০৭:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আবারো বাতাসে মানুষের পোড়া মাংসের গন্ধ

দায় তাহলে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’-এ যারা খেতে গিয়েছিল, তাদেরই!

আবারো পুড়ে মরল মানুষ, আবারো বাতাসে ছড়াল মানুষের মাংস পোড়ার গন্ধ। বিষয়টি সৌভাগ্যবান আমরা যারা বেঁচে আছি, এরই মধ্যে সবাই তা জানি। এই মৃত্যু উপত্যকায় কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারানোর কবল থেকে এখনো আমরা যারা আপাতত নিরাপদ আছি, তাদেরকে সৌভাগ্যবানই তো বলতে হয়। হ্যাঁ, বেইলি রোডের সেই ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ নামক ভবনে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে প্রায় অর্ধশত অসহায় নরনারী আর অবুঝ শিশুর পুড়ে মরার ঘটনার কথা বলছি, যেখানে আবারো পুড়ে নিঃশেষ হলো কতো স্বপ্ন, শেষ হয়ে গেল অসহায়ের শেষ অবলম্বন। অবশ্য এমন ঘটনা এখন আর তেমন অপ্রত্যাশিত কিছু না। এ ঘটনাটির পর সাময়িক কিছুদিন বিরতি দিয়ে এই ঢাকায় কিংবা অন্য কোথাও আবারো এমনি একটা কিছু ঘটবে, আমরা না চাইলেও তা ঘটবে, এটি একপ্রকার নিশ্চিত।
ভবিষ্যতের কোনো কুক্ষণে সংঘটিতব্য লক্ষ্মীছাড়া ঘটনার শিকার হয়ে নতুন করে কার কার খাঁচার ভেতরের অচিন পাখিটি চিরতরে খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে সেটি নিশ্চিত করতে না পারাটাই কেবল অনিশ্চিত।

কিছুদিন পূর্বে ‘বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধের বিনিময়ে কাম্য নয় কোনো উন্নয়ন’,Ñ এই শিরোনামে একই বিষয়ে আমার একটি নিবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সে নিবন্ধটির প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি :
“পৃথিবীর সকল মানুষই জাতি, গোত্র নির্বিশেষে চায় বিশ্বে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। জাতি হিসেবে আমরাও তাই চাই। এ লক্ষ্যে আমরা এগিয়েও গিয়েছি বহুদূর। কিন্তু এই যে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, এটা কার জন্য? মানুষের জন্যই তো! এ উন্নয়ন তো মানুষে করে মানুষেরই জন্য! এই মানুষ যদি উন্নয়নের বলি হয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় জীবন্ত পুড়ে মরে একই সঙ্গে দশ/বিশ/পঞ্চাশ কিংবা শত সংখ্যায়, তাহলে এটা কি উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মেনে নেওয়া যায়!
… গার্মেন্ট সেক্টর নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। আবার এই গার্মেন্ট সেক্টরই জনমানুষের কাঠগড়ায় মানুষ পুড়িয়ে মারার প্রধান আসামি। কমপ্লায়েন্সের দিক থেকে বিশ্বের প্রথম শ্রেণির গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলো যেমন আমাদের দেশেই আছে, তেমনি আবার অতি মুনাফালোভী কিছু উদ্যোক্তা তাদের খামখেয়ালি আচরণ আর কর্মরত শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়নে অবহেলার কারণে বিশ্ব মিডিয়ায় আমাদের মানুষ পুড়ে মারার সংবাদে পরিণত করেছে। নিকট অতীতে তাজরিন ফ্যাশনস, ট্রাম্পাকো ফয়েলস, দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার, গরিব এন্ড গরিব গার্মেন্ট, ম্যালটি ফ্যাবস…, বলতে গেলে এ তালিকা কেবল দীর্ঘই হবে, যেখানে আমরা অবিশ্বাস্য নয়নে দেখেছি দোযখসম আগুনের লেলিহান শিখায় কিভাবে জীবন্ত পুড়ে মরেছে মানুষ। পুড়ে মরেছে বলার চেয়ে বরং পুড়িয়ে মারা হয়েছে বলাই অধিকতর শ্রেয়। এদের তালিকা আরও দীর্ঘ করেছে পুরান ঢাকার নিমতলী আর চকবাজারের রঙের কারখানা এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে একইভাবে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার বীভৎস খবর। কারখানায় জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার উৎসবে সর্বশেষ বলি হলো এই তো সেদিন রূপগঞ্জের একটি জুস ফ্যাক্টরিতে বায়ান্ন জন তরুণ-তরুণী। দিন যত যাচ্ছে পুড়ে মরার এহেন ঘটনার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
এ যেন মানুষ পুড়িয়ে মারার এক অগ্ন্যোৎসব। এই অগ্ন্যোৎসবের মাত্রা এমন এক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, একটির পোড়া মাংসের বিকট অসহনীয় গন্ধ বিলীন হতে না হতে আর একটির তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নতুন করে নাকে এসে লাগছে। কিন্তু আর কতকাল বাংলার আকাশে, বাতাসে এই পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়াতে থাকবে অবিরত!
… আমরা উন্নয়ন চাই কিন্তু বাতাসে মানুষের পোড়া মাংসের গন্ধের বিনিময়ে তা চাই না”।

★ এই নিবন্ধটি যখন লিখেছিলাম, তখন রূপগঞ্জে অবস্থিত হাসেম ফুডস লি.-এর ‘ সেজান জুস কারখানায়’ সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল। সে লেখাটিতে দেশের কোথাও আর যেন কোনো অগ্নি দুর্ঘটনায় কাউকে পুড়ে মরতে না হয়, সে আকুতি ঝরে পড়েছিল। কিন্তু আমার সে আকুতি কোনো কাজে আসেনি। এরপরও দেশে ঘটে গেছে আরো বেশ ক’টি অগ্নি দুর্ঘটনাÑ সীতাকুণ্ডে অবস্থিত ‘সীমা অক্সিজেন লি.’ নামক একটি প্লান্টে বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ড, ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনের (সেটিও ছিল একটি রেস্তোরাঁ) অগ্নিকাণ্ড , ছিদ্দিক বাজার ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পৃথক দুটি ঘটনায় সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড, এসব অগ্নিকাণ্ডে সব মিলে শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। সমসাময়িক বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট, কৃষি মার্কেটে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে জনের ক্ষতি না হলেও মালের যে ক্ষতি হয়েছে তার যন্ত্রণা যার মাল পুড়েছে সেই কেবল বুঝে। সর্বশেষ বেইলি রোডের এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখন আমাদের চোখের সামনে।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, একসময়ে আমাদের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল খুবই মামুলি একটা ব্যাপার। কিন্তু ইদানীং আমাদের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে উল্লেখ করার মতো অগ্নি দুর্ঘটনা আর ঘটছে না। এজন্য কিন্তু গার্মেন্ট ব্যবসায় জড়িত কর্তাব্যক্তিদের পুরোপুরি কৃতিত্ব দেওয়া যাচ্ছে না। কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে স্বীকৃতি যদি দিতেই হয়, তাহলে তা দিতে হবে আমাদের গার্মেন্ট সামগ্রীর বিদেশি ক্রেতাগণকেই। আমাদের বিদেশি ক্রেতাগণ যখন আমাদের গার্মেন্ট সামগ্রী কেনা থেকে বিরত থাকা শুরু করল এই বলে যে, ‘তোমাদের শ্রমিকদের গায়ের পোড়া মাংসের উপর দিয়ে তোমাদের তৈরি পোশাক আমাদের গায়ে আর চড়াবে না’, তখনই ‘ঠেলার নাম বাবাজি’Ñ এই আপ্তবাক্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে নিজ নিজ কারখানার কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনার দিকে গভীর মনোযোগী হলেন। ফলশ্রুতিতে বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সবক’টি গার্মেন্ট কারখানা এখন আমাদের দখলে। ‘মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ কখনো বেশি হয় না’, এ প্রবাদটিকে ভুল প্রমাণিত করে বিদেশি ক্রেতাগণ আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক ভাইদের রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করেছেন বিধায়ই আমাদের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে এখন অগ্নি দুর্ঘটনা তেমন একটা ঘটছে না। কিন্তু বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, বিপণি-বিতানগুলোতে বিদেশি ক্রেতাদের ন্যায় ‘মাসীর’ অনুপস্থিতির কারণে এসব জায়গাগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটন ঠেকানো যাচ্ছে না।

এসব অগ্নিকাণ্ড সংঘটনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকেই কোনোভাবে দায়ি করা যাচ্ছে না। সবাই যার যার দায়িত্ব সম্পর্কে নিজ নিজ সাফাই গেয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। বেইলী রোডের সাম্প্রতিক ঘটনার বেলায়ও একই কাহিনি। এখানে রাজউক বলছে, তারা আলোচ্য ভবনটি কেবলই অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হবে, এই শর্তে এটি তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু ভবন মালিক অফিস করার অনুমোদন নিয়ে রেস্তোরাঁর মতো বিপজ্জনক ব্যবসার কাজে ভাড়া দিয়ে যে অনৈতিক কাজ করেছে, তার দায় তারা নেবে কেন? অকাট্য যুক্তি বটে!
ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নি নির্বাপণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভবনটি যে ঝুঁকিপূর্ণ তা জানিয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার তাগিদ দিয়ে তারা ভবন মালিককে একাধিকবার নোটিস করেছে। কিন্তু ভবন মালিক তাদের কথা না শুনে যে অন্যায় করেছে, তার দায়ভার তারা নিবে কেন? এটিও অকাট্য যুক্তি বটে!
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, তারা তো কেবল রেস্তোরাঁর ব্যবসা করার জন্য একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে মাত্র। এই ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে লাইসেন্সধারী বৈধভাবেই ব্যবসা করে যাচ্ছিল, সে তো কোনো অবৈধ ব্যবসায়ে যুক্ত ছিল না। ভবনটি কি কাজের জন্য অনুমোদন ছিল, ভবনটিতে অগ্নি নির্পাণজনিত কোনো ত্রুটি ছিল কি না, এসব দেখার দায়িত্ব তো তাদের না। এ যুক্তিটিও অকাট্য বটে!

এই মুহূর্তে ভবন মালিক এবং সংশ্লিষ্ট রেস্তোরাঁর ব্যবসায়ীগণ একটুখানি মুসিবতের মধ্যে আছেন। সংগত কারণেই তারা এখন সরাসরি মিডিয়ার সামনে আসতে পারছেন না। তাই সরাসরি তাদের অকাট্য যুক্তিগুলো সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না। তবে ঘটনার ব্যাপারে তাদের যুক্তি কী হতে পারে তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়।
ভবন মালিক যুক্তি দেখাবেন, ‘আমি তো অফিস ভাড়া দেওয়ার জন্যই অনুমোদন নিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ যদি অফিস হিসেবে ভাড়া না নেয়, তাহলে আমি কী করতে পারি? এতো টাকা খরচ করে ভবন বানিয়ে তো এমনি এমনি ফেলে রাখতে পারি না। তাই রেস্টুরেন্ট মালিকদের নিকট সাময়িক সময়ের জন্য ভাড়া দিয়েছিলাম। অফিসের জন্য কেউ ভাড়া নিতে আসামাত্রই সব রেস্টুরেন্ট উঠিয়ে দিয়ে অফিস হিসেবে ভাড়া দিয়ে দিতাম। কিন্তু রেস্টুরেন্ট মালিকদের গাফিলতির কারণে এর মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এই ঘটনার জন্য অবশ্যই দায়ী হলো রেস্টুরেন্টের মালিক। কারণ আমি তো রেস্টুরেন্ট চালাই না, আমি তাদের নিকট এটি ভাড়া দিয়েছি মাত্র।’
-তা তো ঠিকই, তিনি তো রেস্টুরেন্ট চালান না, তিনি একটু বেশি লাভের আশায় রেস্টুরেন্ট হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন মাত্র। কম সময়ে বেশি লাভের আশা তো সবাই করে। যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

এদিকে রেস্টুরেন্টের মালিক বলবেন, ‘আমি যেহেতু রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, কাজেই আমি রেস্টুরেন্টের ব্যবসাই করবো। ভবনটি কিসের জন্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা দেখার দায়িত্ব তো আমার হতে পারে না। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিকঠাক মতো ছিল কি না সেটা দেখার দায়িত্ব ভবন মালিকের, আমার না। যেহেতু রেস্টুরেন্ট, কাজেই রান্নাবান্না করতেই হবে। আর রান্নার চুলা জ্বালাতে গ্যাস সিলিন্ডার দরকার। গ্যাসের সিলিন্ডার তো আমি বানাই না, ভাড়া করে আনি। এটি কি কারণে বিস্ফোরিত হলো সে জবাব দিবে সিলিন্ডার যে বানায় সে, এর জবাব আমি কেন দেবো?’
-বলা বাহুল্য এ জবাবটিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
তাহলে বিষয়টি দাঁড়াল, এ ঘটনায় কাউকেই দায়ি করা যাচ্ছে না। কিন্তু অঘটন যেহেতু একটা ঘটেছে, এর দায় তো কারো না কারো উপরে বর্তাতে হয়। দায় তাহলে কার? দোষটা কাকে দেওয়া যায়?
কাউকেই যেহেতু দোষী করা যাচ্ছে না, দোষটা তাহলে ওখানে যারা খেতে গিয়েছিল, তাদের দেয়া যায়।
ওখানে যারা খেতে গিয়েছিল, তাদের উচিত ছিল ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালানোর জন্য রাজউকের অনুমোদন ছিল কি না তা আগেই জেনে নেওয়া।
তাদের উচিত ছিল, ভবনটিতে যথেষ্ট পরিমাণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা চালু আছে কি না, তা ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে আগেই জেনে নেওয়া।
একটি ভবনে একসঙ্গে আটটি রেস্টুরেন্ট চালু ছিল, অথচ একটি মাত্র চিপা সিঁড়ি ছিল। আগুন-টাগুন লেগে গেলে একটি মাত্র চিপা সিঁড়ি দিয়ে নিরাপদে নামা যাবে কি না, খাবার খেতে যাওয়ার আগে তার একটা মহড়া তাদের দেয়া উচিত ছিল।
এতোগুলো করণীয় কাজের একটিও না করে তারা বেকুপের মতো দলে দলে ওখানে খেতে গিয়ে দোষ করেছিল, নিজের জীবন দিয়ে যার খেসারত তাদেরকেই দিতে হয়েছে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।

 

 

ভুয়া নথিপত্রে মিলছে ঋণ, সঠিকে জটিলতা

আবারো বাতাসে মানুষের পোড়া মাংসের গন্ধ

দায় তাহলে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’-এ যারা খেতে গিয়েছিল, তাদেরই!

আপডেট সময় : ১০:৫৬:৪৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ মার্চ ২০২৪

আবারো পুড়ে মরল মানুষ, আবারো বাতাসে ছড়াল মানুষের মাংস পোড়ার গন্ধ। বিষয়টি সৌভাগ্যবান আমরা যারা বেঁচে আছি, এরই মধ্যে সবাই তা জানি। এই মৃত্যু উপত্যকায় কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারানোর কবল থেকে এখনো আমরা যারা আপাতত নিরাপদ আছি, তাদেরকে সৌভাগ্যবানই তো বলতে হয়। হ্যাঁ, বেইলি রোডের সেই ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ নামক ভবনে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে প্রায় অর্ধশত অসহায় নরনারী আর অবুঝ শিশুর পুড়ে মরার ঘটনার কথা বলছি, যেখানে আবারো পুড়ে নিঃশেষ হলো কতো স্বপ্ন, শেষ হয়ে গেল অসহায়ের শেষ অবলম্বন। অবশ্য এমন ঘটনা এখন আর তেমন অপ্রত্যাশিত কিছু না। এ ঘটনাটির পর সাময়িক কিছুদিন বিরতি দিয়ে এই ঢাকায় কিংবা অন্য কোথাও আবারো এমনি একটা কিছু ঘটবে, আমরা না চাইলেও তা ঘটবে, এটি একপ্রকার নিশ্চিত।
ভবিষ্যতের কোনো কুক্ষণে সংঘটিতব্য লক্ষ্মীছাড়া ঘটনার শিকার হয়ে নতুন করে কার কার খাঁচার ভেতরের অচিন পাখিটি চিরতরে খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে সেটি নিশ্চিত করতে না পারাটাই কেবল অনিশ্চিত।

কিছুদিন পূর্বে ‘বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধের বিনিময়ে কাম্য নয় কোনো উন্নয়ন’,Ñ এই শিরোনামে একই বিষয়ে আমার একটি নিবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সে নিবন্ধটির প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি :
“পৃথিবীর সকল মানুষই জাতি, গোত্র নির্বিশেষে চায় বিশ্বে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। জাতি হিসেবে আমরাও তাই চাই। এ লক্ষ্যে আমরা এগিয়েও গিয়েছি বহুদূর। কিন্তু এই যে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, এটা কার জন্য? মানুষের জন্যই তো! এ উন্নয়ন তো মানুষে করে মানুষেরই জন্য! এই মানুষ যদি উন্নয়নের বলি হয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় জীবন্ত পুড়ে মরে একই সঙ্গে দশ/বিশ/পঞ্চাশ কিংবা শত সংখ্যায়, তাহলে এটা কি উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মেনে নেওয়া যায়!
… গার্মেন্ট সেক্টর নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। আবার এই গার্মেন্ট সেক্টরই জনমানুষের কাঠগড়ায় মানুষ পুড়িয়ে মারার প্রধান আসামি। কমপ্লায়েন্সের দিক থেকে বিশ্বের প্রথম শ্রেণির গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলো যেমন আমাদের দেশেই আছে, তেমনি আবার অতি মুনাফালোভী কিছু উদ্যোক্তা তাদের খামখেয়ালি আচরণ আর কর্মরত শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়নে অবহেলার কারণে বিশ্ব মিডিয়ায় আমাদের মানুষ পুড়ে মারার সংবাদে পরিণত করেছে। নিকট অতীতে তাজরিন ফ্যাশনস, ট্রাম্পাকো ফয়েলস, দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার, গরিব এন্ড গরিব গার্মেন্ট, ম্যালটি ফ্যাবস…, বলতে গেলে এ তালিকা কেবল দীর্ঘই হবে, যেখানে আমরা অবিশ্বাস্য নয়নে দেখেছি দোযখসম আগুনের লেলিহান শিখায় কিভাবে জীবন্ত পুড়ে মরেছে মানুষ। পুড়ে মরেছে বলার চেয়ে বরং পুড়িয়ে মারা হয়েছে বলাই অধিকতর শ্রেয়। এদের তালিকা আরও দীর্ঘ করেছে পুরান ঢাকার নিমতলী আর চকবাজারের রঙের কারখানা এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে একইভাবে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার বীভৎস খবর। কারখানায় জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার উৎসবে সর্বশেষ বলি হলো এই তো সেদিন রূপগঞ্জের একটি জুস ফ্যাক্টরিতে বায়ান্ন জন তরুণ-তরুণী। দিন যত যাচ্ছে পুড়ে মরার এহেন ঘটনার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
এ যেন মানুষ পুড়িয়ে মারার এক অগ্ন্যোৎসব। এই অগ্ন্যোৎসবের মাত্রা এমন এক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, একটির পোড়া মাংসের বিকট অসহনীয় গন্ধ বিলীন হতে না হতে আর একটির তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নতুন করে নাকে এসে লাগছে। কিন্তু আর কতকাল বাংলার আকাশে, বাতাসে এই পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়াতে থাকবে অবিরত!
… আমরা উন্নয়ন চাই কিন্তু বাতাসে মানুষের পোড়া মাংসের গন্ধের বিনিময়ে তা চাই না”।

★ এই নিবন্ধটি যখন লিখেছিলাম, তখন রূপগঞ্জে অবস্থিত হাসেম ফুডস লি.-এর ‘ সেজান জুস কারখানায়’ সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল। সে লেখাটিতে দেশের কোথাও আর যেন কোনো অগ্নি দুর্ঘটনায় কাউকে পুড়ে মরতে না হয়, সে আকুতি ঝরে পড়েছিল। কিন্তু আমার সে আকুতি কোনো কাজে আসেনি। এরপরও দেশে ঘটে গেছে আরো বেশ ক’টি অগ্নি দুর্ঘটনাÑ সীতাকুণ্ডে অবস্থিত ‘সীমা অক্সিজেন লি.’ নামক একটি প্লান্টে বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ড, ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনের (সেটিও ছিল একটি রেস্তোরাঁ) অগ্নিকাণ্ড , ছিদ্দিক বাজার ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পৃথক দুটি ঘটনায় সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড, এসব অগ্নিকাণ্ডে সব মিলে শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। সমসাময়িক বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট, কৃষি মার্কেটে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে জনের ক্ষতি না হলেও মালের যে ক্ষতি হয়েছে তার যন্ত্রণা যার মাল পুড়েছে সেই কেবল বুঝে। সর্বশেষ বেইলি রোডের এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখন আমাদের চোখের সামনে।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, একসময়ে আমাদের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল খুবই মামুলি একটা ব্যাপার। কিন্তু ইদানীং আমাদের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে উল্লেখ করার মতো অগ্নি দুর্ঘটনা আর ঘটছে না। এজন্য কিন্তু গার্মেন্ট ব্যবসায় জড়িত কর্তাব্যক্তিদের পুরোপুরি কৃতিত্ব দেওয়া যাচ্ছে না। কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে স্বীকৃতি যদি দিতেই হয়, তাহলে তা দিতে হবে আমাদের গার্মেন্ট সামগ্রীর বিদেশি ক্রেতাগণকেই। আমাদের বিদেশি ক্রেতাগণ যখন আমাদের গার্মেন্ট সামগ্রী কেনা থেকে বিরত থাকা শুরু করল এই বলে যে, ‘তোমাদের শ্রমিকদের গায়ের পোড়া মাংসের উপর দিয়ে তোমাদের তৈরি পোশাক আমাদের গায়ে আর চড়াবে না’, তখনই ‘ঠেলার নাম বাবাজি’Ñ এই আপ্তবাক্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে নিজ নিজ কারখানার কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনার দিকে গভীর মনোযোগী হলেন। ফলশ্রুতিতে বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সবক’টি গার্মেন্ট কারখানা এখন আমাদের দখলে। ‘মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ কখনো বেশি হয় না’, এ প্রবাদটিকে ভুল প্রমাণিত করে বিদেশি ক্রেতাগণ আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক ভাইদের রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করেছেন বিধায়ই আমাদের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে এখন অগ্নি দুর্ঘটনা তেমন একটা ঘটছে না। কিন্তু বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, বিপণি-বিতানগুলোতে বিদেশি ক্রেতাদের ন্যায় ‘মাসীর’ অনুপস্থিতির কারণে এসব জায়গাগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটন ঠেকানো যাচ্ছে না।

এসব অগ্নিকাণ্ড সংঘটনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকেই কোনোভাবে দায়ি করা যাচ্ছে না। সবাই যার যার দায়িত্ব সম্পর্কে নিজ নিজ সাফাই গেয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। বেইলী রোডের সাম্প্রতিক ঘটনার বেলায়ও একই কাহিনি। এখানে রাজউক বলছে, তারা আলোচ্য ভবনটি কেবলই অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হবে, এই শর্তে এটি তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু ভবন মালিক অফিস করার অনুমোদন নিয়ে রেস্তোরাঁর মতো বিপজ্জনক ব্যবসার কাজে ভাড়া দিয়ে যে অনৈতিক কাজ করেছে, তার দায় তারা নেবে কেন? অকাট্য যুক্তি বটে!
ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নি নির্বাপণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভবনটি যে ঝুঁকিপূর্ণ তা জানিয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার তাগিদ দিয়ে তারা ভবন মালিককে একাধিকবার নোটিস করেছে। কিন্তু ভবন মালিক তাদের কথা না শুনে যে অন্যায় করেছে, তার দায়ভার তারা নিবে কেন? এটিও অকাট্য যুক্তি বটে!
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, তারা তো কেবল রেস্তোরাঁর ব্যবসা করার জন্য একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে মাত্র। এই ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে লাইসেন্সধারী বৈধভাবেই ব্যবসা করে যাচ্ছিল, সে তো কোনো অবৈধ ব্যবসায়ে যুক্ত ছিল না। ভবনটি কি কাজের জন্য অনুমোদন ছিল, ভবনটিতে অগ্নি নির্পাণজনিত কোনো ত্রুটি ছিল কি না, এসব দেখার দায়িত্ব তো তাদের না। এ যুক্তিটিও অকাট্য বটে!

এই মুহূর্তে ভবন মালিক এবং সংশ্লিষ্ট রেস্তোরাঁর ব্যবসায়ীগণ একটুখানি মুসিবতের মধ্যে আছেন। সংগত কারণেই তারা এখন সরাসরি মিডিয়ার সামনে আসতে পারছেন না। তাই সরাসরি তাদের অকাট্য যুক্তিগুলো সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না। তবে ঘটনার ব্যাপারে তাদের যুক্তি কী হতে পারে তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়।
ভবন মালিক যুক্তি দেখাবেন, ‘আমি তো অফিস ভাড়া দেওয়ার জন্যই অনুমোদন নিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ যদি অফিস হিসেবে ভাড়া না নেয়, তাহলে আমি কী করতে পারি? এতো টাকা খরচ করে ভবন বানিয়ে তো এমনি এমনি ফেলে রাখতে পারি না। তাই রেস্টুরেন্ট মালিকদের নিকট সাময়িক সময়ের জন্য ভাড়া দিয়েছিলাম। অফিসের জন্য কেউ ভাড়া নিতে আসামাত্রই সব রেস্টুরেন্ট উঠিয়ে দিয়ে অফিস হিসেবে ভাড়া দিয়ে দিতাম। কিন্তু রেস্টুরেন্ট মালিকদের গাফিলতির কারণে এর মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এই ঘটনার জন্য অবশ্যই দায়ী হলো রেস্টুরেন্টের মালিক। কারণ আমি তো রেস্টুরেন্ট চালাই না, আমি তাদের নিকট এটি ভাড়া দিয়েছি মাত্র।’
-তা তো ঠিকই, তিনি তো রেস্টুরেন্ট চালান না, তিনি একটু বেশি লাভের আশায় রেস্টুরেন্ট হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন মাত্র। কম সময়ে বেশি লাভের আশা তো সবাই করে। যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

এদিকে রেস্টুরেন্টের মালিক বলবেন, ‘আমি যেহেতু রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, কাজেই আমি রেস্টুরেন্টের ব্যবসাই করবো। ভবনটি কিসের জন্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা দেখার দায়িত্ব তো আমার হতে পারে না। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিকঠাক মতো ছিল কি না সেটা দেখার দায়িত্ব ভবন মালিকের, আমার না। যেহেতু রেস্টুরেন্ট, কাজেই রান্নাবান্না করতেই হবে। আর রান্নার চুলা জ্বালাতে গ্যাস সিলিন্ডার দরকার। গ্যাসের সিলিন্ডার তো আমি বানাই না, ভাড়া করে আনি। এটি কি কারণে বিস্ফোরিত হলো সে জবাব দিবে সিলিন্ডার যে বানায় সে, এর জবাব আমি কেন দেবো?’
-বলা বাহুল্য এ জবাবটিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
তাহলে বিষয়টি দাঁড়াল, এ ঘটনায় কাউকেই দায়ি করা যাচ্ছে না। কিন্তু অঘটন যেহেতু একটা ঘটেছে, এর দায় তো কারো না কারো উপরে বর্তাতে হয়। দায় তাহলে কার? দোষটা কাকে দেওয়া যায়?
কাউকেই যেহেতু দোষী করা যাচ্ছে না, দোষটা তাহলে ওখানে যারা খেতে গিয়েছিল, তাদের দেয়া যায়।
ওখানে যারা খেতে গিয়েছিল, তাদের উচিত ছিল ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালানোর জন্য রাজউকের অনুমোদন ছিল কি না তা আগেই জেনে নেওয়া।
তাদের উচিত ছিল, ভবনটিতে যথেষ্ট পরিমাণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা চালু আছে কি না, তা ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে আগেই জেনে নেওয়া।
একটি ভবনে একসঙ্গে আটটি রেস্টুরেন্ট চালু ছিল, অথচ একটি মাত্র চিপা সিঁড়ি ছিল। আগুন-টাগুন লেগে গেলে একটি মাত্র চিপা সিঁড়ি দিয়ে নিরাপদে নামা যাবে কি না, খাবার খেতে যাওয়ার আগে তার একটা মহড়া তাদের দেয়া উচিত ছিল।
এতোগুলো করণীয় কাজের একটিও না করে তারা বেকুপের মতো দলে দলে ওখানে খেতে গিয়ে দোষ করেছিল, নিজের জীবন দিয়ে যার খেসারত তাদেরকেই দিতে হয়েছে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।