০২:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তীরে শুঁটকি পল্লীতে এখন উৎপাদনে ব্যস্ততা

দেশে শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আগস্ট থেকে শুরু হয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় এখন কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী শুঁটকি পল্লীগুলোতে শ্রমিকদের দম ফেলারও ফুরসত নেই।

শুঁটকি উৎপাদনকারীরা জানাচ্ছেন, সরকারের নির্দিষ্ট নজরদারি না থাকায় তারা নানা সমস্যা মোকাবিলা করছেন। সবচেয়ে বড় সংকট—উৎপাদনের জন্য স্থায়ী জায়গার অভাব। প্রতি বছর ব্যক্তিগত জমি ভাড়া বা চুক্তিতে নিয়ে অস্থায়ী ঘর ও মাচান তৈরি করে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ করতে হয়। উৎপাদন শেষে বিপণনের ক্ষেত্রে আড়তদারদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় তাদের কাছে একপ্রকার ‘জিম্মি’ হয়ে থাকার অভিযোগও করেছেন উৎপাদনকারীরা। আড়তদাররা সিংহভাগ টাকা বকেয়া রেখে শুঁটকি নিয়ে যাওয়ায় অল্প মুনাফায় ব্যবসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

অন্যদিকে আড়তদাররা বলছেন, মৌসুমে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি বাকিতে দিতে হয়, ফলে তাদেরও অনেক টাকা আটকে থাকে। এটি ব্যবসার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে দাবি করেন তারা।

চট্টগ্রামের তিন বড় শুঁটকি পল্লী—ইছানগর, চরপাথরঘাটা ও উত্তর বাকলিয়ার ক্ষেতচর। কর্ণফুলী নদীর তীরে হওয়ায় এসব এলাকায় মাছ আনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শুঁটকি বাজারজাত করা সহজ। প্রতিদিন কয়েকশ মাচান ও বাঁশে ঝুলিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকানো হয়।

 

বাকলিয়ার বাস্তুহারা এলাকার শুঁটকি পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, নারী শ্রমিকেরা মাচানের ওপর শুঁটকি সাজাচ্ছেন এবং পুরুষ শ্রমিকেরা উঁচু বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে লইট্টা, ছুরি, লাক্কাসহ বিভিন্ন শুঁটকি ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। ছোট প্রজাতির মাছ—ফাইসা, চিংড়ি ও মিশ্র পাঁচমিশালী শুঁটকি—মাচানে শুকানো হচ্ছে। নারীরা কাঁচা মাছ পরিষ্কার করছেন, আর পুরুষ কর্মীরা লবণ মাখিয়ে তা শুকানোর উপযোগী করছেন।

শ্রমিক আলী হোসেন বলেন, “এক ব্যাচ শুঁটকি তৈরি হতে ৩–৪ সপ্তাহ সময় লাগে। এখন মৌসুম বলে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।”

চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র শুঁটকি উৎপাদন–বিপণন সমবায় সমিতির সহ–সভাপতি মোহাম্মদ মুসা সওদাগর বলেন, “২৫ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে আছি। কিন্তু শুঁটকি উৎপাদনের জন্য স্থায়ী জায়গা নেই। সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় জায়গা দিত, তাহলে আমরা নিশ্চিন্তে উৎপাদন করতে পারতাম। এখন বছর বছর জমি পরিবর্তন করতে হয়। খরচ বাড়ছে, কিন্তু মুনাফা বাড়ছে না। আড়তদারদের কাছে বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকে—এটি আমাদের জন্য বড় সংকট।”

এদিকে আছদগঞ্জের শুঁটকিপট্টিতে বর্তমানে লইট্টা শুঁটকি কেজিপ্রতি মানভেদে ৫০০–১,৩০০ টাকা, বাটা শুঁটকি ৬০০–৮০০ টাকা, ছুরি শুঁটকি ৩০০–২,৪০০ টাকা, চিংড়ি শুঁটকি ৩০০–২,৫০০ টাকা, রূপচান্দা শুঁটকি ১,৮০০–৫,০০০ টাকা, লাক্কা শুঁটকি ২,২০০–৪,৫০০ টাকা এবং ফাইসা শুঁটকি ৩০০–৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গত দুই বছরে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ফলে নিম্নআয়ের মানুষ শুঁটকি কেনার বাইরে চলে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসমান হায়দার বলেন, “দেশে যে পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদিত হয়, তা মোট চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয়—মূলত ভারত ও মিয়ানমার থেকে। শুল্ক বৃদ্ধি ও আমদানির জটিলতার কারণে দাম বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে সরাসরি এলসির মাধ্যমে শুঁটকি আনা যায় না, সিঙ্গাপুর হয়ে আনতে হয়। এতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কসহ মোট ৫৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। শুল্ক হার ২০ শতাংশ কমানো গেলে বাজারে দামও কমে আসত।”

জনপ্রিয় সংবাদ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তীরে শুঁটকি পল্লীতে এখন উৎপাদনে ব্যস্ততা

আপডেট সময় : ০৪:৪৮:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

দেশে শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আগস্ট থেকে শুরু হয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় এখন কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী শুঁটকি পল্লীগুলোতে শ্রমিকদের দম ফেলারও ফুরসত নেই।

শুঁটকি উৎপাদনকারীরা জানাচ্ছেন, সরকারের নির্দিষ্ট নজরদারি না থাকায় তারা নানা সমস্যা মোকাবিলা করছেন। সবচেয়ে বড় সংকট—উৎপাদনের জন্য স্থায়ী জায়গার অভাব। প্রতি বছর ব্যক্তিগত জমি ভাড়া বা চুক্তিতে নিয়ে অস্থায়ী ঘর ও মাচান তৈরি করে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ করতে হয়। উৎপাদন শেষে বিপণনের ক্ষেত্রে আড়তদারদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় তাদের কাছে একপ্রকার ‘জিম্মি’ হয়ে থাকার অভিযোগও করেছেন উৎপাদনকারীরা। আড়তদাররা সিংহভাগ টাকা বকেয়া রেখে শুঁটকি নিয়ে যাওয়ায় অল্প মুনাফায় ব্যবসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

অন্যদিকে আড়তদাররা বলছেন, মৌসুমে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি বাকিতে দিতে হয়, ফলে তাদেরও অনেক টাকা আটকে থাকে। এটি ব্যবসার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে দাবি করেন তারা।

চট্টগ্রামের তিন বড় শুঁটকি পল্লী—ইছানগর, চরপাথরঘাটা ও উত্তর বাকলিয়ার ক্ষেতচর। কর্ণফুলী নদীর তীরে হওয়ায় এসব এলাকায় মাছ আনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শুঁটকি বাজারজাত করা সহজ। প্রতিদিন কয়েকশ মাচান ও বাঁশে ঝুলিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকানো হয়।

 

বাকলিয়ার বাস্তুহারা এলাকার শুঁটকি পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, নারী শ্রমিকেরা মাচানের ওপর শুঁটকি সাজাচ্ছেন এবং পুরুষ শ্রমিকেরা উঁচু বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে লইট্টা, ছুরি, লাক্কাসহ বিভিন্ন শুঁটকি ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। ছোট প্রজাতির মাছ—ফাইসা, চিংড়ি ও মিশ্র পাঁচমিশালী শুঁটকি—মাচানে শুকানো হচ্ছে। নারীরা কাঁচা মাছ পরিষ্কার করছেন, আর পুরুষ কর্মীরা লবণ মাখিয়ে তা শুকানোর উপযোগী করছেন।

শ্রমিক আলী হোসেন বলেন, “এক ব্যাচ শুঁটকি তৈরি হতে ৩–৪ সপ্তাহ সময় লাগে। এখন মৌসুম বলে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।”

চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র শুঁটকি উৎপাদন–বিপণন সমবায় সমিতির সহ–সভাপতি মোহাম্মদ মুসা সওদাগর বলেন, “২৫ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে আছি। কিন্তু শুঁটকি উৎপাদনের জন্য স্থায়ী জায়গা নেই। সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় জায়গা দিত, তাহলে আমরা নিশ্চিন্তে উৎপাদন করতে পারতাম। এখন বছর বছর জমি পরিবর্তন করতে হয়। খরচ বাড়ছে, কিন্তু মুনাফা বাড়ছে না। আড়তদারদের কাছে বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকে—এটি আমাদের জন্য বড় সংকট।”

এদিকে আছদগঞ্জের শুঁটকিপট্টিতে বর্তমানে লইট্টা শুঁটকি কেজিপ্রতি মানভেদে ৫০০–১,৩০০ টাকা, বাটা শুঁটকি ৬০০–৮০০ টাকা, ছুরি শুঁটকি ৩০০–২,৪০০ টাকা, চিংড়ি শুঁটকি ৩০০–২,৫০০ টাকা, রূপচান্দা শুঁটকি ১,৮০০–৫,০০০ টাকা, লাক্কা শুঁটকি ২,২০০–৪,৫০০ টাকা এবং ফাইসা শুঁটকি ৩০০–৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গত দুই বছরে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ফলে নিম্নআয়ের মানুষ শুঁটকি কেনার বাইরে চলে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসমান হায়দার বলেন, “দেশে যে পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদিত হয়, তা মোট চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয়—মূলত ভারত ও মিয়ানমার থেকে। শুল্ক বৃদ্ধি ও আমদানির জটিলতার কারণে দাম বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে সরাসরি এলসির মাধ্যমে শুঁটকি আনা যায় না, সিঙ্গাপুর হয়ে আনতে হয়। এতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কসহ মোট ৫৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। শুল্ক হার ২০ শতাংশ কমানো গেলে বাজারে দামও কমে আসত।”