে।

সন্ধ্যার সেই কয়েক সেকেন্ডের ভয়াবহতা আজ সীতাকুণ্ড থেকে শুরু করে পুরো দেশের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনা, আরেকটি অকাল মৃত্যু—এ যেন দেশের সড়ক ব্যবস্থারই নির্মম প্রতিচ্ছবি।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

সীতাকুণ্ডে বাস–ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত

আপডেট সময় : ০৮:৪২:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বটতলা এলাকায় সোমবার, ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা আবারও দেশের সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুরবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো। দিনের আলো ফুরোতে না ফুরোতে ব্যস্ত মহাসড়কটি পরিণত হয় এক রক্তাক্ত দুর্ঘটনাস্থলে, যেখানে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জীবন হারাতে হয় পাঁচজনকে এবং আহত হন একাধিক যাত্রী।

ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার ঠিক আগে পরিবেশ ছিল স্বাভাবিক—মহাসড়ক ধরে ট্রাক, বাস, প্রাইভেটকার ও পণ্যবাহী গাড়িগুলো নিয়মিত ছুটে চলছিল। যানজটও ছিল না। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যায়। এক বিকট শব্দে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। লোকজন হতবাক হয়ে ছুটে দেখে যে যাত্রীবাহী বাসটি সামনের দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে সড়কের মাঝেই থেমে আছে। সংঘর্ষের তীব্রতায় গাড়িগুলোর সামনের অংশ পুরোপুরি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

 

যাত্রীদের চিৎকার, কাতর আর্তনাদ আর আতঙ্কে এলাকা মুহূর্তেই ভারী হয়ে ওঠে। স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে দ্রুত আটকে পড়া যাত্রীদের বের করার চেষ্টা করেন। বাসের ভেতর থেকে যাদেরকে টেনে বাইরে আনা সম্ভব হচ্ছিল, তাদেরকে স্থানীয় ক্লিনিক ও ওষুধের দোকানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতায় সাধারণ মানুষ কিছুক্ষণের মধ্যেই হিমশীতল হয়ে পড়েন।

খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ভাঙাচোরা গাড়ির ভেতর থেকে পাঁচজনের নিথর দেহ বের করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে কাছের হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতদের মধ্য থেকে গুরুতর অবস্থায় থাকা কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, যেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা শুরু করেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন—আহতদের বেশ কয়েকজনের অবস্থা সংকটাপন্ন এবং মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

দুর্ঘটনার পর দ্রুতই মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। উত্তর–দক্ষিণ দিক উভয় পাশেই শত শত গাড়ির লম্বা সারি তৈরি হয়। যাত্রীরা গাড়ির ভেতর উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন; কেউ কেউ গাড়ি থেকে নেমে দুর্ঘটনাস্থল পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। পুলিশের হাইওয়ে টহল দল ঘটনাস্থলে এসে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। ক্ষতিগ্রস্ত বাস ও ট্রাক সরাতে উদ্ধারযান আনা হয়, যা সম্পূর্ণ করতে বেশ সময় লাগে।

এলাকাবাসী দাবি করছেন, বটতলা অংশটি মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। ভারী যানবাহনগুলো এখানে অতিরিক্ত গতিতে চলে, আবার কিছু অংশে হঠাৎ বাঁক থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে বেশি। তারা আরও বলেন, সন্ধ্যার সময় আলোর স্বল্পতা ও চালকদের ক্লান্তিও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায়—“দুই গাড়ির চালকই বুঝতে পারেননি কীভাবে মুহূর্তে সামনে এসে পড়েছে অন্য গাড়িটি।”

নিহতদের পরিচয় এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। পুলিশ জানায়, তাদের কাছে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল ফোন, ব্যাগসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে এবং পরিচয় শনাক্তকরণ চলছে। নিহতদের স্বজনেরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে, কেউ কেউ ফোনে খবর পেয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

 

দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমে আসে শোকের ঢেউ। মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, প্রতিদিন সড়কে প্রাণহানির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, অথচ উন্নত নজরদারি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সড়ক কর্তৃপক্ষ কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে।

এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল যে বাংলাদেশের ব্যস্ততম মহাসড়কটিতে প্রতিটি মুহূর্তই ঝুঁকিপূর্ণ। জীবিকার জন্য বের হওয়া মানুষগুলো কখন যে এভাবে ফিরবে না, কেউ বলতে পারে না। পাঁচটি পরিবার এই সন্ধ্যায় তাদের প্রিয়জন হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়েছে, অসংখ্য মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালগুলোর বিছানায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে।

সন্ধ্যার সেই কয়েক সেকেন্ডের ভয়াবহতা আজ সীতাকুণ্ড থেকে শুরু করে পুরো দেশের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনা, আরেকটি অকাল মৃত্যু—এ যেন দেশের সড়ক ব্যবস্থারই নির্মম প্রতিচ্ছবি।

এমআর/সবা