০৪:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্তির পথে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী তিলের খাজা

“হায় রে মজার তিলের খাজা; খেয়ে দেখলি না মন কেমন মজা, লালন কয় বেজাতের রাজা হয়ে রইলাম এ ভুবনে…।” বাউল সাধক লালন ফকির দেড়শ’ বছর আগে তাঁর গানে তিলের খাজা নিয়ে এমনটা বলেছিলেন।
কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নাম শোনেনি বা খায়নি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া মুশকিল। কয়েক দশক আগেও কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলাতে এ পেশার সাথে জড়িত ছিল কয়েক শত পরিবার। হাতে তৈরি খেতে দারুণ সুস্বাদু কুষ্টিয়ার এ তিলের খাজা প্রায় দুইশ’ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। খাবারটি কুষ্টিয়ার নামের সাথেই মিশে আছে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে নানা রকম হাঁকডাকের মাধ্যমে রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টেশন ও লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায় কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা। সম্প্রতি খাবারটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র শিল্পের তালিকায় থাকা পণ্যটি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখনো ধুঁকছে। দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনটন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এ শিল্প।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের সময়কালেই তিলের খাজার প্রচলন ঘটে কুষ্টিয়ায়৷ প্রায় দুই শতাধিক বছর ধরে সমাদৃত পণ্যটি কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলায় তেলি সম্প্রদায়ের হাতে প্রথম তৈরি হয়। ঠিক কবে উৎপাদন শুরু হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ইতিহাস অনুসারে, তিল থেকে তেল তৈরি করতে তেলিদের কুষ্টিয়ায় এনেছিলেন ব্রিটিশরা। আর তেলি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এই খাবার প্রথম কুষ্টিয়ায় তৈরি হয়। ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার আগে শহরের মিলপাড়ায় ও দেশওয়ালী পাড়ার পাল সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পরিবার তিলের খাজা তৈরি শুরু করে৷ ১৯৭০-এর দশকে কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া ও জয়নাবাদ এবং কুষ্টিয়া শহরের চর মিলপাড়ায় কয়েকটি কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর ক্রমেই কুষ্টিয়ার তিলের খাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্য অঞ্চলেও।
কারিগরেরা জানান, সাধারণত তিলের খাজা তৈরির প্রধান উপকরণ তিল ও চিনি। প্রতি কড়াইয়ে ৭ কেজি চিনি, পানি মেশানো দুধ আধা লিটার, পানি ৪ লিটার, দেড় কেজি তিল আর প্রয়োজনমতো এলাচ দেওয়া হয়। পরে বড় চুলায় জাল দিয়ে তৈরি হয় সিরা। সেই সিরা আঠালো হয়ে জমতে থাকলে বিশেষ কায়দায় টেনে বড় করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এক কড়াইয়ে প্রায় ৮ কেজি খাজা হয়।
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা বছরই তৈরি করা হয় এটি। তবে শীত মৌসুমে এর কদর বাড়ে। কুষ্টিয়ায় বর্তমানে দুটি কারখানা আছে। এর মধ্যে জয়নাবাদ এলাকায় রয়েছে ১ নম্বর নিউ স্পেশাল ভাই ভাই তিলের খাজা এবং মিলপাড়ায় রয়েছে ভাই ভাই তিলের খাজা। মূলত আর্থিক কারণেই এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানান, স্বাধীনতার পর দেশের অনেক কিছু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি এ শিল্পের সাথে জড়িতদের।
চিনি ও তিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এ শিল্প। বহু পুরনো মজাদার সুস্বাদু এ তিলের খাজা এখনো ছোট-বড় সবার মন কাড়ে। তিলের খাজা ১০০ টাকা কেজি এবং এর এক প্যাকেট ১০ টাকায় বিক্রি হয়। দামে কম বলে এটি গ্রামগঞ্জেও খুব জনপ্রিয়। এটা বিক্রি করে বহু হকার জীবিকা নির্বাহ করেন। কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও দেশের কয়েকটি জেলায় তিলের খাজা তৈরির কারখানা আছে। তবে অন্য জেলায় তৈরি হলেও অনেকেই এটি কুষ্টিয়ার নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন।
জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা বলেন, ‘কুষ্টিয়ার তিলের খাজা শিল্পের বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। ক্ষুদ্র এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের ব্যবস্থাও করবে জেলা প্রশাসন।’
জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

বিলুপ্তির পথে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী তিলের খাজা

আপডেট সময় : ০৩:৩৪:০০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪
“হায় রে মজার তিলের খাজা; খেয়ে দেখলি না মন কেমন মজা, লালন কয় বেজাতের রাজা হয়ে রইলাম এ ভুবনে…।” বাউল সাধক লালন ফকির দেড়শ’ বছর আগে তাঁর গানে তিলের খাজা নিয়ে এমনটা বলেছিলেন।
কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নাম শোনেনি বা খায়নি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া মুশকিল। কয়েক দশক আগেও কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলাতে এ পেশার সাথে জড়িত ছিল কয়েক শত পরিবার। হাতে তৈরি খেতে দারুণ সুস্বাদু কুষ্টিয়ার এ তিলের খাজা প্রায় দুইশ’ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। খাবারটি কুষ্টিয়ার নামের সাথেই মিশে আছে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে নানা রকম হাঁকডাকের মাধ্যমে রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টেশন ও লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায় কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা। সম্প্রতি খাবারটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র শিল্পের তালিকায় থাকা পণ্যটি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখনো ধুঁকছে। দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনটন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এ শিল্প।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের সময়কালেই তিলের খাজার প্রচলন ঘটে কুষ্টিয়ায়৷ প্রায় দুই শতাধিক বছর ধরে সমাদৃত পণ্যটি কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলায় তেলি সম্প্রদায়ের হাতে প্রথম তৈরি হয়। ঠিক কবে উৎপাদন শুরু হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ইতিহাস অনুসারে, তিল থেকে তেল তৈরি করতে তেলিদের কুষ্টিয়ায় এনেছিলেন ব্রিটিশরা। আর তেলি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এই খাবার প্রথম কুষ্টিয়ায় তৈরি হয়। ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার আগে শহরের মিলপাড়ায় ও দেশওয়ালী পাড়ার পাল সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পরিবার তিলের খাজা তৈরি শুরু করে৷ ১৯৭০-এর দশকে কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া ও জয়নাবাদ এবং কুষ্টিয়া শহরের চর মিলপাড়ায় কয়েকটি কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর ক্রমেই কুষ্টিয়ার তিলের খাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্য অঞ্চলেও।
কারিগরেরা জানান, সাধারণত তিলের খাজা তৈরির প্রধান উপকরণ তিল ও চিনি। প্রতি কড়াইয়ে ৭ কেজি চিনি, পানি মেশানো দুধ আধা লিটার, পানি ৪ লিটার, দেড় কেজি তিল আর প্রয়োজনমতো এলাচ দেওয়া হয়। পরে বড় চুলায় জাল দিয়ে তৈরি হয় সিরা। সেই সিরা আঠালো হয়ে জমতে থাকলে বিশেষ কায়দায় টেনে বড় করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এক কড়াইয়ে প্রায় ৮ কেজি খাজা হয়।
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা বছরই তৈরি করা হয় এটি। তবে শীত মৌসুমে এর কদর বাড়ে। কুষ্টিয়ায় বর্তমানে দুটি কারখানা আছে। এর মধ্যে জয়নাবাদ এলাকায় রয়েছে ১ নম্বর নিউ স্পেশাল ভাই ভাই তিলের খাজা এবং মিলপাড়ায় রয়েছে ভাই ভাই তিলের খাজা। মূলত আর্থিক কারণেই এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানান, স্বাধীনতার পর দেশের অনেক কিছু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি এ শিল্পের সাথে জড়িতদের।
চিনি ও তিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এ শিল্প। বহু পুরনো মজাদার সুস্বাদু এ তিলের খাজা এখনো ছোট-বড় সবার মন কাড়ে। তিলের খাজা ১০০ টাকা কেজি এবং এর এক প্যাকেট ১০ টাকায় বিক্রি হয়। দামে কম বলে এটি গ্রামগঞ্জেও খুব জনপ্রিয়। এটা বিক্রি করে বহু হকার জীবিকা নির্বাহ করেন। কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও দেশের কয়েকটি জেলায় তিলের খাজা তৈরির কারখানা আছে। তবে অন্য জেলায় তৈরি হলেও অনেকেই এটি কুষ্টিয়ার নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন।
জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা বলেন, ‘কুষ্টিয়ার তিলের খাজা শিল্পের বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। ক্ষুদ্র এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের ব্যবস্থাও করবে জেলা প্রশাসন।’