০৫:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কয়লার ময়লাতেই জীবিকা যাদের

বাংলা প্রবাদে আছে “ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়”। প্রয়োজন মানুষকে যে কোন পরিস্থিতিতে বাঁচতে শিখিয়ে দেয়। দৃঢ় মনোবল থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। অন্যরা যখন শেষ বলে ফেলে দেয় সেখান থেকে শুরু করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কিছু সংখ্যক নারী। চলেন জেনে নেয়া যাক তাদের জীবনের গল্প কথা।
প্রথম দেখায় মনে হতে পারে কয়েকজন নারী হয় তো ড্রেনের পানিতে মাছ ধরছেন। কিন্তু ময়লাযুক্ত এই কালো পানিতে মাছ নয় অন্য কিছু খুঁজছেন তারা। কিছু সময় অপেক্ষার পর তারা যখন ড্রেনের পানি থেকে উপরে উঠে আসেন তখন তাদের হাতে মাছ নয় বরং দেখা মিললো কিছু কালো পদার্থের। কাছে গিয়ে বোঝা গেল এগুলো কয়লার ডাস্ট (ময়লা)। এই দৃশ্য দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ময়লাযুক্ত পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের।
খনি থেকে উত্তোলনকৃত কয়লা শোধনের পর অবশিষ্ট ময়লা পানি ড্রেনের মাধ্যমে খনির বাইরে পাঠানো হয়। কয়েকজন নারী সেই ড্রেনের পানিতে নেমে স্থানীয় পদ্ধতিতে ভাসমান কয়লার ডাস্ট সংগ্রহ করে থাকেন। কেন এবং কিভাবে তারা এই কয়লার ময়লা সংগ্রহ করে থাকেন এ বিষয়ে কথা হয় তাদের সাথে।

খয়লা খনির পাশের চৌহাটি গ্রামের বাসিন্দা রফিজন বেগম। তিনি বলেন, আশেপাশের তিন গ্রামের প্রায় ১২০ জন নারী মিলে একটি সমিতি করা হয়েছে। আমরা মোট আটটি দলে ভাগ হয়ে কয়লা সংগ্রহ করে থাকি। আমাদের দলে আমরা ২২জন সদস্য আছি। প্রতিটি দল সপ্তাহে একদিন করে কয়লা সংগ্রহের সুযোগ পায়। টানা ২৪ ঘন্টা সময় থাকে কয়লা সংগ্রহের জন্য। আমরা ২২জন আবার দুটি দলে ভাগ হয়ে একদল দিনে আর এক দল রাতে কয়লা সংগ্রহ করে থাকি। খনিতে নিচ থেকে কয়লা তুললে এবং মেশিন চললে ড্রেন দিয়ে একটু বেশি পরিমানে কয়লা আসে। অনেক সময় কয়লা তুলার কাজ বন্ধ থাকলে আমরাও সেদিন ড্রেনে কয়লা কম পাই। কোন দিন আট মণ আবার কোন দিন ১০-১২ মণ কয়লাও পাই। প্রতি মণ কয়লা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। ইটভাটা চালুর সময় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরেও বিক্রি হয়। এতে আমাদের জন প্রতি একদিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা হয়। কিন্তু দল ভাগ করা থাকায় আমরা তো মাসে তিন দিন কয়লা সংগ্রহ করতে পারি।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ড্রেন থেকে কয়লা সংগ্রহ করছেন চৌহাটি গ্রামের বাসিন্দা মোহচনা খাতুন। তিনি বলেন, নেট সেলাই করে ড্রেনের পিলারের সাথে বেঁধে রাখি। পানির সাথে কয়লার ময়লা ভেসে যাওয়ার সময় সেগুলো নেটে আটকা পড়ে। মাঝে মাঝে বাঁশের মাথায় লোহার তৈরি বিশেষ অস্ত্র দিয়ে ড্রেনের পানিতে থাকা ময়লা কাটি। এভাবে সবাই মিলে দল বেঁধে কাজ করি। যেদিন যেমন কয়লা পাই সেগুলো বিক্রি করে সমান ভাবে ভাগ করে নেই।

মাজেদা খাতুন নামে দলের আরেক সদস্য বলেন, এই কালো পানিতে নেমে কয়লা তুলে বিক্রি করে যা টাকা পাই তাতে কোন মতে সংসার চলে। কয়লা খনিতে তো কাজ পাইনি। আমার ছেলে বা নাতির কারও কাজ হয়নি। বাধ্য হয়েই এই কাজ করতে হয়। কপাল ভালো থাকলে কয়লা আসলে একটু বেশি কয়লা পাই। এমনও হয় কয়লা তেমন পাই না। খালি হাতে ঘুরে যেতে হয়।
মনোয়ারা বেগম বলেন, যখন মাটির নিচ থেকে কয়লা তুলে আর শ্রমিকরা কয়লা কাটে তখন পানির সাথে কয়লা ভালো পাই। আর যেসময় কয়লা তুলার কাজ বন্ধ থাকে তখন সেভাবে আর কয়লা পাওয়া যায় না। তারপরও এখানে আসি। অভাবের কারণে এই পানিতে নেমে কাজ করতে হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো আমরা কয়লা খনির পাশের লোক হয়েও স্বামী সন্তানরা চাকরি পাচ্ছে না। বাইরের লোকজন এখানে এসে চাকরি করছে। খনিতে তো অনেক রকমের কাজ থাকে। আমরা যারা স্থানীয় আছি তাদেরকে কাজ দিলে ভালো হতো।
মোনয়ারা বেগম কিংবা মোহচনা খাতুন তাদের মতো আশেপাশের তিনটি গ্রামের প্রায় ১২০ জন নারী ড্রেনের পানি থেকে এভাবেই দলে দলে বিভক্ত হয়ে কয়লা তুলেন। অনেকের কাছে শুধু ময়লা নিষ্কাশনের ড্রেন হলেও তাদের কাছে এটি জীবিকা নিবার্হের অন্যতম উৎস। এই পানিতে নেমে কাজ করার প্রথম দিকে তাদের শরীরে সমস্যা হলেও এখন আর কোন সমস্যা হয় না। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার বজ্র-বৃষ্টি কিংবা কনকনে শীতের হিমেল হাওয়া কোনটাই থামাতে পারে না তাদের। কয়লার ময়লাতেই তারা বাঁচার আলো খুঁজে চলেছেন দিনের পর দিন।
কয়লা খনির কারণে নিজেদের বসতবাড়ি ছাড়তে হলেও এই খনির পানি নিষ্কাশনের ড্রেন থেকে কয়লা তুলে সংসার চালাতে পেরে সেই দুঃখ অনেকটাই লাঘব হয়েছে এসব নারীদের। তবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে কি করে আয় রোজগার করবেন সেই শঙ্কাও উঁকি দেয় তাদের মনে। কারণ, কয়লার ময়লাতেই তারা বাঁচার আলো খুঁজে চলেছেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।

জনপ্রিয় সংবাদ

সানজিদা তন্বীর বিয়ের খবর জানালেন ফেসবুকে নিজের হৃদয়গ্রাহী পোস্টে

কয়লার ময়লাতেই জীবিকা যাদের

আপডেট সময় : ১২:২১:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলা প্রবাদে আছে “ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়”। প্রয়োজন মানুষকে যে কোন পরিস্থিতিতে বাঁচতে শিখিয়ে দেয়। দৃঢ় মনোবল থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। অন্যরা যখন শেষ বলে ফেলে দেয় সেখান থেকে শুরু করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কিছু সংখ্যক নারী। চলেন জেনে নেয়া যাক তাদের জীবনের গল্প কথা।
প্রথম দেখায় মনে হতে পারে কয়েকজন নারী হয় তো ড্রেনের পানিতে মাছ ধরছেন। কিন্তু ময়লাযুক্ত এই কালো পানিতে মাছ নয় অন্য কিছু খুঁজছেন তারা। কিছু সময় অপেক্ষার পর তারা যখন ড্রেনের পানি থেকে উপরে উঠে আসেন তখন তাদের হাতে মাছ নয় বরং দেখা মিললো কিছু কালো পদার্থের। কাছে গিয়ে বোঝা গেল এগুলো কয়লার ডাস্ট (ময়লা)। এই দৃশ্য দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ময়লাযুক্ত পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের।
খনি থেকে উত্তোলনকৃত কয়লা শোধনের পর অবশিষ্ট ময়লা পানি ড্রেনের মাধ্যমে খনির বাইরে পাঠানো হয়। কয়েকজন নারী সেই ড্রেনের পানিতে নেমে স্থানীয় পদ্ধতিতে ভাসমান কয়লার ডাস্ট সংগ্রহ করে থাকেন। কেন এবং কিভাবে তারা এই কয়লার ময়লা সংগ্রহ করে থাকেন এ বিষয়ে কথা হয় তাদের সাথে।

খয়লা খনির পাশের চৌহাটি গ্রামের বাসিন্দা রফিজন বেগম। তিনি বলেন, আশেপাশের তিন গ্রামের প্রায় ১২০ জন নারী মিলে একটি সমিতি করা হয়েছে। আমরা মোট আটটি দলে ভাগ হয়ে কয়লা সংগ্রহ করে থাকি। আমাদের দলে আমরা ২২জন সদস্য আছি। প্রতিটি দল সপ্তাহে একদিন করে কয়লা সংগ্রহের সুযোগ পায়। টানা ২৪ ঘন্টা সময় থাকে কয়লা সংগ্রহের জন্য। আমরা ২২জন আবার দুটি দলে ভাগ হয়ে একদল দিনে আর এক দল রাতে কয়লা সংগ্রহ করে থাকি। খনিতে নিচ থেকে কয়লা তুললে এবং মেশিন চললে ড্রেন দিয়ে একটু বেশি পরিমানে কয়লা আসে। অনেক সময় কয়লা তুলার কাজ বন্ধ থাকলে আমরাও সেদিন ড্রেনে কয়লা কম পাই। কোন দিন আট মণ আবার কোন দিন ১০-১২ মণ কয়লাও পাই। প্রতি মণ কয়লা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। ইটভাটা চালুর সময় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরেও বিক্রি হয়। এতে আমাদের জন প্রতি একদিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা হয়। কিন্তু দল ভাগ করা থাকায় আমরা তো মাসে তিন দিন কয়লা সংগ্রহ করতে পারি।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ড্রেন থেকে কয়লা সংগ্রহ করছেন চৌহাটি গ্রামের বাসিন্দা মোহচনা খাতুন। তিনি বলেন, নেট সেলাই করে ড্রেনের পিলারের সাথে বেঁধে রাখি। পানির সাথে কয়লার ময়লা ভেসে যাওয়ার সময় সেগুলো নেটে আটকা পড়ে। মাঝে মাঝে বাঁশের মাথায় লোহার তৈরি বিশেষ অস্ত্র দিয়ে ড্রেনের পানিতে থাকা ময়লা কাটি। এভাবে সবাই মিলে দল বেঁধে কাজ করি। যেদিন যেমন কয়লা পাই সেগুলো বিক্রি করে সমান ভাবে ভাগ করে নেই।

মাজেদা খাতুন নামে দলের আরেক সদস্য বলেন, এই কালো পানিতে নেমে কয়লা তুলে বিক্রি করে যা টাকা পাই তাতে কোন মতে সংসার চলে। কয়লা খনিতে তো কাজ পাইনি। আমার ছেলে বা নাতির কারও কাজ হয়নি। বাধ্য হয়েই এই কাজ করতে হয়। কপাল ভালো থাকলে কয়লা আসলে একটু বেশি কয়লা পাই। এমনও হয় কয়লা তেমন পাই না। খালি হাতে ঘুরে যেতে হয়।
মনোয়ারা বেগম বলেন, যখন মাটির নিচ থেকে কয়লা তুলে আর শ্রমিকরা কয়লা কাটে তখন পানির সাথে কয়লা ভালো পাই। আর যেসময় কয়লা তুলার কাজ বন্ধ থাকে তখন সেভাবে আর কয়লা পাওয়া যায় না। তারপরও এখানে আসি। অভাবের কারণে এই পানিতে নেমে কাজ করতে হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো আমরা কয়লা খনির পাশের লোক হয়েও স্বামী সন্তানরা চাকরি পাচ্ছে না। বাইরের লোকজন এখানে এসে চাকরি করছে। খনিতে তো অনেক রকমের কাজ থাকে। আমরা যারা স্থানীয় আছি তাদেরকে কাজ দিলে ভালো হতো।
মোনয়ারা বেগম কিংবা মোহচনা খাতুন তাদের মতো আশেপাশের তিনটি গ্রামের প্রায় ১২০ জন নারী ড্রেনের পানি থেকে এভাবেই দলে দলে বিভক্ত হয়ে কয়লা তুলেন। অনেকের কাছে শুধু ময়লা নিষ্কাশনের ড্রেন হলেও তাদের কাছে এটি জীবিকা নিবার্হের অন্যতম উৎস। এই পানিতে নেমে কাজ করার প্রথম দিকে তাদের শরীরে সমস্যা হলেও এখন আর কোন সমস্যা হয় না। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার বজ্র-বৃষ্টি কিংবা কনকনে শীতের হিমেল হাওয়া কোনটাই থামাতে পারে না তাদের। কয়লার ময়লাতেই তারা বাঁচার আলো খুঁজে চলেছেন দিনের পর দিন।
কয়লা খনির কারণে নিজেদের বসতবাড়ি ছাড়তে হলেও এই খনির পানি নিষ্কাশনের ড্রেন থেকে কয়লা তুলে সংসার চালাতে পেরে সেই দুঃখ অনেকটাই লাঘব হয়েছে এসব নারীদের। তবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে কি করে আয় রোজগার করবেন সেই শঙ্কাও উঁকি দেয় তাদের মনে। কারণ, কয়লার ময়লাতেই তারা বাঁচার আলো খুঁজে চলেছেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।