০৩:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভূমি বিরোধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত, পার্বত্য চুক্তি এখনো অসম্পূর্ণ

রাষ্ট্র চুক্তির মূল লক্ষ্য পাহাড়িদের ন্যায়বিচার ও ভূমি সংকট সমাধান থেকে সরে গিয়ে বিশেষ শাসনব্যবস্থা ও বাঙালি পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলে আদিবাসীদের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় ২৮ বছরেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

সোমবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন সংগঠনের নেতারা।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন সদস্য দীপায়ন খীসা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন।

জাকির হোসেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আদিবাসী অধ্যুষিত, বহু-ভাষী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সংবিধানে তাদের পরিচয় অস্বীকার করার ঐতিহাসিক ভুলের কারণে জুম্ম জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত, ভূমি বিরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পুনর্বাসনের অভাব পাহাড়িদের জীবনকে কঠিন করেছে।

তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বৈষম্য এবং শোষণ অব্যাহত আছে।

তিনি বলেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা বারবার স্থগিত হওয়া, টাস্কফোর্সের কার্যক্রম আটকে যাওয়া এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগে সাম্প্রদায়িক শক্তির বাধা সবই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বড় অন্তরায়।

জাকির হোসেন আরও বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো শুধু পাহাড়িদেরই নয়, স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায়েরও অধিকার ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। তাই পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জাতীয় নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং দেশীয় ঐক্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে চুক্তির মূল লক্ষ্য পাহাড়িদের ন্যায়বিচার, ভূমি সমাধান এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা সুনিশ্চিত করতে হবে।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চুক্তির যে, অংশগুলো বাস্তবায়নের দাবি করা হয় সেগুলোর বাস্তব কার্যকারিতা নেই। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের জায়গা না পাওয়া হতাশাজনক।

তিনি বলেন, পাহাড়ে আজও বিশেষ শাসনব্যবস্থা ও সেনা-নিয়ন্ত্রিত বাস্তবতা বিরাজমান। সেনাবাহিনী জুলাই আন্দোলনে যেমন ভূমিকা রেখেছিল, তেমনভাবেই পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বিশেষ সমস্যা’ হিসেবে দেখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নটি কখনোই দেশের মূলধারার গণতান্ত্রিক আলোচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি; বরং দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থেকেছে।

তিনি বলেন, চুক্তির লক্ষ্য ছিল ভূমি বিরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দীর্ঘ সংঘাতের সমাধান, কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র চুক্তির মূল পথে না হাঁটায় পাহাড়ি আদিবাসীরা মানবিক সংকটে পড়েছে এবং স্থানীয় বাঙালিরাও বিভিন্ন বঞ্চনার শিকার। তাঁর মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয় এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি তিন দফা দাবি তুলে ধরেন—
১. চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নিয়ে জাতীয় সংলাপ আয়োজন;
২. একটি কার্যকর রোডম্যাপ ঘোষণা ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ;
৩. আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সব দলের ইশতেহারে চুক্তি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য প্রণব কুমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ।

শু/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

ভূমি বিরোধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত, পার্বত্য চুক্তি এখনো অসম্পূর্ণ

আপডেট সময় : ০৫:০৫:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫

রাষ্ট্র চুক্তির মূল লক্ষ্য পাহাড়িদের ন্যায়বিচার ও ভূমি সংকট সমাধান থেকে সরে গিয়ে বিশেষ শাসনব্যবস্থা ও বাঙালি পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলে আদিবাসীদের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় ২৮ বছরেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

সোমবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন সংগঠনের নেতারা।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন সদস্য দীপায়ন খীসা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন।

জাকির হোসেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আদিবাসী অধ্যুষিত, বহু-ভাষী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সংবিধানে তাদের পরিচয় অস্বীকার করার ঐতিহাসিক ভুলের কারণে জুম্ম জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত, ভূমি বিরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পুনর্বাসনের অভাব পাহাড়িদের জীবনকে কঠিন করেছে।

তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বৈষম্য এবং শোষণ অব্যাহত আছে।

তিনি বলেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা বারবার স্থগিত হওয়া, টাস্কফোর্সের কার্যক্রম আটকে যাওয়া এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগে সাম্প্রদায়িক শক্তির বাধা সবই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বড় অন্তরায়।

জাকির হোসেন আরও বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো শুধু পাহাড়িদেরই নয়, স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায়েরও অধিকার ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। তাই পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জাতীয় নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং দেশীয় ঐক্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে চুক্তির মূল লক্ষ্য পাহাড়িদের ন্যায়বিচার, ভূমি সমাধান এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা সুনিশ্চিত করতে হবে।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চুক্তির যে, অংশগুলো বাস্তবায়নের দাবি করা হয় সেগুলোর বাস্তব কার্যকারিতা নেই। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের জায়গা না পাওয়া হতাশাজনক।

তিনি বলেন, পাহাড়ে আজও বিশেষ শাসনব্যবস্থা ও সেনা-নিয়ন্ত্রিত বাস্তবতা বিরাজমান। সেনাবাহিনী জুলাই আন্দোলনে যেমন ভূমিকা রেখেছিল, তেমনভাবেই পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বিশেষ সমস্যা’ হিসেবে দেখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নটি কখনোই দেশের মূলধারার গণতান্ত্রিক আলোচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি; বরং দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থেকেছে।

তিনি বলেন, চুক্তির লক্ষ্য ছিল ভূমি বিরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দীর্ঘ সংঘাতের সমাধান, কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র চুক্তির মূল পথে না হাঁটায় পাহাড়ি আদিবাসীরা মানবিক সংকটে পড়েছে এবং স্থানীয় বাঙালিরাও বিভিন্ন বঞ্চনার শিকার। তাঁর মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয় এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি তিন দফা দাবি তুলে ধরেন—
১. চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নিয়ে জাতীয় সংলাপ আয়োজন;
২. একটি কার্যকর রোডম্যাপ ঘোষণা ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ;
৩. আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সব দলের ইশতেহারে চুক্তি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য প্রণব কুমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ।

শু/সবা