০৬:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তাপদাহের ঢাকা, মৃত্যুপুরী ঢাকা

কালের বিবর্তনে এক সময়ের সুন্দর ও সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো নগরী ঢাকা ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে তার ঐতিহ্য ও শ্যামলিমার সৌন্দর্য। ঢাকায় একদিকে যেমন বাড়ছে বায়ুদূষণ, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। কয়েকবছর ধরেই এপ্রিল মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপদাহ ও এক-দুইটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপদাহ বয়ে যায়।

২০২২ সালের ১৫ এপ্রিলে ঢাকায় ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল যা ১৯৬৫ সালের পর অর্থাৎ ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিলে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এই বছরে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

হঠাৎ করে এই তাপপ্রবাহ অনেকটা নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। ২০২৩ সালে বায়ুদূষণে সবচেয়ে দূষিত নগর হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে ঢাকা। এখন তাপমাত্রার এই উত্তরোত্তর ঊর্ধ্বগতি নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। যেখানে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সে. এর নিচে রাখার জন্য লড়াই চলছে ঠিক একই সময়ে ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সে.। তাপদাহের এই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরগুলোয় দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে যার কারণে সবসময়ই গরম অনুভূত হবে।

প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এই তিনটি কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছে স্থানীয় কারণগুলো। স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া।

এক সময় বাংলাদেশে ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ মাত্র ১৭ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে রাস্তার বিভাজনের বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হলো জলাধার কমে যাওয়া। গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে এবং জলাধারগুলো মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে।

ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে সেইসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। এর মধ্যে ৯টি স্থানে ছিল তাপমাত্রা বেশি। কারণ এগুলোয় গাছপালা কম ছিল। আর বাকি ৯টি স্থানে গাছপালা বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। এতেই প্রমাণিত সবুজ জলাভূমি তাপমাত্রা কম কিংবা বৃদ্ধির অন্যতম উৎস।

২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকায় ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল যা ১৯৬৫ সালের পর অর্থাৎ ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল।

তৃতীয়ত, ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যাও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ইউএস-ইপিএ-এর মতে সাধারণত প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য যেকোনো এলাকার তাপমাত্রা ১.৮-৫.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়তে পারে। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটিরও বেশি যা প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।

এছাড়া নগরের একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পুড়িয়ে থাকেন। এর বাইরে নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে। ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির চতুর্থ কারণ হলো যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো।

পঞ্চমত, রাজধানীর অধিক যানবাহন ও যানজট সমস্যাও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যানজটের কারণে গাড়িগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শহরের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে।

ষষ্ঠ কারণের মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা ও ফুটপাতে ঘাসের পরিবর্তে পাকাকরণ। দিনেরবেলায় এই রাস্তা ও ফুটপাত উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথমভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে এবং গভীর রাতে তাপ নির্গমনের মাধ্যমে নগরে তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সপ্তম কারণ হলো নতুন করে তৈরিকৃত বহুতল ভবনগুলোয় অতিরিক্ত গ্লাসের ও এসির ব্যবহার এবং ভবনের ভেতরের সরু রাস্তা। এতে করে গ্লাসে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।

প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এই তিনটি কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছে স্থানীয় কারণগুলো। স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (অফৎরবহহব অৎংযঃ – জড়পশবভবষষবৎ ঋড়ঁহফধঃরড়হ জবংরষরবহপব ঈবহঃবৎ)’-এর ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস : ইমপ্যাক্ট অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস (ঐড়ঃ ঈরঃরবং, ঈযরষষবফ ঊপড়হড়সরবং : ওসঢ়ধপঃং ড়ভ বীঃৎবসব যবধঃ ড়হ মষড়নধষ পরঃরবং)’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ঢাকায় উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর বিরূপ প্রভাব দুর্বল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের ওপর পড়ছে। ঢাকা শহরে তাপপ্রবাহের কারণে নভেল ভাইরাস এবং প্যাথোজেনগুলোর বেঁচে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগকে বাড়িয়ে তুলছে। উচ্চ তাপমাত্রায় ডিহাইড্রেশন, অ্যালার্জি, হিটক্র্যাম্প, হিটস্ট্রোক দেখা দেয়। গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং বর্ষাকাল অনেক দেরি করে আসে।

ঢাকা শহরের এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে এবং রাস্তার বিভাজনে গাছ লাগাতে হবে। ছাদ বাগান বৃদ্ধি করতে হবে। ঢাকায় জলাভূমির পরিমাণও বৃদ্ধি এবং দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। জলাভূমি ভরাট করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শহরাঞ্চল থেকে মানুষের আধিক্য কমাতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময় সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে।
যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। শহরের স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জননীতিকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সর্বোপরি সবাইকে এই তাপপ্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

জাল ভোট পড়লেই কেন্দ্র বন্ধের হুঁশিয়ারি

তাপদাহের ঢাকা, মৃত্যুপুরী ঢাকা

আপডেট সময় : ০৭:৩৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

কালের বিবর্তনে এক সময়ের সুন্দর ও সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো নগরী ঢাকা ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে তার ঐতিহ্য ও শ্যামলিমার সৌন্দর্য। ঢাকায় একদিকে যেমন বাড়ছে বায়ুদূষণ, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। কয়েকবছর ধরেই এপ্রিল মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপদাহ ও এক-দুইটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপদাহ বয়ে যায়।

২০২২ সালের ১৫ এপ্রিলে ঢাকায় ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল যা ১৯৬৫ সালের পর অর্থাৎ ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিলে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এই বছরে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

হঠাৎ করে এই তাপপ্রবাহ অনেকটা নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। ২০২৩ সালে বায়ুদূষণে সবচেয়ে দূষিত নগর হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে ঢাকা। এখন তাপমাত্রার এই উত্তরোত্তর ঊর্ধ্বগতি নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। যেখানে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সে. এর নিচে রাখার জন্য লড়াই চলছে ঠিক একই সময়ে ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সে.। তাপদাহের এই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরগুলোয় দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে যার কারণে সবসময়ই গরম অনুভূত হবে।

প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এই তিনটি কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছে স্থানীয় কারণগুলো। স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া।

এক সময় বাংলাদেশে ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ মাত্র ১৭ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে রাস্তার বিভাজনের বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হলো জলাধার কমে যাওয়া। গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে এবং জলাধারগুলো মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে।

ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে সেইসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। এর মধ্যে ৯টি স্থানে ছিল তাপমাত্রা বেশি। কারণ এগুলোয় গাছপালা কম ছিল। আর বাকি ৯টি স্থানে গাছপালা বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। এতেই প্রমাণিত সবুজ জলাভূমি তাপমাত্রা কম কিংবা বৃদ্ধির অন্যতম উৎস।

২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকায় ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল যা ১৯৬৫ সালের পর অর্থাৎ ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল।

তৃতীয়ত, ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যাও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ইউএস-ইপিএ-এর মতে সাধারণত প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য যেকোনো এলাকার তাপমাত্রা ১.৮-৫.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়তে পারে। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটিরও বেশি যা প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।

এছাড়া নগরের একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পুড়িয়ে থাকেন। এর বাইরে নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে। ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির চতুর্থ কারণ হলো যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো।

পঞ্চমত, রাজধানীর অধিক যানবাহন ও যানজট সমস্যাও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যানজটের কারণে গাড়িগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শহরের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে।

ষষ্ঠ কারণের মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা ও ফুটপাতে ঘাসের পরিবর্তে পাকাকরণ। দিনেরবেলায় এই রাস্তা ও ফুটপাত উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথমভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে এবং গভীর রাতে তাপ নির্গমনের মাধ্যমে নগরে তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সপ্তম কারণ হলো নতুন করে তৈরিকৃত বহুতল ভবনগুলোয় অতিরিক্ত গ্লাসের ও এসির ব্যবহার এবং ভবনের ভেতরের সরু রাস্তা। এতে করে গ্লাসে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।

প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এই তিনটি কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছে স্থানীয় কারণগুলো। স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (অফৎরবহহব অৎংযঃ – জড়পশবভবষষবৎ ঋড়ঁহফধঃরড়হ জবংরষরবহপব ঈবহঃবৎ)’-এর ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস : ইমপ্যাক্ট অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস (ঐড়ঃ ঈরঃরবং, ঈযরষষবফ ঊপড়হড়সরবং : ওসঢ়ধপঃং ড়ভ বীঃৎবসব যবধঃ ড়হ মষড়নধষ পরঃরবং)’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ঢাকায় উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর বিরূপ প্রভাব দুর্বল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের ওপর পড়ছে। ঢাকা শহরে তাপপ্রবাহের কারণে নভেল ভাইরাস এবং প্যাথোজেনগুলোর বেঁচে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগকে বাড়িয়ে তুলছে। উচ্চ তাপমাত্রায় ডিহাইড্রেশন, অ্যালার্জি, হিটক্র্যাম্প, হিটস্ট্রোক দেখা দেয়। গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং বর্ষাকাল অনেক দেরি করে আসে।

ঢাকা শহরের এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে এবং রাস্তার বিভাজনে গাছ লাগাতে হবে। ছাদ বাগান বৃদ্ধি করতে হবে। ঢাকায় জলাভূমির পরিমাণও বৃদ্ধি এবং দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। জলাভূমি ভরাট করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শহরাঞ্চল থেকে মানুষের আধিক্য কমাতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময় সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে।
যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। শহরের স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জননীতিকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সর্বোপরি সবাইকে এই তাপপ্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।