০৯:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকায় ভূমিকম্প ঝুঁকির নেপথ্যে রাজউকের অনিয়ম-দুর্নীতি!

  • ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে কাটছে না আতঙ্ক
  • রাজধানীতে ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত
  • ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

‘প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের সংস্কারের সুযোগ দেয়, কিন্তু রাজউক কখনও এসব থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা তদন্ত করে, রিপোর্ট দেয়, তারপর ভুলে যায়। আর এই সময়েই বেড়ে ওঠে অনিরাপদ ভবন’
– অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
‘ঢাকা এখন পুরোপুরি লাল-ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি অনিয়ন্ত্রিত ভবন এই শহরের ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে। মানুষকে ভূমিকম্প মারে না। মারে দুর্নীতি, অবহেলা ও দুর্বল ভবনে’
– অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
‘যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজউকে অর্থের বিনিময়ে কোনও কাজ হয় না। ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে’
– প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, রাজউক

ঢাকার অদুরে নরসিংদীতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। এই কম্পনের ৩১ ঘণ্টার মধ্যেই আরও তিনবার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এর মাধ্যমে আবারও আলোচনার সামনে এসেছে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর মেগা সিটি ঢাকা। টানা ৩১ ঘন্টার ব্যবধানে ঢাকা ও নরসিংদীতে পরপর চারদফা ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় এখনও জনমনে আতঙ্ক কাটেনি। জীবন যুদ্ধে জীবিকার তাগিদে নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস নিয়ে অজানা আতঙ্কে দিনযাপন করছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সপরিবারে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে বসবাস করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন কর্মজীবীরা। এদিকে ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদদের ডেকে জরুরি বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় ভূমিকম্পের ঝুঁকি, প্রস্তুতি, সমন্বয়, পরামর্শ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করাসহ করণীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রকৌশলী ও নগর-পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর নেপথ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনিয়ম-দুর্নীতি আর নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলেই ঢাকার কাঠামোগত ঝুঁকিকে বিপজ্জনকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্প প্রাকৃতিক হলেও ঢাকার ঝুঁকির বড় অংশই মানুষের তৈরি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদের মতে, প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের সংস্কারের সুযোগ দেয়, কিন্তু রাজউক কখনও এসব থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা তদন্ত করে, রিপোর্ট দেয়, তারপর ভুলে যায়। আর এই সময়েই বেড়ে ওঠে অনিরাপদ ভবন। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারীর মতে, ঢাকা এখন পুরোপুরি লাল-ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি অনিয়ন্ত্রিত ভবন এই শহরের ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে। মানুষকে ভূমিকম্প মারে না। মারে দুর্নীতি, অবহেলা ও দুর্বল ভবনে। এদিকে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজধানীতে ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে রাজউকের বিষয়ে যে অভিযোগ আসছে, তা তিনি নাকচ করে বলেছেন, রাজউক থেকে যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজউকে অর্থের বিনিময়ে কোনও কাজ হয় না। ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার কম্পনের কারণে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ১০ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন আরও শত শত মানুষ। ফাটল দেখা দিয়েছে বহু ভবনে। হেলেও পড়েছে কয়েকটি ভবন। গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্প রাজউকের সেই পদ্ধতিগত ব্যর্থতাগুলোই এখন আলোচনার সামনে উঠে আসছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী এলাকার কাছে, যা রাজধানীর মেগা সিটি ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। ৭ কোটির বেশি মানুষ ভয়াবহ এ ভূ-কম্পনটি অনুভব করেন। এছাড়া ঢাকায় এক কোটি মানুষের বেশি তীব্র কম্পন অনুভব করেন। তাদের অনেকেই আতঙ্কে অ্যাপার্টমেন্ট, হাসপাতাল এবং উচ্চ ভবনের অফিস-বাসা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন।
ভয়াবহ সেই মুহূর্তের বর্ণনা করে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা রিয়াদ সবুজ বাংলাকে বলেন, আমি তখন একটি সেলুনে বসে ছিলাম। প্রথমে মনে হচ্ছিল, দোকানি হয়তো চেয়ারে পা রেখে দোলাচ্ছিল। তখন দেখি- সেলুন দোকানি উল্টো আমাকে বলছে, আঙ্কেল- মনে হচ্ছে দেশের কোথাও ভূমিকম্প হচ্ছে। দোকানের বাকি চেয়ার ও সিলিং ফ্যান কাঁপছে। বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত দোকান থেকে আমরা সবাই দ্রুত বাইরে বের হয়ে যাই। তিনি বলেন, এই শহর ভূমিকম্প রক্ষায় এখনও প্রস্তুত নয়। এখনও যে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা যেন মহান আল্লাহর অলৌকিক রহমত।
পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা কর্মজীবী নারী ইয়াসমিন আক্তার সবুজ বাংলাকে বলেন, ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর থেকে এখনও আতঙ্কে রয়েছি। কর্মস্থলে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হচ্ছে। তিনি বলেন, জীবনযুদ্ধে জীবিকার তাগিদেই সপরিবারে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই বসবাস করতে হচ্ছে। যখন কর্মস্থলে থাকি, তখন বাধ্য হয়ে ভিডিও কলে সন্তানদের অবস্থান জানা ও তাদের খোঁজ-খবর রাখতে হচ্ছে। শুধু ইয়াসমিন আক্তারই নয়, নানা শ্রেণি-পেশার কোটি পরিবার অজানা আতঙ্কে দিনযাপন করছেন রাজধানীর মেগা সিটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। কেউ কেউ বলছেন, ভূমিকম্প হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মহান আল্লাহপাকই সবকিছু ভালো জানেন। তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, রাজউকের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এবং ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) সবগুলোই কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ড অনুসরণ করে। এর মধ্যে রয়েছে, মাটির পরীক্ষা, বিল্ডিংয়ের সীমানা নির্ধারণ, স্ট্রাকচারাল লোড হিসাব এবং স্বীকৃত নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের নিয়ম। তবে এসব বিষয় যে নিয়মিতভাবে উপেক্ষা করা হয়, তা স্বীকার করেছেন খোদ রাজউকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক প্রকৌশলী বলেন, এখন আর প্রকৌশলগত মানদণ্ড নয়, বরং দরকষাকষিই মুখ্য। তিনি বলেন, এখন আর অনুমোদন বা নিয়ম মানার ওপর কোনও কিছু নির্ভর করে না। রাজউক কার্যালয়ে অঘোষিতভাবে এটা নিলাম হয়ে গেছে। দুর্নীতিই ঠিক করে ফাইল কত দ্রুত এগোবে বা এগোবে না। রাজউকের ভেতরকার দালালচক্র অর্থের বিনিময়ে ফাইলের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। রাজউকের অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্বৈত গতিতে কাজ করে। প্রভাবশালী ডেভেলপাররা অনুমোদন পায় দ্রুত, আর সাধারণ ভবনের মালিকদের মোকাবিলা করতে হয় বিলম্ব, জটিলতা ও ঘুষের দাবির সঙ্গে। বহু কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, নিয়ম না মানার কারণে অনেক চিহ্নিত ভবন পরে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ অনুমোদন পায়।
সবুজ বাংলার সাথে কথা হয় ভবন নির্মাতা কবির হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, অহিদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও আল-আমিনসহ আরও অন্তত ১০ জনের। তারা জানান, কাগজপত্র একদম ঠিক থাকলেও রাজউকে দালাল ছাড়া ফাইল এগোয় না। কমিশন না দিলে মাসের পর মাস পেরিয়ে বছর লাগে। সঠিক লোক থাকলে এক সপ্তাহেই হয়ে যায়। তা না হলে রাজউকের বিভিন্ন টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়।
রাজউক ও বিশ্বব্যাংকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে, যা ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশ। ওই মাত্রার ভূমিকম্প দিনে হলে কমপক্ষে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে। আর রাতে হলে কমপক্ষে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যাবে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের শক্তিশালী কম্পন অনুভব করেছেন ঢাকার ১ কোটির বেশি মানুষ। এছাড়া ৭ কোটির বেশি মানুষ মৃদু ভূকম্পন অনুভব করেছেন। আর হালকা ঝাঁকুনি পেয়েছেন আরও প্রায় পৌনে ৭ কোটি মানুষ। এ ভূমিকম্পকে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী কমলা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউএসজিএস। এর মানে হলো, এমন ভূমিকম্পে উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে।
নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন অন্তত একটি বড় নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। অনেক ভবনের অনুমোদিত তলার সংখ্যা অতিক্রম করে অতিরিক্ত তলা যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া খরচ কমাতে ভিত্তি নকশায় পরিবর্তন করা হয়। ফলাফল, এসব ভবন মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও সহ্য করতে অক্ষম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই দিনের ভূমিকম্পটি আরও শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী ঘটনার পূর্বাভাস হতে পারে। কারণ সক্রিয় তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ। দেশের আশপাশে মূলত তিনটি টেকটনিক প্লেট এসে মিলিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ভারতীয় প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মিজ মাইক্রোপ্লেট। এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান। যা এ অঞ্চলকে অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ করে তুলেছে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর বর্তমান অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা জানান, ঢাকায় ভূমিকম্প ঝুঁকির নেপথ্যেই রাজউকের অনিয়ম-দুর্নীতি! রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুর্নীতি, নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই ঢাকার কাঠামোগত ঝুঁকিকে বিপজ্জনকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্প প্রাকৃতিক হলেও ঢাকার ঝুঁকির বড় অংশই মানুষের তৈরি।
বিশেষজ্ঞরা ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকির মানচিত্রে প্রথমত-পুরান ঢাকা, আফতাবনগর, বাড্ডা, রামপুরা ও বসুন্ধরাকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ (লাল অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দ্বিতীয়ত- মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি ও উত্তরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (কমলা অঞ্চল), আর তৃতীয়ত- টঙ্গী, সাভার ও পূর্বাচলের কিছু অংশ মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ (হলুদ অঞ্চল) হিসেবে বিবেচিত। বড় ভূমিকম্পের সময় এসব এলাকার ঢিলা মাটি তরলের মতো আচরণ করতে পারে, ফলে ভবন হেলে পড়া, ডুবে যাওয়া বা সম্পূর্ণ ধসের ঝুঁকি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিপর্যয় এখনও রোধ করা সম্ভব। তবে তা সম্ভব কেবল তখনই, যদি রাজউক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সংস্কার অবিলম্বে শুরু হয়। তারা আহ্বান জানিয়েছেন, অনুমোদন প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা, দালালচক্র দমন, বিএনবিসি কঠোরভাবে প্রয়োগ, স্বাধীন নজরদারি নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রেট্রোফিটিং (ভবন বা কাঠামোকে নতুন বা উন্নত প্রযুক্তি, নকশা বা সামগ্রী ব্যবহার করে শক্তিশালী করা) এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনীতিমুক্ত করা।
এর আগে, ২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি ও জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে ৭ কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।
২০১৬ সালে এক গবেষণায় ভূমিকম্প গবেষক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেছিলেন, ভূমিকম্পে ঢাকা মেট্রোপলিটনের এক শতাংশ ভবনও যদি বিধ্বস্ত হয়, তাহলে ৬০০০ ভবন বিধ্বস্ত হবে। ফলে অন্তত ৩ লাখ মানুষ সরাসরি হতাহত হবেন। আর ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও সেবার কাজ পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আরও বহু মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকা এখন পুরোপুরি লাল-ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি অনিয়ন্ত্রিত ভবন এই শহরের ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের সংস্কারের সুযোগ দেয়, কিন্তু রাজউক কখনও এসব থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা তদন্ত করে, রিপোর্ট দেয়, তারপর ভুলে যায়। আর এই সময়েই বেড়ে ওঠে অনিরাপদ ভবনগুলো।
এদিকে আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেছেন, সম্প্রতি কয়েক দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৩০০টি ছোট-বড় ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সমন্বিতভাবে কাজ না করা গেলে ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রিয়াজুল ইসলাম বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজউকে অর্থের বিনিময়ে কোনও কাজ হয় না। রাজউক কাউকে প্ল্যান করে দেয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাড়িওয়ালারাই ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট দিয়ে বাড়ির প্ল্যান করে রাজউকে জমা দেয় এই শর্তে যে রাজউকের নিয়ম মোতাবেক করবেন। পরে তারা সেটা না মানলে জরিমানা কিংবা শাস্তি দিতে হলে সেই বাড়িওয়ালাদেরই দেওয়া উচিত। এর দায়ভার রাজউকের না। সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিস আলাদাভাবে কাজ করায় সব বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, ভূতত্ত্ববিদ ও সরকার অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি, প্রস্তুতি, সমন্বয় এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এসব তথ্য জানান।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী। এতে উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে বাবা-ছেলেসহ পাঁচজন, ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে এক শিশুসহ তিন জেলায় মোট ১০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েকশ মানুষ। এর পরদিন ৩১ ঘন্টার ব্যবধানে ঢাকার বাড্ডা ও নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় পরপর তিনদফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

ঈদগাঁওয়ে ৪৯ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই বিতরণের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম শুরু

ঢাকায় ভূমিকম্প ঝুঁকির নেপথ্যে রাজউকের অনিয়ম-দুর্নীতি!

আপডেট সময় : ০৯:১৬:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
  • ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে কাটছে না আতঙ্ক
  • রাজধানীতে ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত
  • ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

‘প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের সংস্কারের সুযোগ দেয়, কিন্তু রাজউক কখনও এসব থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা তদন্ত করে, রিপোর্ট দেয়, তারপর ভুলে যায়। আর এই সময়েই বেড়ে ওঠে অনিরাপদ ভবন’
– অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
‘ঢাকা এখন পুরোপুরি লাল-ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি অনিয়ন্ত্রিত ভবন এই শহরের ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে। মানুষকে ভূমিকম্প মারে না। মারে দুর্নীতি, অবহেলা ও দুর্বল ভবনে’
– অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
‘যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজউকে অর্থের বিনিময়ে কোনও কাজ হয় না। ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে’
– প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, রাজউক

ঢাকার অদুরে নরসিংদীতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। এই কম্পনের ৩১ ঘণ্টার মধ্যেই আরও তিনবার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এর মাধ্যমে আবারও আলোচনার সামনে এসেছে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর মেগা সিটি ঢাকা। টানা ৩১ ঘন্টার ব্যবধানে ঢাকা ও নরসিংদীতে পরপর চারদফা ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় এখনও জনমনে আতঙ্ক কাটেনি। জীবন যুদ্ধে জীবিকার তাগিদে নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস নিয়ে অজানা আতঙ্কে দিনযাপন করছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সপরিবারে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে বসবাস করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন কর্মজীবীরা। এদিকে ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদদের ডেকে জরুরি বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় ভূমিকম্পের ঝুঁকি, প্রস্তুতি, সমন্বয়, পরামর্শ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করাসহ করণীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রকৌশলী ও নগর-পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর নেপথ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনিয়ম-দুর্নীতি আর নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলেই ঢাকার কাঠামোগত ঝুঁকিকে বিপজ্জনকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্প প্রাকৃতিক হলেও ঢাকার ঝুঁকির বড় অংশই মানুষের তৈরি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদের মতে, প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের সংস্কারের সুযোগ দেয়, কিন্তু রাজউক কখনও এসব থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা তদন্ত করে, রিপোর্ট দেয়, তারপর ভুলে যায়। আর এই সময়েই বেড়ে ওঠে অনিরাপদ ভবন। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারীর মতে, ঢাকা এখন পুরোপুরি লাল-ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি অনিয়ন্ত্রিত ভবন এই শহরের ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে। মানুষকে ভূমিকম্প মারে না। মারে দুর্নীতি, অবহেলা ও দুর্বল ভবনে। এদিকে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজধানীতে ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে রাজউকের বিষয়ে যে অভিযোগ আসছে, তা তিনি নাকচ করে বলেছেন, রাজউক থেকে যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজউকে অর্থের বিনিময়ে কোনও কাজ হয় না। ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার কম্পনের কারণে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ১০ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন আরও শত শত মানুষ। ফাটল দেখা দিয়েছে বহু ভবনে। হেলেও পড়েছে কয়েকটি ভবন। গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্প রাজউকের সেই পদ্ধতিগত ব্যর্থতাগুলোই এখন আলোচনার সামনে উঠে আসছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী এলাকার কাছে, যা রাজধানীর মেগা সিটি ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। ৭ কোটির বেশি মানুষ ভয়াবহ এ ভূ-কম্পনটি অনুভব করেন। এছাড়া ঢাকায় এক কোটি মানুষের বেশি তীব্র কম্পন অনুভব করেন। তাদের অনেকেই আতঙ্কে অ্যাপার্টমেন্ট, হাসপাতাল এবং উচ্চ ভবনের অফিস-বাসা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন।
ভয়াবহ সেই মুহূর্তের বর্ণনা করে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা রিয়াদ সবুজ বাংলাকে বলেন, আমি তখন একটি সেলুনে বসে ছিলাম। প্রথমে মনে হচ্ছিল, দোকানি হয়তো চেয়ারে পা রেখে দোলাচ্ছিল। তখন দেখি- সেলুন দোকানি উল্টো আমাকে বলছে, আঙ্কেল- মনে হচ্ছে দেশের কোথাও ভূমিকম্প হচ্ছে। দোকানের বাকি চেয়ার ও সিলিং ফ্যান কাঁপছে। বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত দোকান থেকে আমরা সবাই দ্রুত বাইরে বের হয়ে যাই। তিনি বলেন, এই শহর ভূমিকম্প রক্ষায় এখনও প্রস্তুত নয়। এখনও যে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা যেন মহান আল্লাহর অলৌকিক রহমত।
পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা কর্মজীবী নারী ইয়াসমিন আক্তার সবুজ বাংলাকে বলেন, ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর থেকে এখনও আতঙ্কে রয়েছি। কর্মস্থলে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হচ্ছে। তিনি বলেন, জীবনযুদ্ধে জীবিকার তাগিদেই সপরিবারে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই বসবাস করতে হচ্ছে। যখন কর্মস্থলে থাকি, তখন বাধ্য হয়ে ভিডিও কলে সন্তানদের অবস্থান জানা ও তাদের খোঁজ-খবর রাখতে হচ্ছে। শুধু ইয়াসমিন আক্তারই নয়, নানা শ্রেণি-পেশার কোটি পরিবার অজানা আতঙ্কে দিনযাপন করছেন রাজধানীর মেগা সিটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। কেউ কেউ বলছেন, ভূমিকম্প হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মহান আল্লাহপাকই সবকিছু ভালো জানেন। তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, রাজউকের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এবং ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) সবগুলোই কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ড অনুসরণ করে। এর মধ্যে রয়েছে, মাটির পরীক্ষা, বিল্ডিংয়ের সীমানা নির্ধারণ, স্ট্রাকচারাল লোড হিসাব এবং স্বীকৃত নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের নিয়ম। তবে এসব বিষয় যে নিয়মিতভাবে উপেক্ষা করা হয়, তা স্বীকার করেছেন খোদ রাজউকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক প্রকৌশলী বলেন, এখন আর প্রকৌশলগত মানদণ্ড নয়, বরং দরকষাকষিই মুখ্য। তিনি বলেন, এখন আর অনুমোদন বা নিয়ম মানার ওপর কোনও কিছু নির্ভর করে না। রাজউক কার্যালয়ে অঘোষিতভাবে এটা নিলাম হয়ে গেছে। দুর্নীতিই ঠিক করে ফাইল কত দ্রুত এগোবে বা এগোবে না। রাজউকের ভেতরকার দালালচক্র অর্থের বিনিময়ে ফাইলের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। রাজউকের অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্বৈত গতিতে কাজ করে। প্রভাবশালী ডেভেলপাররা অনুমোদন পায় দ্রুত, আর সাধারণ ভবনের মালিকদের মোকাবিলা করতে হয় বিলম্ব, জটিলতা ও ঘুষের দাবির সঙ্গে। বহু কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, নিয়ম না মানার কারণে অনেক চিহ্নিত ভবন পরে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ অনুমোদন পায়।
সবুজ বাংলার সাথে কথা হয় ভবন নির্মাতা কবির হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, অহিদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও আল-আমিনসহ আরও অন্তত ১০ জনের। তারা জানান, কাগজপত্র একদম ঠিক থাকলেও রাজউকে দালাল ছাড়া ফাইল এগোয় না। কমিশন না দিলে মাসের পর মাস পেরিয়ে বছর লাগে। সঠিক লোক থাকলে এক সপ্তাহেই হয়ে যায়। তা না হলে রাজউকের বিভিন্ন টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়।
রাজউক ও বিশ্বব্যাংকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে, যা ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশ। ওই মাত্রার ভূমিকম্প দিনে হলে কমপক্ষে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে। আর রাতে হলে কমপক্ষে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যাবে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের শক্তিশালী কম্পন অনুভব করেছেন ঢাকার ১ কোটির বেশি মানুষ। এছাড়া ৭ কোটির বেশি মানুষ মৃদু ভূকম্পন অনুভব করেছেন। আর হালকা ঝাঁকুনি পেয়েছেন আরও প্রায় পৌনে ৭ কোটি মানুষ। এ ভূমিকম্পকে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী কমলা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউএসজিএস। এর মানে হলো, এমন ভূমিকম্পে উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে।
নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন অন্তত একটি বড় নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। অনেক ভবনের অনুমোদিত তলার সংখ্যা অতিক্রম করে অতিরিক্ত তলা যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া খরচ কমাতে ভিত্তি নকশায় পরিবর্তন করা হয়। ফলাফল, এসব ভবন মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও সহ্য করতে অক্ষম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই দিনের ভূমিকম্পটি আরও শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী ঘটনার পূর্বাভাস হতে পারে। কারণ সক্রিয় তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ। দেশের আশপাশে মূলত তিনটি টেকটনিক প্লেট এসে মিলিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ভারতীয় প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মিজ মাইক্রোপ্লেট। এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান। যা এ অঞ্চলকে অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ করে তুলেছে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর বর্তমান অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা জানান, ঢাকায় ভূমিকম্প ঝুঁকির নেপথ্যেই রাজউকের অনিয়ম-দুর্নীতি! রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুর্নীতি, নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই ঢাকার কাঠামোগত ঝুঁকিকে বিপজ্জনকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্প প্রাকৃতিক হলেও ঢাকার ঝুঁকির বড় অংশই মানুষের তৈরি।
বিশেষজ্ঞরা ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকির মানচিত্রে প্রথমত-পুরান ঢাকা, আফতাবনগর, বাড্ডা, রামপুরা ও বসুন্ধরাকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ (লাল অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দ্বিতীয়ত- মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি ও উত্তরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (কমলা অঞ্চল), আর তৃতীয়ত- টঙ্গী, সাভার ও পূর্বাচলের কিছু অংশ মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ (হলুদ অঞ্চল) হিসেবে বিবেচিত। বড় ভূমিকম্পের সময় এসব এলাকার ঢিলা মাটি তরলের মতো আচরণ করতে পারে, ফলে ভবন হেলে পড়া, ডুবে যাওয়া বা সম্পূর্ণ ধসের ঝুঁকি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিপর্যয় এখনও রোধ করা সম্ভব। তবে তা সম্ভব কেবল তখনই, যদি রাজউক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সংস্কার অবিলম্বে শুরু হয়। তারা আহ্বান জানিয়েছেন, অনুমোদন প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা, দালালচক্র দমন, বিএনবিসি কঠোরভাবে প্রয়োগ, স্বাধীন নজরদারি নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রেট্রোফিটিং (ভবন বা কাঠামোকে নতুন বা উন্নত প্রযুক্তি, নকশা বা সামগ্রী ব্যবহার করে শক্তিশালী করা) এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনীতিমুক্ত করা।
এর আগে, ২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি ও জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে ৭ কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।
২০১৬ সালে এক গবেষণায় ভূমিকম্প গবেষক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেছিলেন, ভূমিকম্পে ঢাকা মেট্রোপলিটনের এক শতাংশ ভবনও যদি বিধ্বস্ত হয়, তাহলে ৬০০০ ভবন বিধ্বস্ত হবে। ফলে অন্তত ৩ লাখ মানুষ সরাসরি হতাহত হবেন। আর ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও সেবার কাজ পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আরও বহু মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকা এখন পুরোপুরি লাল-ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি অনিয়ন্ত্রিত ভবন এই শহরের ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের সংস্কারের সুযোগ দেয়, কিন্তু রাজউক কখনও এসব থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা তদন্ত করে, রিপোর্ট দেয়, তারপর ভুলে যায়। আর এই সময়েই বেড়ে ওঠে অনিরাপদ ভবনগুলো।
এদিকে আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেছেন, সম্প্রতি কয়েক দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৩০০টি ছোট-বড় ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সমন্বিতভাবে কাজ না করা গেলে ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রিয়াজুল ইসলাম বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। রাজউকে অর্থের বিনিময়ে কোনও কাজ হয় না। রাজউক কাউকে প্ল্যান করে দেয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাড়িওয়ালারাই ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট দিয়ে বাড়ির প্ল্যান করে রাজউকে জমা দেয় এই শর্তে যে রাজউকের নিয়ম মোতাবেক করবেন। পরে তারা সেটা না মানলে জরিমানা কিংবা শাস্তি দিতে হলে সেই বাড়িওয়ালাদেরই দেওয়া উচিত। এর দায়ভার রাজউকের না। সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিস আলাদাভাবে কাজ করায় সব বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, ভূতত্ত্ববিদ ও সরকার অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি, প্রস্তুতি, সমন্বয় এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এসব তথ্য জানান।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী। এতে উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে বাবা-ছেলেসহ পাঁচজন, ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে এক শিশুসহ তিন জেলায় মোট ১০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েকশ মানুষ। এর পরদিন ৩১ ঘন্টার ব্যবধানে ঢাকার বাড্ডা ও নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় পরপর তিনদফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

এমআর/সবা