➤নির্দেশনার কথা এখনো জানেন না ব্যবসায়ীরা
➤লাগামহীন দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস
➤নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে
➤নির্ধারিত দামে মিলছে না দুই পদের খেজুরও
➤দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের মনিটরিং জোরদারের পরামর্শ
অনেক দিন ধরেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সরকার দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানার কথা বললেও বাস্তবে এর প্রতিফলন সামান্যই। রমজান এলেই মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় লেগে যায় ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন অজুহাতে প্রতি বছর বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম এবারো রমজানে নিত্যপণ্যের চড়া দাম কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সরবরাহ কম, ভ্যাট বেশি, ডলার সংকটের মতো নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়েই চলছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গত শুক্রবার গরুর গোশত, ছোলা, ব্রয়লার মুরগিসহ ২৯ নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয় সরকার। তবে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ পণ্য নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। যেসব পণ্যের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা আগের বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে, আর যেসব পণ্যের দাম আগে থেকেই কম ছিল তা একই দামে বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোন পদক্ষেপ কাজে আসছে না। জিনিসপত্রের লাগামহীন দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে মানুষ আজ দিশেহারা। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মনিটরিং জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে কিছু সবজির দাম কমেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী প্রতিকেজি গরুর গোশত ভোক্তা পর্যায়ে ৬৬৪ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে ৭৭০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ভোক্তা পর্যায়ে ১৭৫ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৬২ টাকা দরে বিক্রির কথা থাকলেও ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৬২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, গতকালও তারা ১৮৫ টাকা দরে পাইকারি কিনেছেন, তাই তারা খুচরা ২১০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন।
খুচরা বাজারে ছোলার দাম ৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে। মুগডাল ভোক্তা পর্যায়ে ১৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রির কথা থাকলেও বাজারে এই পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা দরে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা ও দেশি রসুন ১২০ টাকা বিক্রির কথা থাকলেও মানভেদে দেশি পেঁয়াজ ৯০-১১০ টাকা ও নতুন দেশি রসুন ১৫০ টাকা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে দুইটি মাছের দাম বেঁধে দেয় সরকার। চাষের পাঙ্গাশ ১৮০ টাকা ও কাতলা ৩৫৩ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেয়। তবে আগে থেকেই পাঙ্গাশ ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাতল মাছও আগে থেকে সাড়ে ৩০০ দরে বিক্রি হচ্ছিল।
সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারি প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে তারা অবগত নয়। তারা বলেন সরকার বাজারের অবস্থা বিবেচনা না করে পণ্যের মূল্য তালিকা নির্ধারণ করে যে দামে বিক্রি করার কথা উল্লেখ করে ওই দামে আমরা পাইকারদের কাছ থেকেও কিনতে পারি না।
খেঁজুরের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই ধরনের খেজুরের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বাজারে সরকারের এই নির্দেশনার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে, খুচরা বাজারে অতি সাধারণ ও নিম্নমানের খেজুরের কেজিপ্রতি দাম হবে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং বহুল ব্যবহৃত জাইদি খেজুরের প্রতি কেজির দাম ১৭০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে থাকতে হবে। মগবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি জাইদি খেজুর ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অতি সাধারণ ও নিম্নমানের খেজুরের সরকার নির্ধারিত দাম সর্বোচ্চ ১৬৫ টাকা। কিন্তু এসব খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকার আশপাশে।
বাজারে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে তাঁরা যে খেজুর কিনেছেন, তার দাম বাড়তি ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার খুচরা বাজারের জন্য যে দাম বেঁধে দিয়েছে, পাইকারি বাজারেই তার কাছাকাছি দামে তাঁদেরকে খেজুর কিনতে হয়েছে।
সরকার নির্ধারিত দাম নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ভোক্তার মধ্যে। বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. আমজাদ বলেন, কোথায় সরকার জিনিসের দাম কমাবে, তা না করে আরও বাড়াই দিচ্ছে। পাঙ্গাশ তো ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হইতো, সেইটা ১৮০ টাকা কেমনে নির্ধারণ করে বলেন।
সরকার নির্ধারিত দামের বিষয়ে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের বিসমিল্লাহ স্টোরের মো. রাসেল বলেন, সরকার গতকাল ২৯টি খাদ্য পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা টিভিতে দেখছি। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত কমদামে বা সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য কিনতে পারিনি। এজন্য আমরা আগের দামেই পণ্য বিক্রি করছি। আমরা প্রতি কেজি মুগডাল ১৬০ টাকা, মুসুর ১১০ থেকে ১৩৫ টাকা, মাসকালাই ডাল ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা, মটরডাল ১৬০ টাকা, ছোলার ডাল ১১০ টাকা, খেসারি ডাল ১৪০ টাকা। পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৮৫ টাকা, চায়না রসুন ২০০ টাকা, দেশি রসুন ১৫০ টাকা এবং চায়না আদা ১৮০ টাকা, কেরালা ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।
মালিবাগ বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. খায়রুল বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা আগের দামেই বিক্রি করছি। দাম নির্ধারণ করে কি আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? আলু আজকে কিনে আনছি ৩২ টাকা ৫০ টাকা কেজি। পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। গাড়ি ভাড়াও কিলোমিটার অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেন তাহলে দাম কমে যাবে।
বাজার করতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের পণ্যে বাজারে মিলে না। দিনদিন মাছ-মাংসের দাম বেড়েই চলেছে। গত সপ্তাহের তুলনায় আজকে দেখছি মাছের বাজার চড়া। যে কারণে কিনতে গেলেও বারবার হিসেব করতে হয়। এখন আর আগের মতো প্রতি সপ্তাহেই গরুর মাংস কেনা যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই রোজা উপলক্ষে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে বিশার মূল্য ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশই বোধহয় একমাত্র দেশ, যেখানে ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতা করে দাম বাড়ায়। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্য।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরবরাহ ও চাহিদা বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। মুক্তবাজারের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি না হলে নির্ধারণ করে দিয়ে মূল্য কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। সবচেয়ে বড় কথা ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি হচ্ছে। সেটা বন্ধে সরকারকে আগে নজর দিতে হবে।


























