০১:২৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘গুড গভর্নেন্স’ ও ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ সময়ের দাবি

বাংলাদেশ জন্মের ৫৪ বছর অতিবাহিত। সুশাসন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাল-সবুজের এ দেশটির জন্ম। গত পাঁচদশকেও কাঙ্খিত সুশাসন পায়নি দেশের জনগণ। নানা উত্থান-পতনে বিভিন্ন সময়ে এ দেশেশাসকরা আসছেন, গেছেন; কারো শাসনামলের নীতি-আদর্শকে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রেরসুশাসনব্যবস্থার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায়নি। আপামর জনগণের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার গল্পই যেন বেশি। অনিয়ম-দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অপশাসন, হিংসা-বিদ্বেষ, বিভেদ-বিভাজন নিয়েঅপরাজনীতি এবং দেশি-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রের ভয়ঙ্কর খেলায় নিমজ্জিত দেশটির অগ্রযাত্রা যে কারণে বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
জনগণের আস্থা-বিশ্বাসে আঘাত, মৌলিক অধিকার হরণ, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মহোৎসব, অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের মাঝে সুশাসন চরমভাবে উপেক্ষিত, সরকার আর জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধে ন্যায্যতার অভাব, কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের আগ্রাসী ভূমিকার মধ্য দিয়েই বিগত ৫৩টি বছর অতিক্রম করে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখানো হয়। যে বাংলাদেশে জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকরা‘গুড গভর্নেন্স’ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। তারা জবাবদিহিতায় থাকবেন। সর্বস্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে সুশাসন স্থাপন করবেন। সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকারীকে নিবৃত্ত না করে তাদের জানাবেন স্বাগত। সরকার পক্ষমিডিয়ার কণ্ঠরোধ না করে দেবেন পূর্ণ স্বাধীনতা। আর সংবাদ মাধ্যমগুলোকেও শাসকগোষ্ঠীর আস্থা-আনুকূল্যে হারিয়ে না গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ এবং পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে করতে হবে‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ বা সমালোচনামূলক, বিশ্লেষণধর্মী সাংবাদিকতা। যা একটি ‘গুড গভর্নেন্স’ রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হতে পারে।বলতে গেলে, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘গুড গভর্নেন্স’ ও ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি।
গত ২১ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ উপলক্ষে গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায়‘গুড গভর্নেন্স’ ও ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ ইস্যুতে স্পষ্ট বক্তব্য দেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো সরকারই প্রকৃত অর্থে সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা গ্রহণ করেনি, এমন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে নতুন বাংলাদেশে স্বাধীন ও সমালোচনামূলক গণমাধ্যম মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।মাহফুজ আনাম বলেন, সত্যিকার অর্থে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন ধরনের মিডিয়া পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। তাঁর মতে, তারেক রহমানের জন্য এটি একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সময়। কারণ, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে একধরনের ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থার মধ্যে আছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে একটি সম্মানজনক ও দায়িত্বশীল সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম। তিনি আরও বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু প্রথম ধাপ, কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ বা সমালোচনামূলক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এটি শুধু সাংবাদিকতার স্বাধীনতার বিষয় নয়, বরং সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। তাঁর ভাষায়, ‘আপনি যদি সত্য কথা শুনতে না চান, তাহলে আপনি ভুল করবেন এবং সেই ভুল বারবার করবেন।’
‘গুড গভর্নেন্স’ বলতে যা বোঝায়
গুড গভর্নেন্স (এড়ড়ফ এড়াবৎহধহপব) বলতে এমন শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনা হয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে, যাতে সমাজের সব স্তরের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়।সহজভাবে বললে, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে, ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হওয়া সরকার।অর্থাৎ, গুড গভর্নেন্স বা সুশাসন একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। গুড গভর্নেন্সের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে আস্থা, ন্যায়বিচার এবং দায়িত্ববোধের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা একটি শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে সহায়ক।
গুড গভর্নেন্সের মূল লক্ষ্য হলো স্বচ্ছ ও কার্যকর প্রশাসন নিশ্চিত করা। যখন সরকারের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখন দুর্নীতি ও অনিয়ম কমে আসে। একই সঙ্গে শাসক ও প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়। এতে জনগণ রাষ্ট্রের ওপর আস্থা রাখতে পারে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় হয়।আইনের শাসন গুড গভর্নেন্সের ক্ষেত্রেও একটি অপরিহার্য অংশ। একটি সুশাসিত রাষ্ট্রে সবাই আইনের চোখে সমান এবং কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকে না। এর ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পায়। পাশাপাশি নাগরিকদের মতামত ও অংশগ্রহণ রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জনগণ যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, তখন নীতিনির্ধারণ আরও বাস্তবসম্মত ও জনগণমুখী হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুড গভর্নেন্সের গুরুত্ব আরও বেশি। উন্নয়ন কার্যক্রমকে টেকসই করতে, দারিদ্র্য হ্রাস করতে এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সুশাসনের বিকল্প নেই। যদিও নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, তবুও প্রশাসনিক সংস্কার, ডিজিটাল সেবা ও সচেতন নাগরিক সমাজ গুড গভর্নেন্স বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, গুড গভর্নেন্স কেবল একটি ধারণা নয়, বরং একটি কার্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত। সুশাসন নিশ্চিত হলে একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়, সামাজিকভাবে স্থিতিশীল থাকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও ন্যায্য সমাজ গড়ে ওঠে।
‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ কী?
বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম শুধু তথ্য জানানোর মাধ্যম নয়, বরং সমাজকে সচেতন করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এই প্রেক্ষাপটে ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ বা সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি এমন এক ধরনের সাংবাদিকতা যেখানে খবরের পৃষ্ঠতলে থেমে না থেকে গভীরে গিয়ে সত্য অনুসন্ধান করা হয়।ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা নীতিনির্ধারকদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করা এবং প্রয়োজনে প্রশ্ন তোলা। এখানে সাংবাদিক কেবল ‘কি ঘটেছে’ তা জানান না, বরং ‘কেন ঘটেছে’, ‘কার স্বার্থ জড়িত’, এবং ‘এর প্রভাব সমাজের উপর কী’ এসব বিষয় খতিয়ে দেখেন। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ একটি ঘটনার পূর্ণ চিত্র বুঝতে পারেন।এই ধরনের সাংবাদিকতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষতা ও প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ। ক্রিটিক্যাল সাংবাদিকরা তথ্য যাচাই করেন, একাধিক সূত্র ব্যবহার করেন এবং গুজব বা অসম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন। তারা প্রভাবশালী মহলের চাপ উপেক্ষা করে সত্য প্রকাশের চেষ্টা করেন, যা অনেক সময় সাহসিকতার দাবি রাখে।
সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে সুশাসন এবং গণতন্ত্রের জন্য ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ অত্যন্ত জরুরি বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এটি সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় সহায়তা করে। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশ ধ্বংস বা সামাজিক বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো সামনে আনার ক্ষেত্রে এই সাংবাদিকতা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে এটি সত্য, ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের পথ সহজ নয়। বিগত সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি, রাজনৈতিক চাপ এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি সাংবাদিকদের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। তবুও সমাজ-রাষ্ট্র এবং আপামর জনসাধরণেরকল্যাণে এই সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখা সময়ের দাবি।
গুড গভর্নেন্স ও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের সম্পর্ক
গুড গভর্নেন্স ও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম একে অপরের পরিপূরক ও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত দুটি ধারণা। একটি কার্যকর ও জনগণমুখী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে যেমন সুশাসন প্রয়োজন, তেমনি সেই সুশাসন নিশ্চিত ও টেকসই করতে সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুড গভর্নেন্সের মূল ভিত্তি হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন। ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম এসব মূল্যবোধ বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকরা যখন সরকারের নীতি, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতাবানদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে জনগণের সামনে তুলে ধরেন, তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা বাড়ে এবং শাসকগোষ্ঠী জবাবদিহিতার আওতায় আসেন।
ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে। এটি সমাজের নানা সমস্যা, অনিয়ম ও দুর্নীতিকে সামনে আনে, যা গুড গভর্নেন্সের পথে বড় বাধা। এসব প্রতিবেদন রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সংস্কার গ্রহণে বাধ্য করে এবং ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। ফলে গুড গভর্নেন্স কেবল একটি আইডিয়া হিসেবে না থেকে বাস্তব রূপ পায়।
অন্যদিকে, গুড গভর্নেন্স ছাড়া ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম টেকসই হতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়। সুশাসন সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী করে তোলে।
মোট কথা, গুড গভর্নেন্স ও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম একটি পারস্পরিক নির্ভরশীল সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ। ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম গুড গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে অপরদিকে গুড গভর্নেন্স আবার এই সাংবাদিকতাকে বিকশিত হওয়ার উপযোগী পরিবেশ দেয়। একটি সচেতন, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে এই দুইয়ের সম্মিলিত ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশে ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের প্রয়োজনীয়তা কেন?
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে অগ্রসর হচ্ছে। এই অগ্রযাত্রাকে টেকসই ও জনগণমুখী করতে গণমাধ্যমের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম বা সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অপরিহার্য।
প্রথমত. জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম প্রয়োজন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার, প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা এসব সিদ্ধান্তের পেছনের উদ্দেশ্য, কার্যকারিতা ও সম্ভাব্য ক্ষতি বিশ্লেষণ করে ক্ষমতাবানদের জবাবদিহির আওতায় আনে।
দ্বিতীয়ত. দুর্নীতি ও অনিয়ম উন্মোচনে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বড় সামাজিক সমস্যা। অনুসন্ধানমূলক ও ক্রিটিক্যাল সাংবাদিকতা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরে, যা প্রশাসনিক সংস্কার ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
তৃতীয়ত. গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম অপরিহার্য। একটি কার্যকর গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহ জরুরি। সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা নাগরিকদের সঠিক তথ্য দেয়, ফলে সচেতনভাবে মতামত গঠন ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
চতুর্থত. ভুয়া তথ্য ও অপপ্রচার মোকাবিলায় ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের প্রয়োজন বাড়ছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তথ্য যাচাই-বাছাই, প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ ও সত্য তুলে ধরার মাধ্যমে এই সাংবাদিকতা সমাজকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখতে পারে।
পঞ্চমত.সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষায় এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারী নির্যাতন, শ্রমিক অধিকার, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন সমাজের বিবেককে নাড়া দেয় এবং পরিবর্তনের নতুন পথ তৈরি করতে পারে।
উপসংহার :‘গুড গভর্নেন্স’ কোনো একক উদ্যোগের ফল নয়; এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকার, প্রশাসন, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য গুড গভর্নেন্স অপরিহার্য। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন ও সচেতন সমাজ গঠনের জন্যেও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি কেবল সাংবাদিকতার একটি ধারা নয়, বরং জনগণের কণ্ঠস্বর ও গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তিও বটে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

‘গুড গভর্নেন্স’ ও ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ সময়ের দাবি

আপডেট সময় : ০৬:২১:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ জন্মের ৫৪ বছর অতিবাহিত। সুশাসন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাল-সবুজের এ দেশটির জন্ম। গত পাঁচদশকেও কাঙ্খিত সুশাসন পায়নি দেশের জনগণ। নানা উত্থান-পতনে বিভিন্ন সময়ে এ দেশেশাসকরা আসছেন, গেছেন; কারো শাসনামলের নীতি-আদর্শকে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রেরসুশাসনব্যবস্থার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায়নি। আপামর জনগণের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার গল্পই যেন বেশি। অনিয়ম-দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অপশাসন, হিংসা-বিদ্বেষ, বিভেদ-বিভাজন নিয়েঅপরাজনীতি এবং দেশি-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রের ভয়ঙ্কর খেলায় নিমজ্জিত দেশটির অগ্রযাত্রা যে কারণে বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
জনগণের আস্থা-বিশ্বাসে আঘাত, মৌলিক অধিকার হরণ, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মহোৎসব, অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের মাঝে সুশাসন চরমভাবে উপেক্ষিত, সরকার আর জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধে ন্যায্যতার অভাব, কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের আগ্রাসী ভূমিকার মধ্য দিয়েই বিগত ৫৩টি বছর অতিক্রম করে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখানো হয়। যে বাংলাদেশে জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকরা‘গুড গভর্নেন্স’ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। তারা জবাবদিহিতায় থাকবেন। সর্বস্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে সুশাসন স্থাপন করবেন। সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকারীকে নিবৃত্ত না করে তাদের জানাবেন স্বাগত। সরকার পক্ষমিডিয়ার কণ্ঠরোধ না করে দেবেন পূর্ণ স্বাধীনতা। আর সংবাদ মাধ্যমগুলোকেও শাসকগোষ্ঠীর আস্থা-আনুকূল্যে হারিয়ে না গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ এবং পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে করতে হবে‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ বা সমালোচনামূলক, বিশ্লেষণধর্মী সাংবাদিকতা। যা একটি ‘গুড গভর্নেন্স’ রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হতে পারে।বলতে গেলে, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘গুড গভর্নেন্স’ ও ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি।
গত ২১ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ উপলক্ষে গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায়‘গুড গভর্নেন্স’ ও ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ ইস্যুতে স্পষ্ট বক্তব্য দেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো সরকারই প্রকৃত অর্থে সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা গ্রহণ করেনি, এমন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে নতুন বাংলাদেশে স্বাধীন ও সমালোচনামূলক গণমাধ্যম মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।মাহফুজ আনাম বলেন, সত্যিকার অর্থে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন ধরনের মিডিয়া পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। তাঁর মতে, তারেক রহমানের জন্য এটি একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সময়। কারণ, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে একধরনের ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থার মধ্যে আছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে একটি সম্মানজনক ও দায়িত্বশীল সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম। তিনি আরও বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু প্রথম ধাপ, কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ বা সমালোচনামূলক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এটি শুধু সাংবাদিকতার স্বাধীনতার বিষয় নয়, বরং সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। তাঁর ভাষায়, ‘আপনি যদি সত্য কথা শুনতে না চান, তাহলে আপনি ভুল করবেন এবং সেই ভুল বারবার করবেন।’
‘গুড গভর্নেন্স’ বলতে যা বোঝায়
গুড গভর্নেন্স (এড়ড়ফ এড়াবৎহধহপব) বলতে এমন শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনা হয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে, যাতে সমাজের সব স্তরের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়।সহজভাবে বললে, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে, ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হওয়া সরকার।অর্থাৎ, গুড গভর্নেন্স বা সুশাসন একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। গুড গভর্নেন্সের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে আস্থা, ন্যায়বিচার এবং দায়িত্ববোধের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা একটি শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে সহায়ক।
গুড গভর্নেন্সের মূল লক্ষ্য হলো স্বচ্ছ ও কার্যকর প্রশাসন নিশ্চিত করা। যখন সরকারের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখন দুর্নীতি ও অনিয়ম কমে আসে। একই সঙ্গে শাসক ও প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়। এতে জনগণ রাষ্ট্রের ওপর আস্থা রাখতে পারে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় হয়।আইনের শাসন গুড গভর্নেন্সের ক্ষেত্রেও একটি অপরিহার্য অংশ। একটি সুশাসিত রাষ্ট্রে সবাই আইনের চোখে সমান এবং কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকে না। এর ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পায়। পাশাপাশি নাগরিকদের মতামত ও অংশগ্রহণ রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জনগণ যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, তখন নীতিনির্ধারণ আরও বাস্তবসম্মত ও জনগণমুখী হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুড গভর্নেন্সের গুরুত্ব আরও বেশি। উন্নয়ন কার্যক্রমকে টেকসই করতে, দারিদ্র্য হ্রাস করতে এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সুশাসনের বিকল্প নেই। যদিও নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, তবুও প্রশাসনিক সংস্কার, ডিজিটাল সেবা ও সচেতন নাগরিক সমাজ গুড গভর্নেন্স বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, গুড গভর্নেন্স কেবল একটি ধারণা নয়, বরং একটি কার্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত। সুশাসন নিশ্চিত হলে একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়, সামাজিকভাবে স্থিতিশীল থাকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও ন্যায্য সমাজ গড়ে ওঠে।
‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ কী?
বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম শুধু তথ্য জানানোর মাধ্যম নয়, বরং সমাজকে সচেতন করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এই প্রেক্ষাপটে ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ বা সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি এমন এক ধরনের সাংবাদিকতা যেখানে খবরের পৃষ্ঠতলে থেমে না থেকে গভীরে গিয়ে সত্য অনুসন্ধান করা হয়।ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা নীতিনির্ধারকদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করা এবং প্রয়োজনে প্রশ্ন তোলা। এখানে সাংবাদিক কেবল ‘কি ঘটেছে’ তা জানান না, বরং ‘কেন ঘটেছে’, ‘কার স্বার্থ জড়িত’, এবং ‘এর প্রভাব সমাজের উপর কী’ এসব বিষয় খতিয়ে দেখেন। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ একটি ঘটনার পূর্ণ চিত্র বুঝতে পারেন।এই ধরনের সাংবাদিকতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষতা ও প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ। ক্রিটিক্যাল সাংবাদিকরা তথ্য যাচাই করেন, একাধিক সূত্র ব্যবহার করেন এবং গুজব বা অসম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন। তারা প্রভাবশালী মহলের চাপ উপেক্ষা করে সত্য প্রকাশের চেষ্টা করেন, যা অনেক সময় সাহসিকতার দাবি রাখে।
সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে সুশাসন এবং গণতন্ত্রের জন্য ‘ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম’ অত্যন্ত জরুরি বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এটি সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় সহায়তা করে। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশ ধ্বংস বা সামাজিক বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো সামনে আনার ক্ষেত্রে এই সাংবাদিকতা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে এটি সত্য, ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের পথ সহজ নয়। বিগত সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি, রাজনৈতিক চাপ এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি সাংবাদিকদের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। তবুও সমাজ-রাষ্ট্র এবং আপামর জনসাধরণেরকল্যাণে এই সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখা সময়ের দাবি।
গুড গভর্নেন্স ও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের সম্পর্ক
গুড গভর্নেন্স ও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম একে অপরের পরিপূরক ও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত দুটি ধারণা। একটি কার্যকর ও জনগণমুখী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে যেমন সুশাসন প্রয়োজন, তেমনি সেই সুশাসন নিশ্চিত ও টেকসই করতে সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুড গভর্নেন্সের মূল ভিত্তি হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন। ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম এসব মূল্যবোধ বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকরা যখন সরকারের নীতি, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতাবানদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে জনগণের সামনে তুলে ধরেন, তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা বাড়ে এবং শাসকগোষ্ঠী জবাবদিহিতার আওতায় আসেন।
ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে। এটি সমাজের নানা সমস্যা, অনিয়ম ও দুর্নীতিকে সামনে আনে, যা গুড গভর্নেন্সের পথে বড় বাধা। এসব প্রতিবেদন রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সংস্কার গ্রহণে বাধ্য করে এবং ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। ফলে গুড গভর্নেন্স কেবল একটি আইডিয়া হিসেবে না থেকে বাস্তব রূপ পায়।
অন্যদিকে, গুড গভর্নেন্স ছাড়া ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম টেকসই হতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়। সুশাসন সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী করে তোলে।
মোট কথা, গুড গভর্নেন্স ও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম একটি পারস্পরিক নির্ভরশীল সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ। ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম গুড গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে অপরদিকে গুড গভর্নেন্স আবার এই সাংবাদিকতাকে বিকশিত হওয়ার উপযোগী পরিবেশ দেয়। একটি সচেতন, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে এই দুইয়ের সম্মিলিত ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশে ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের প্রয়োজনীয়তা কেন?
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে অগ্রসর হচ্ছে। এই অগ্রযাত্রাকে টেকসই ও জনগণমুখী করতে গণমাধ্যমের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম বা সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অপরিহার্য।
প্রথমত. জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম প্রয়োজন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার, প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা এসব সিদ্ধান্তের পেছনের উদ্দেশ্য, কার্যকারিতা ও সম্ভাব্য ক্ষতি বিশ্লেষণ করে ক্ষমতাবানদের জবাবদিহির আওতায় আনে।
দ্বিতীয়ত. দুর্নীতি ও অনিয়ম উন্মোচনে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বড় সামাজিক সমস্যা। অনুসন্ধানমূলক ও ক্রিটিক্যাল সাংবাদিকতা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরে, যা প্রশাসনিক সংস্কার ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
তৃতীয়ত. গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম অপরিহার্য। একটি কার্যকর গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহ জরুরি। সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা নাগরিকদের সঠিক তথ্য দেয়, ফলে সচেতনভাবে মতামত গঠন ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
চতুর্থত. ভুয়া তথ্য ও অপপ্রচার মোকাবিলায় ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের প্রয়োজন বাড়ছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তথ্য যাচাই-বাছাই, প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ ও সত্য তুলে ধরার মাধ্যমে এই সাংবাদিকতা সমাজকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখতে পারে।
পঞ্চমত.সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষায় এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারী নির্যাতন, শ্রমিক অধিকার, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন সমাজের বিবেককে নাড়া দেয় এবং পরিবর্তনের নতুন পথ তৈরি করতে পারে।
উপসংহার :‘গুড গভর্নেন্স’ কোনো একক উদ্যোগের ফল নয়; এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকার, প্রশাসন, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য গুড গভর্নেন্স অপরিহার্য। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন ও সচেতন সমাজ গঠনের জন্যেও ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি কেবল সাংবাদিকতার একটি ধারা নয়, বরং জনগণের কণ্ঠস্বর ও গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তিও বটে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক