পাপড় তৈরির একটি ঐতিহ্য বহন করে চলেছে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রাম। যদিও এ গ্রামটি পাপড় গ্রাম নামেই পরিচিতি পেয়েছে। এই গ্রামের প্রায় ৫শ’ পরিবার রয়েছে যারা এই পাপড় তৈরি, শুকানো, পরিবহন এবং মহাজনের কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করছে।
ছোট কিংবা বড়, সকলের কাছে মুখরোচক খাবার পাপড়। বিশেষ করে মেলার মাঠ, সিনেমা হলের সামনে, পূজা-পার্বনে, অস্থায়ী বাজার কিংবা ধর্মীয় উৎসব বা অনুষ্ঠানে পাপড় বিক্রির ধুম পড়ে। দামে স্বস্তা এ খাবারটি মুখরোচক হওয়ায় এর জনপ্রিয়তার কমতি নেই। সারা বছর জুড়েই পাপড় বিক্রি হতে দেখা যায় শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জে।
সরেজমিনে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণ ডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স মাঠে বেশ হাক ডাক নজর কাড়ে। প্রায় ১ লাখ বর্গফটের পুরো মাঠ জুড়ে পাপড় শুকানো হচ্ছে রোদে। সব বয়সের নারী-পুরুষ এ কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর যেগুলো শুকিয়ে গেছে, সেগুলি ওঠাতে, ঠোঙায় ভরা এবং মাঠ থেকে নিয়ে মহাজনের ঘরে দিতে ব্যস্ত সবাই। কথা বলার ফুশরত নেই কারো। এখান থেকে রোদে শোকানোর পর পাপড় চলে যায় মহাজনের ঘরে। ভোর থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত এ কাজে যারা যুক্ত থাকে তারা প্রত্যেকে পায় ২০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। তবে রোদে শোকানোর আগে আরো একটি ধাপ কাজ হয়ে থাকে পাপড় তৈরির ক্ষেত্রে। আজ যে পাপড় রোদে শোকানো হচ্ছে এই পাপড় আগেরদিন এ এলাকার ৪০-৫০ টি পরিবারের নারী এবং কিশোরীরা তাদের পরিবারের কাজ মিটিয়ে পাপড় বেলে থাকে। এ কাজে তারা পিড়ি আর ব্যালন ব্যবহার করে থাকে। বিকাল থেকে মহাজনের লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই কাঁচা পাপড় সংগ্রহ করে ভোর থেকে ওই মাঠে নিয়ে যায় রোদে শোকানোর জন্য। মহাজনের মালামাল নিয়ে ১ হাজারটি কাঁচা পাপড় বেলে দিলে তারা পায় ৬০-৭০ টাকা। পাপড় তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় খেসারীর ডাল, মাস কলাই, আতপ চালের গুড়া, লবণ এবং পানি। এক কেজি খেসারীর ডালের গুড়ার সাথে ৫০০ গ্রাম মাস কলাই গুড়া, আতপ চালের গুড়া ৩৫০ গ্রাম এবং পরিমান মতো পানি এবং লবণ। তবে কেউ অগ্রিম অর্ডার দিলে এই উপকরণের সাথে কালো জিরার গুড়াও যুক্ত করে তৈরি করে পাপড়।
পড়ালেখার পাশাপাশি এই মাঠে পাপড় শুকানোর কাজ করেন গোলাম রসুল। পাশের তার বাড়ি। স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীতে পড়ালেখা করে সে। সে জানায়, স্কুল ছুটি হলে বা বন্ধ থাকলে মাঠে এই কাজ করি। প্রতিদি আমার বেতন ২৫০ টাকা। বর্ষাকাল ছাড়া আর সব সময় এ কাজ থাকে। আমি এ টাকা নিয়ে মা’র কাছে দেই।
স্থানীয় নাউদাড়ি গ্রামের সাহিদা বেগম। তিনি এই মাঠে মহাজনের কাছ থেকে মাল নেওয়ার চুক্তি করতে এসেছে। এখন মাল নিয়ে সন্ধ্যের মধ্যে পাপড় বেলে আবার মহাজনকে দেবেন তিনি। এই কাজ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে করছেন তিনি।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাযায়, এ এলাকায় পাপড় তৈরি এবং বিক্রির কাজ শুরুর দিনক্ষণ লিপিবব্ধ না থাকলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে বা পরেই শুরু বলে তাদের অভিমত। আর এ কাজ এই এলাকায় শুরু করেন সতীশ চন্দ্র দত্ত। তার হাত ধরে এ পেশার আসে তার ছেলে সুশীল দত্ত। আর বর্তমানে সুশীল দত্তের ছেলে আনন্দ দত্ত এ পেশার সাথে জড়িত।
স্থানীয় নাউদাড়ি গ্রামের সাহিদা বেগম। তিনি এই মাঠে মহাজনের কাছ থেকে মাল নেওয়ার চুক্তি করতে এসেছে। এখন মাল নিয়ে সন্ধ্যের মধ্যে পাপড় বেলে আবার মহাজনকে দেবেন তিনি। এই কাজ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে করছেন তিনি।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাযায়, এ এলাকায় পাপড় তৈরি এবং বিক্রির কাজ শুরুর দিনক্ষণ লিপিবব্ধ না থাকলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে বা পরেই শুরু বলে তাদের অভিমত। আর এ কাজ এই এলাকায় শুরু করেন সতীশ চন্দ্র দত্ত। তার হাত ধরে এ পেশার আসে তার ছেলে সুশীল দত্ত। আর বর্তমানে সুশীল দত্তের ছেলে আনন্দ দত্ত এ পেশার সাথে জড়িত।
কথা হয় আনন্দ দত্তের সাথে। তিনি জানান, আমি সরাসরি পাপড় তৈরি করি না। আমি গ্রামের মহিলাদের দিয়ে কাঁচা পাপড় বানিয়ে আনি। তারপর লোক দিয়ে মাঠে শুকাই। এরপর ঠোঙায় ভরে বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি বিক্রি করি। খুলনা, পাইকগাছা, ঝিনাইদহ, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় আমাদের মাল যায়। একটি ঠোঙায় ১০ কেজি করে থাকে। কেজিতে ৯০ থেকে ১৫০ পিস পাপড় হয়ে থাকে। পাইকারি ১২০-১৪০ টাকা দর কেজিতে আমরা পাপড় বিক্রি করি। বর্ষকালে আমাদের মাল উৎপাদন কম হয়। আমরা মেঘ দেখলে বুঝি। কোন মেঘে বৃষ্টি হবে। আর যদি কাঁচা পাপড় একবার বৃষ্টিতে ভেঁজে। তাহলে তা আর মানুষের খাবার উপযোগি থাকে না। তখন কম দামে মাছের ঘেরে বিক্রি করতে হয়। বর্তমানে ঋণের জালে পড়ে অনেক ব্যবসায়ি হারিয়ে গেছে। আমি মনে করি এটি একটি শিল্প। এই শিল্পকে বাঁচাতে হলে কম সুদে বা বিনা সুদে এই পেশার লোকদেরকে ঋণ দিতে হবে। তা না হলে, এটি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে।
খুলনার অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ভ্যান চালক, সিএনজি চালক, মিল মালিক, স্থানীয় পরিবারের সদস্য, পাইকার, খুচরা বিক্রেতা এবং যারা সর্বশেষ পাপড় ভেজে বিক্রি করেন, এরা সবাই শিল্পের সাথে যুক্ত। ফলে বৃহত একটি জনগোষ্ঠি এর সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এবং তারা জীবীকা নির্বাহ করছে। ফলে সরকারিভাবে বা বেসরকারি উদ্যোগে এই শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তা না হলে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যাবে এই শিল্পটি হারিয়ে যাবে। এ জন্য এই শিল্পকে কৃষি শিল্পের আওতায় এনে বিশেষ সুবিধা দেয়া প্রয়োজন।


























