১২:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বায়ু দূষণে হুমকির মুখে রূপগঞ্জ

বায়ু দূষণের ফলে রূপগঞ্জ এখন হুমকির
মুখে। ফলে রূপগঞ্জকে বাঁচানোর পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন
পরিবেশবাদি কর্মী ও স্থানীয় সুশীল সমাজের লোকজন। তাদের মতে,
জনপ্রতিনিধিরা ভোটের রাজনীতি করেন ঠিকই কিন্তু দূষণের কারণে
মানুষের জীবন সংকটাপন্ন এমনটা নিয়ে কেউ ভাবছেন না। শুধু দূষণের
কারণে বছরে রূপগঞ্জে প্রায় ৪৫০ লোকের মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে।
এখানেই শেষ নয়। দূষণের কারণে বছরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ শ^াসকষ্ট
রোগে ভোগে। আর রূপগঞ্জে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির
পরিমাণ ৬শ’ কোটি টাকা। শুধুমাত্র বায়ু দূষণে ক্ষতি হয় ৪শ’ কোটি
টাকা। দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় শিশুরা। রূপগঞ্জের ৫১টি
এলাকায় মাটি ও পানিতে সীসার পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি।
ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ু দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ
করে। রূপগঞ্জের ইট ভাটাগুলো বায়ু দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।
‘বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়,
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে রূপগঞ্জের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির
মুখে পড়ছে। শিল্পকারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে রূপগঞ্জের ভূগর্ভস্থ পানি
তুলে ফেলছে। ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নীচে নেমে যাচ্ছে। খাল ও
নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানিও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। খোঁজ
নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জের ২৩ টি তৈরি পোশাকশিল্পের ওয়াশিং ও
১৪ টি ডাইং কারখানার বর্জ্য দূষণের অন্যতম উৎস। এক টন কাপড়
উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন। ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে
১ লাখ কোটি লিটার এবং কাগজ কারখানাগুলো থেকে ৪৫ হাজার কোটি
লিটার দূষিত বর্জ্য পানিতে মেশে। এছাড়া জলাশয় ভরাট, দখল ও দূষণ

চলছে। রূপগঞ্জে টিকে থাকা ২৬টি খালের মধ্যে মাত্র দুটি সচল আছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ১৪ টি বেসরকারী হাসপাতালের
তথ্যমতে, এসব হাসপাতালগুলোতে শুধূ শীত মৌসুমে ৪৫ হাজার
শ^াসকষ্টের রোগী আসে। আর গরম মৌসুমে আরো ১৮ থেকে ১৯ হাজার
শ^াসকষ্টের রোগী আসে। এসব রোগীর মধ্যে কয়েক শত রোগী মারাও
যায়।
রূপগঞ্জে পানি ও বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে
দরিদ্র লোক ও শিশুরা। রূপগঞ্জের ৫১ টি এলাকাকে তীব্র মাত্রায় সিসা-
আক্রান্ত বা হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকার পানি
ও মাটিতে আরও পাওয়া গেছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম,
ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫), কীটনাশক ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো
মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বস্তু। রূপগঞ্জে শুধু সিসা-দূষণের
শিকার ৫০ হাজার মানুষ। তাদের বেশিরভাগই শিশু। রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে
সিসার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মাত্রার চেয়েও বেশি। রূপগঞ্জ হাসপতালের
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রিফাত তাহের বলেন, ‘‘পরিবেশ দূষণের প্রধান শিকার
নারী ও শিশু। আর অতিরিক্ত সিসা শিশুদের রক্তশূণ্যতা সৃষ্টি করে। তারা
ঠিকমত খেলেও অপুষ্টির শিকার হয়। ’’
মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বায়ুদূষণের মানমাত্রায় রূপগঞ্জের
একিউআই স্কোর ছিলো ১৭৮, যা বাতাসের অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে
নির্দেশ করে। সাধারণত ১০০ এবং ২০০-এর মধ্যে একিউআই শিশু এবং
বয়স্কদের মতো “সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর” বলে বিবেচিত
হয়। ২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) বায়ু দূষণের প্রধান
৩টি প্রধান উৎস হিসেবে ইটের ভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং ভবন
নির্মাণ প্রকল্পের ধুলোবালির কথা উল্লেখ করা হয়। যার সবকটি রূপগঞ্জে
রয়েছে। রূপগঞ্জের উপড় দিয়ে প্রতিদিন ৪৭ হাজার যানবাহন চলাচল করে।
মুড়াপাড়া বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক
মনিরুজ্জামান বলেন, রূপগঞ্জের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা যার ব্যাস
সাধারণত ২.৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোটটির (পিএম ২.৫)
পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯.৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এই মান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মান মাত্রার (অর্থাৎ ৫
মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মান
মাত্রার চেয়ে ৬ গুণ বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫-এর জন্য
নির্ধারিত (বার্ষিক) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। রূপগঞ্জে
বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ প্রায় ১৪৩ টি ইটভাটা। এলাকাভিত্তিক বায়ুর
মানের রকমফের থাকলেও সামগ্রিকভাবে রূপগঞ্জের বেশির ভাগ এলাকার
বায়ু অস্বাস্থ্যকর বলে জানান গবেষকরা।
বায়ুদূষণের কারণে রূপগঞ্জে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে।
বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি
নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। ভুলতা মেমোরি হাসপাতালের ডা.
ফারুক আহম্মেদসহ কয়েকজন চিকিৎসক বলেছেন, বাতাসে ভারি ধাতু
ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা
বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। পরিবেশের প্রধান উপাদান বায়ু, মাটি
ও পানি। রূপগঞ্জের বায়ু, মাটি ও পানি তিনটিই দূষিত। বিশেষ করে
বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। কথাগুলো বলেছেন রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. নাজমুল আহম্মেদ।
বায়ু মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের এয়ার
কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী, রূপগঞ্জের বায়ু নারী, শিশু,
বয়োজ্যেষ্ঠ ও অসুস্থদের জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’। শুষ্ক মৌসুমে রূপগঞ্জের
বায়ু মানের সূচক থাকে ২৭০ এর ওপরে। বায়ু মানের সূচক ২০০ অতিক্রম
করলে তা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,
মৌসুমে ১৪৩ ইটভাটায় কমপক্ষে ৫০ লাখ কাঁচা ইট পোড়ানো হয়।
এজন্য প্রতিদিন একটি ইটভাটায় প্রয়োজন হয় কমপক্ষে তিন টন কয়লা।
ইটভাটাগুলোর বেশিরভাগই লোকালয়, ফসলি জমি ও নদীর পাশে অবস্থিত।
সিমেন্ট কারখানা রয়েছে ২ টি। এসব সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহৃত
ফ্লাইঅ্যাশ জাহাজ থেকে ওঠানোর সময় বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। রি-
রোলিং মিল রয়েছে ৭ টি। এসব রি-রোলিং স্টিল মিল থেকে লোহা
গলানোর সময়ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। রেডিমিক্স
কারখানা রয়েছে ৫ টি। এসব রেডিমিক্স কারখানা থেকে বায়ু দূষণ
ছড়াচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন,
নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ নানাভাবে দূষিত। অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত
আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পরিবেশকর্মী মাহাবুব
আলম প্রিয় বলেন, রূপগঞ্জের রাজনীতিবীদ, সমাজকর্মী, প্রভাবশালীরা
নিজেদের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করে। ভোট আসলে জনপ্রতিনিধিরা
উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু দূষণের কারণে রূপগঞ্জের মানুষের যে
বারোটা বেজে যাচ্ছে যে দিকে কারো খেয়াল নেই। দূষণ রোধে
সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
ডাঃ আইভি ফেরদৌস বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সেখানে ব্রঙ্কাইটিস ও
অ্যাজমার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত
সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। আগে
শীতে এই প্রকোপ বেশি দেখা দিলেও এখন সারা বছরই শ্বাসকষ্টজনিত
রোগী পাওয়া যাচ্ছে। মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও
পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মোঃ ইসহাক মিয়া বলেন, বায়ু দূষণে
যতগুলো উপকরণ দরকার তার সবগুলোই রূপগঞ্জে রয়েছে। রূপগঞ্জে
অপরিকল্পিতভাবে অনেক কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলোর সুতা, রং
ইত্যাদি কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে। এখানে অনেক ইটের ভাটা রয়েছে।
কল-কারখানা, ইটের ভাটা ইত্যাদি যত দূরে হবে তত বায়ু দূষণ কম হয়।
কাছে হলেই বায়ু দূষণ বেশি হয়। ইট পোড়ানোর কারণে যে গ্যাস
তৈরি হয় সেটা পরিবেশের জন্য সাংঘাতিক ক্ষতিকর। ফলে বায়ু দূষণ
থেকে এখন অজানা রোগে মানুষ বেশি ভুগছে।

 

 

স/ম

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

বায়ু দূষণে হুমকির মুখে রূপগঞ্জ

আপডেট সময় : ০৩:০০:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৪

বায়ু দূষণের ফলে রূপগঞ্জ এখন হুমকির
মুখে। ফলে রূপগঞ্জকে বাঁচানোর পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন
পরিবেশবাদি কর্মী ও স্থানীয় সুশীল সমাজের লোকজন। তাদের মতে,
জনপ্রতিনিধিরা ভোটের রাজনীতি করেন ঠিকই কিন্তু দূষণের কারণে
মানুষের জীবন সংকটাপন্ন এমনটা নিয়ে কেউ ভাবছেন না। শুধু দূষণের
কারণে বছরে রূপগঞ্জে প্রায় ৪৫০ লোকের মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে।
এখানেই শেষ নয়। দূষণের কারণে বছরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ শ^াসকষ্ট
রোগে ভোগে। আর রূপগঞ্জে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির
পরিমাণ ৬শ’ কোটি টাকা। শুধুমাত্র বায়ু দূষণে ক্ষতি হয় ৪শ’ কোটি
টাকা। দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় শিশুরা। রূপগঞ্জের ৫১টি
এলাকায় মাটি ও পানিতে সীসার পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি।
ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ু দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ
করে। রূপগঞ্জের ইট ভাটাগুলো বায়ু দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।
‘বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়,
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে রূপগঞ্জের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির
মুখে পড়ছে। শিল্পকারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে রূপগঞ্জের ভূগর্ভস্থ পানি
তুলে ফেলছে। ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নীচে নেমে যাচ্ছে। খাল ও
নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানিও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। খোঁজ
নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জের ২৩ টি তৈরি পোশাকশিল্পের ওয়াশিং ও
১৪ টি ডাইং কারখানার বর্জ্য দূষণের অন্যতম উৎস। এক টন কাপড়
উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন। ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে
১ লাখ কোটি লিটার এবং কাগজ কারখানাগুলো থেকে ৪৫ হাজার কোটি
লিটার দূষিত বর্জ্য পানিতে মেশে। এছাড়া জলাশয় ভরাট, দখল ও দূষণ

চলছে। রূপগঞ্জে টিকে থাকা ২৬টি খালের মধ্যে মাত্র দুটি সচল আছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ১৪ টি বেসরকারী হাসপাতালের
তথ্যমতে, এসব হাসপাতালগুলোতে শুধূ শীত মৌসুমে ৪৫ হাজার
শ^াসকষ্টের রোগী আসে। আর গরম মৌসুমে আরো ১৮ থেকে ১৯ হাজার
শ^াসকষ্টের রোগী আসে। এসব রোগীর মধ্যে কয়েক শত রোগী মারাও
যায়।
রূপগঞ্জে পানি ও বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে
দরিদ্র লোক ও শিশুরা। রূপগঞ্জের ৫১ টি এলাকাকে তীব্র মাত্রায় সিসা-
আক্রান্ত বা হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকার পানি
ও মাটিতে আরও পাওয়া গেছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম,
ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫), কীটনাশক ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো
মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বস্তু। রূপগঞ্জে শুধু সিসা-দূষণের
শিকার ৫০ হাজার মানুষ। তাদের বেশিরভাগই শিশু। রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে
সিসার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মাত্রার চেয়েও বেশি। রূপগঞ্জ হাসপতালের
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রিফাত তাহের বলেন, ‘‘পরিবেশ দূষণের প্রধান শিকার
নারী ও শিশু। আর অতিরিক্ত সিসা শিশুদের রক্তশূণ্যতা সৃষ্টি করে। তারা
ঠিকমত খেলেও অপুষ্টির শিকার হয়। ’’
মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বায়ুদূষণের মানমাত্রায় রূপগঞ্জের
একিউআই স্কোর ছিলো ১৭৮, যা বাতাসের অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে
নির্দেশ করে। সাধারণত ১০০ এবং ২০০-এর মধ্যে একিউআই শিশু এবং
বয়স্কদের মতো “সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর” বলে বিবেচিত
হয়। ২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) বায়ু দূষণের প্রধান
৩টি প্রধান উৎস হিসেবে ইটের ভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং ভবন
নির্মাণ প্রকল্পের ধুলোবালির কথা উল্লেখ করা হয়। যার সবকটি রূপগঞ্জে
রয়েছে। রূপগঞ্জের উপড় দিয়ে প্রতিদিন ৪৭ হাজার যানবাহন চলাচল করে।
মুড়াপাড়া বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক
মনিরুজ্জামান বলেন, রূপগঞ্জের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা যার ব্যাস
সাধারণত ২.৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোটটির (পিএম ২.৫)
পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯.৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এই মান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মান মাত্রার (অর্থাৎ ৫
মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মান
মাত্রার চেয়ে ৬ গুণ বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫-এর জন্য
নির্ধারিত (বার্ষিক) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। রূপগঞ্জে
বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ প্রায় ১৪৩ টি ইটভাটা। এলাকাভিত্তিক বায়ুর
মানের রকমফের থাকলেও সামগ্রিকভাবে রূপগঞ্জের বেশির ভাগ এলাকার
বায়ু অস্বাস্থ্যকর বলে জানান গবেষকরা।
বায়ুদূষণের কারণে রূপগঞ্জে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে।
বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি
নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। ভুলতা মেমোরি হাসপাতালের ডা.
ফারুক আহম্মেদসহ কয়েকজন চিকিৎসক বলেছেন, বাতাসে ভারি ধাতু
ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা
বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। পরিবেশের প্রধান উপাদান বায়ু, মাটি
ও পানি। রূপগঞ্জের বায়ু, মাটি ও পানি তিনটিই দূষিত। বিশেষ করে
বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। কথাগুলো বলেছেন রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. নাজমুল আহম্মেদ।
বায়ু মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের এয়ার
কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী, রূপগঞ্জের বায়ু নারী, শিশু,
বয়োজ্যেষ্ঠ ও অসুস্থদের জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’। শুষ্ক মৌসুমে রূপগঞ্জের
বায়ু মানের সূচক থাকে ২৭০ এর ওপরে। বায়ু মানের সূচক ২০০ অতিক্রম
করলে তা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,
মৌসুমে ১৪৩ ইটভাটায় কমপক্ষে ৫০ লাখ কাঁচা ইট পোড়ানো হয়।
এজন্য প্রতিদিন একটি ইটভাটায় প্রয়োজন হয় কমপক্ষে তিন টন কয়লা।
ইটভাটাগুলোর বেশিরভাগই লোকালয়, ফসলি জমি ও নদীর পাশে অবস্থিত।
সিমেন্ট কারখানা রয়েছে ২ টি। এসব সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহৃত
ফ্লাইঅ্যাশ জাহাজ থেকে ওঠানোর সময় বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। রি-
রোলিং মিল রয়েছে ৭ টি। এসব রি-রোলিং স্টিল মিল থেকে লোহা
গলানোর সময়ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। রেডিমিক্স
কারখানা রয়েছে ৫ টি। এসব রেডিমিক্স কারখানা থেকে বায়ু দূষণ
ছড়াচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন,
নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ নানাভাবে দূষিত। অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত
আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পরিবেশকর্মী মাহাবুব
আলম প্রিয় বলেন, রূপগঞ্জের রাজনীতিবীদ, সমাজকর্মী, প্রভাবশালীরা
নিজেদের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করে। ভোট আসলে জনপ্রতিনিধিরা
উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু দূষণের কারণে রূপগঞ্জের মানুষের যে
বারোটা বেজে যাচ্ছে যে দিকে কারো খেয়াল নেই। দূষণ রোধে
সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
ডাঃ আইভি ফেরদৌস বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সেখানে ব্রঙ্কাইটিস ও
অ্যাজমার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত
সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। আগে
শীতে এই প্রকোপ বেশি দেখা দিলেও এখন সারা বছরই শ্বাসকষ্টজনিত
রোগী পাওয়া যাচ্ছে। মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও
পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মোঃ ইসহাক মিয়া বলেন, বায়ু দূষণে
যতগুলো উপকরণ দরকার তার সবগুলোই রূপগঞ্জে রয়েছে। রূপগঞ্জে
অপরিকল্পিতভাবে অনেক কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলোর সুতা, রং
ইত্যাদি কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে। এখানে অনেক ইটের ভাটা রয়েছে।
কল-কারখানা, ইটের ভাটা ইত্যাদি যত দূরে হবে তত বায়ু দূষণ কম হয়।
কাছে হলেই বায়ু দূষণ বেশি হয়। ইট পোড়ানোর কারণে যে গ্যাস
তৈরি হয় সেটা পরিবেশের জন্য সাংঘাতিক ক্ষতিকর। ফলে বায়ু দূষণ
থেকে এখন অজানা রোগে মানুষ বেশি ভুগছে।

 

 

স/ম