অন্ধকার হলেই ফসলি জমিতে নেমে আসে বনের একঝাঁক বুনো শুয়োর। নষ্ট করে ফেলে কৃষি জমির ধান ও সবজিখেত। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় এক মাস ধরে প্রায় চার-পাঁচটি এলাকায় চলছে এই তাণ্ডব। পাকা ধান ঘরে তোলার সময় এ ভোগান্তিতে ক্ষতির শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকেরা। এ অবস্থায় বুনো শূকর থেকে ফসল বাঁচানোর জন্য রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন তাঁরা।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, ‘বন্যপ্রাণীর দল রাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে পাকা ধান বা সবজির ক্ষেত নষ্ট করে দেয়। এতে তাদের বছরের পরিশ্রম মুহূর্তেই পণ্ড হয়ে যায়। এই ক্ষতি এড়াতে, অনেক কৃষক দলবদ্ধভাবে বাঁশ, টিনের শব্দ এবং লাঠিসোঁটা হাতে সারারাত জমিতে পাহারা দিচ্ছেন।’
কৃষকেরা অভিযোগ করে জানান, ‘কমলগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের লংগুরপার, দক্ষিণ বালিগাঁও, বাঘমারা, সরইবাড়ি, ভেড়াছড়া, ছাতকছড়া এলাকার ফসলি জমিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বনের বুনো শূকর প্রতি রাতে হানা দেয়। আমন পাকা ধান ও শীতকালীন সবজিখেতে শূকরের দল এসে তা নষ্ট করে। ধান, আলু, মুলা এমনকি কলাগাছসহ বিভিন্ন গাছ উপড়ে ফেলে।’
এদিকে শূকর তাড়ানোর চেষ্টা করলে উল্টো মানুষকে ধাওয়া করে। সারা দিন কাজ করে আবার রাত জেগে ফসল পাহারা দিতে হয়। কৃষকেরা বুনো শূকরের হানায় ফসল মাঠে রাখতে পারছেন না। শীতের মধ্যে পাকা ধান রক্ষায় মাঠে বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে পাহারা দেন কৃষকেরা। সঙ্গে রাখেন প্লাস্টিক ও টিনের তৈরি ড্রাম। কিছুক্ষণ পর শব্দ করে চিৎকার করেন, যাতে শূকর চলে যায়। কৃষক মফিজ মিয়া ফসলি মাঠে বাঁশ দিয়ে ৬ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মাচা তৈরি করে রাতে বসে থাকেন শূকর তাড়ানোর জন্য।

মফিজ মিয়া বলেন, ‘শূকর আমাদের সব ফসল নষ্ট করে ফেলছে। এ অবস্থায় প্লাস্টিক ও টিনের ড্রামের শব্দ করে রাত জেগে ফসল পাহারা দিতে হয়। এসব শূকর মানুষকেও আক্রমণ করে। এ কারণে ৬ ফুট উঁচুতে বাঁশের মাচা তৈরি করেছি, যাতে বন্য শূকর আক্রমণ করতে না পারে।’
মফিজ মিয়ার মতো এভাবে মাচা তৈরি করে রাতভর পাহারা দিচ্ছেন কৃষক কনাই মিয়া, আবুল মিয়া ও আশিক মিয়া। ফসল কাটার আগ পর্যন্ত চলবে তাঁদের পাহারা দেওয়ার কাজ। তবে বুনো শূকরের আক্রমণ ঠেকাতে এখন পর্যন্ত সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে দাবি করেন কৃষকেরা।
এদিকে তীব্র শীতের রাতে ফসল পাহারা দেওয়া রাতজাগা মাধবপুর এলাকার এই কৃষকের নাম সুফি মিয়া। বন্যশূকরের ক্ষতির হাত থেকে ফলসকে রক্ষা করতেই তার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। ধানের সাথেই শীতের রাত্রীযাপন কৃষক সুফি মিয়া। তিনি থাকেন কমলগঞ্জ উপজেলার বাগবাড়ি এলাকায়। সম্রতি কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে।
সুফি জানান, ‘বনোরতা’ আমার সব ফসল নষ্ট করে দেয়। তাই নিজেই ধানগুলো রক্ষার জন্য পাহারা দেই। একটি-দুটি নয়, একসাথে ১০ থেকে ১৫টির দল নামে। দেখে ভয় লাগে তখন। টর্চ মেরে জোরে জোরে শব্দ করলে তারা পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টা/৮টার দিকে তারা নামে। আবার আসে মাঝরাতে। পুরো রাত জেগে ধান পাহারা না দিলে জমির সব ধান নষ্ট করে দিতে চায় তারা।’
পরিবেশবাদী সংগঠন জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি কমলগঞ্জের সহ-সাধারন সম্পাদক মো. সালাহউদ্দিন শুভ বলেন, ‘বন উজাড় ও বনভূমি বেদখল হওয়ার কারণে এখন বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। আগে বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে হানা দেয়নি, মানুষের কোনো ক্ষতি করেনি। লাউয়াছড়ার বেদখল বনভূমি উদ্ধার করে বন্যপ্রাণীদের জন্য বনজ গাছ লাগানোর দাবি জানান তিনি।’
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক জামিল মোহাম্মদ খান জানান, ‘বন্যপ্রাণীর নির্দিষ্ট কোনো এলাকা নেই। বন্যপ্রাণীরা খাবারের জন্য লোকালয়ে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বুনো শূকরের বংশবিস্তার আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। শূকরের দলের বনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বিচরণ করা স্বাভাবিক বিষয় হলেও ফসল নষ্ট হওয়ায় ঘটনা দুঃখজনক। তবে বন্যপ্রাণী হত্যা একটা দন্ডনীয় অপরাদ। কেউ যেন প্রাণী মারার জন্য মরন ফাঁদ ব্যবহার না করে। যদি সেটা করে তাহলে আইনের আওতায় আনা হবে।
এমআর/সবা
























