১০:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অবর্ণনীয় এই কষ্টের শেষ কোথায়

গাজায় ইসরায়েলি হামলার ৬ মাস

◉ জায়গা নেই হাসপাতালে, চলছে চিকিৎসা তাঁবুতে
◉বৃহত্তম হাসপাতাল এখন সমাধিক্ষেত্র : ডব্লিউএইচও
◉ ইসরায়েলের প্রায় ৫০ জায়গায় বিক্ষোভ-সমাবেশ

 

দখলদার ইসরায়েলি নৃশংসতার ছয় মাস পার করলেন স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনের গাজাবাসী। এই সময়টাতে দুর্দশার চরম রূপটা দেখেছেন উপত্যকাটির বাসিন্দারা। শিগগিরই এ দুর্দশা কাটার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞের মতে, চলমান সংঘাত থামাতে ইসরায়েলের কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নেই। যদিও রক্তক্ষয়ী এ সংঘাত ঘিরে নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছে দেশটি। গত বছরের সাত অক্টোবর থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা কর্তৃপক্ষ শনিবার জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় গত ছয় মাসে উপত্যকাটিতে ৩৩ হাজার ১৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৫ হাজার ৮১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০ শতাংশই নিরপরাধ শিশু। রয়েছেন বহু নারীও।

হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও গত ছয় মাসে গাজায় অবর্ণনীয় তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরায়েল। উপত্যকাটির অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ৩৯২টি স্থাপনা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের ২৪টির বেশি সেবা দিতে পারছে না। ১২৩টি অ্যাম্বুলেন্স আর ব্যবহারযোগ্য নেই। ইসরায়েলে হামলা থেকে রেহাই পায়নি সেখানকার ১৮৪টি মসজিদও। হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি গাজা অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। প্রয়োজনীয় ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না। এতে চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন গাজার বাসিন্দারা। সেখানে নেই খাবার, নেই পানি, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। তারপর আবার হামলার মুখে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার তিন-চতুর্থাংশ বাসিন্দা। সতর্কতা জারি করে জাতিসংঘ বলেছে, গাজা দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়ছে ইসরায়েল সরকার। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রও এখন গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার সমালোচনায় মুখর হয়েছে। বিশ্বজুড়ে চলছে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ। সাত অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের দেশে ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভের জোয়ার উঠেছে ইসরায়েলেও। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করছেন অনেক ইসরায়েলি।

লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ ইসরায়েল : ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর সময় গাজায় দুটি লক্ষ্যের কথা জানিয়েছিল ইসরায়েল। প্রথমটি : উপত্যকাটির শাসকগোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল। দ্বিতীয়টি : হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের দেশে ফিরিয়ে আনা। বিশ্লেষকদের ভাষ্য, গত ছয় মাসে এই দুই লক্ষ্যের কোনোটিই অর্জন করতে পারেননি নেতানিয়াহু। যদিও চলমান সংঘাতে গাজায় নিজেদের সফলতার কিছু ফিরিস্তি দিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। তাদের দাবি, শীর্ষস্থানীয় বেশির ভাগ নেতাসহ হামাসের কয়েক হাজার সদস্যকে হত্যা করেছে তারা। গত নভেম্বরে যুদ্ধবিরতির সময় শতাধিক জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এরপরও হামাসের হাতে বর্তমানে জিম্মি প্রায় ১৩০ জন। আশঙ্কা তাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক খালেদ এলগিন্দি বলেন, গাজায় চলমান সংঘাতের স্থায়িত্ব, তীব্রতা, ব্যাপকতা ও প্রাণহানি নিয়ে সবাই যে আশঙ্কা করছিলেন, আমার ধারণা, তা বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে। গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে ইসরায়েলের কোনো কার্যকর পরিকল্পনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। কেউই জানেন না কবে, কীভাবে এ যুদ্ধ শেষ হবে।

হামাস নির্মূল অসম্ভব : ২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন শুরু করে হামাস। তখন থেকেই উপত্যকাটির নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক নানা বিষয়ের দেখভাল করে আসছে সংগঠনটি। হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্য নিয়ে ইসরায়েল হামলা শুরু করেছিল, তার পক্ষে দেশটির প্রায় সব মানুষ। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। ৭ অক্টোবর গাজাজুড়ে বোমাবর্ষণ শুরুর পর ওই মাসের শেষের দিকে উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। পরে দক্ষিণেও স্থল অভিযান চালানো হয়। ইসরায়েলের দাবি, এসব অঞ্চলে হামাসকে পরাজিত করেছে তারা। এখন ইসরায়েলের লক্ষ্য সর্ব দক্ষিণে মিসর সীমান্তের রাফা এলাকা। হামলার মুখে গাজার ২৪ লাখ বাসিন্দার বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। জেরুজালেমভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও লেখক নাথান থরাল বলেন, ‘ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করতে পারবে না। কারণ, পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। বিগত মাসগুলোয় হামাসের জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে। উত্তরে হামাসকে পরাজিত করা হয়েছে ইসরায়েলের এমন দাবির পর থেকে আপনি দেখতে পাবেন, প্রতি সপ্তাহেই সেখানে ইসরায়েলি সেনারা মারা যাচ্ছেন। ইসরায়েল রাফায় হামলা চালাক বা না চালাক, তাই এটা পরিষ্কার যে, যুদ্ধের পরও হামাস থেকে যাবে। এর অর্থ সংঘাত থেকে বের হওয়ার কার্যকর কোনো পথ খোলা নেই ইসরায়েলি নেতাদের সামনে।

ভবিষ্যতে কী হবে : গত ফেব্রুয়ারিতে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, যুদ্ধের পর তিনি গাজাকে সম্পূর্ণ অস্ত্রমুক্ত করতে চান। মিসরের সঙ্গে উপত্যকাটির সীমান্তও বন্ধ করবেন। ঢেলে সাজাবেন সেখানকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। একই সময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মহলের যে চাপ রয়েছে, তা–ও অগ্রাহ্য করেন তিনি। যুদ্ধের পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের গাজা শাসনের বিষয়টিও উড়িয়ে দিয়েছে তার সরকার। গাজায় শিগগিরই যুদ্ধবিরতির কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। গত নভেম্বরের পর নতুন যুদ্ধবিরতির সব আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হলেও তা নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার। জাতিসংঘের সমালোচনা করে নেতানিয়াহু সরকার বলেছে, কেউ পাশে না থাকলেও গাজায় হামলা চালিয়ে যাবে তারা। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কী হতে পারে, তা সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছেন গবেষক খালেদ এলগিন্দি। তিনি বলেন, যেটা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তা হলো গাজায় অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী থেকে যাবে। এতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। বিশৃঙ্খলা বাড়তে পারে। কেউ যদি মনে করে গাজায় এমন অবস্থা চলছে, তা ইসরায়েলিদের জন্য নিরাপত্তা বয়ে আনবে, তাহলে তিনি বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।

ইসরায়েলে লাখো মানুষের সমাবেশ : গাজায় থাকা জিম্মিদের মুক্তির জন্য চুক্তি দাবি করে এক লাখ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরোধীরা। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জিম্মি এলাদ কাৎজিরের মরদেহ উদ্ধার করার পর তেল আবিবসহ ইসরায়েলের অন্যান্য শহরে সমাবেশ হয়। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা এখনই নির্বাচন, এলাদ, আমরা দুঃখিত বলে স্লোগান দেন। গতকাল ইসরায়েল-হামাস মধ্যকার চলমান যুদ্ধের ছয় মাস পূর্ণ হয়। গাজায় থাকা জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা ইসরায়েলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেন। বিক্ষোভকারীরা গাজায় হামাস ও সংগঠনটির সহযোগীদের হাতে থাকা প্রায় ১৩০ জিম্মিকে মুক্ত করতে ইসরায়েল সরকারের অক্ষমতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।

গত শনিবার গাজা থেকে এলাদের মরদেহ উদ্ধার করে আইডিএফ। গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাস হামলা চালিয়ে তাকেসহ অন্যদের জিম্মি করে নিয়েছিল হামাস। গত জানুয়ারিতে হামাস প্রকাশিত এক ভিডিওতে এলাদকে জীবিত দেখা গিয়েছিল। আয়োজকেরা বলেন, বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের প্রায় ৫০ জায়গায় সমাবেশ করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে এলাদের বোন কারমিট পালটি কাৎজির বলেছেন, সরকার একটি নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হলে এলাদ জীবিত ফিরে আসতেন। আমাদের নেতৃত্ব কাপুরুষ এবং রাজনৈতিক বিবেচনা দ্বারা চালিত। যে কারণে এই চুক্তিটি এখনো হয়নি।

জায়গা নেই হাসপাতালে, চলছে চিকিৎসা তাঁবুতে মধ্য গাজার আল আকসা হাসপাতালে জায়গা না থাকায় বাইরে টেন্টে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসাকর্মীরা। শনিবার এই পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন হাসপাতালের এক মুখপাত্র। এদিকে গাজায় ১৯৬ ত্রাণকর্মী নিহতের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে জাতিসংঘ। অন্যদিকে গাজা থেকে জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এছাড়া আল-আকসা মসজিদ থেকে ১৬ মুসল্লিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাসপাতালের মুখপাত্র জানান, প্রতিদিন কয়েক ডজন আহত ফিলিস্তিনিকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। এতো চাপে পরিস্থিতি অস্বাস্থ্যকর হয়ে গেছে। তাছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামেরও সরবরাহ নেই। তাই নতুন রোগীদের জন্য বাইরে তাবু স্থাপন করা হয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ, ওষুধ ও জ্বালানি পর্যাপ্ত পরিমাণ নেই। অপারেটিং রুমে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে অর্থোপেডিকসের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ নেই।

এদিকে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর ‘সামরিক অভিযানে’ ১৯৬ ত্রাণকর্মী নিহত হওয়ার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে জাতিসংঘ। গত সোমবার গাজার দেইর আল বালাহতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক খাদ্য সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের (ডব্লিউসিকে) গাড়িতে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এতে ৭ ত্রাণকর্মী নিহত হন। তাদের মধ্যে একজন অস্ট্রেলিয়ার, তিন জন যুক্তরাজ্যের, একজন যুক্তরাষ্ট্রের, একজন পোল্যান্ডের ও একজন ফিলিস্তিনের নাগরিক। ইসরায়েল প্রথমে এ ঘটনার দায় সুকৌশলে এড়াতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপে দখলদার নেতানিয়াহু প্রশাসন দায় স্বীকার করতে বাধ্য হয় ও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়। এমনকি এ ঘটনায় দায়ী দুই সেনা কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করে ইসরায়েলি প্রশাসন।

শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ইসরায়েল তাদের ভুল স্বীকার করেছে। এটা ইতিবাচক হলেও ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধকৌশল ও পদ্ধতির কারণে গাজায় এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ১৯৬ জন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। আমরা প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। আমরা জানতে চাই, কেন ত্রাণকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া, গাজায় হামলার পাশাপাশি সেখানে ত্রাণ সরবরাহেও বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। ফলে অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় বসবাসরত ২২ লাখ ফিলিস্তিনি ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়েছে। খাবার-পানির অভাবে উপত্যকাটিতে মানুষের মৃত্যুও শুরু হয়েছে। এ ইস্যুতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, যখন সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তখন ক্ষুধার জ্বালা শুরু হয়। বর্তমানে গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ভয়াবহ ক্ষুধার মুখোমুখি। এমনকি, খাদ্য ও পানির অভাবে শিশুরা মারা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি সহ্য করার মতো নয় এবং চাইলেই এটি এড়ানো সম্ভব। এজন্য ইসরায়েলকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে।

গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল এখন সমাধিক্ষেত্র : ডব্লিউএইচও ইসরায়েলের হামলার পর গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল এখন একটি কঙ্কালসার কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়েছে, যার ভেতরে রয়েছে শুধুই মরদেহ এবং সমাধি, দাবি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। দুই সপ্তাহ অভিযান চালানোর পর গত সোমবার গাজার আল-শিফা হাসপাতাল থেকে সরে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েল দাবি করে, এই পুরো সময়টায় তারা হাসপাতালের ভেতর ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধ করেছে। এরপর শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দল ওই হাসপাতালের ভেতর ঢোকার অনুমতি পায়। তারা ২৫ মার্চ থেকেই আল-শিফায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল। হাসপাতালটির ভেতরে তারা অন্তত পাঁচটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে। পেয়েছে অনেকের সমাধি। গাজায় স্বাস্থ্যসেবার মেরুদণ্ড ছিল এই হাসপাতালটি। কিন্তু ইসরায়েলের হামলায় তার প্রতিটি ইঞ্চি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। হাসপাতালের মূল্যবান সরঞ্জাম হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নয়তো একেবারেই ধুলোয় মিশে গেছে। ভবিষ্যতে এই হাসপাতাল আবার ব্যবহারযোগ্য হবে কিনা তাও বলার উপায় নেই। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মাঝে মাত্র ১০টি আংশিক চলমান আছে বর্তমানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস বলেছেন, গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন, ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রোগ, হামলায় আহত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। গাজায় থাকা অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনার সুরক্ষা চান তিনি, এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মী এবং ত্রাণকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানান। গাজায় নির্বিঘ্নে ত্রাণ প্রবেশ এবং যুদ্ধবিরতির দাবি করেন তিনি।

জনপ্রিয় সংবাদ

মূল্যস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী

অবর্ণনীয় এই কষ্টের শেষ কোথায়

আপডেট সময় : ০৭:০২:৪১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ এপ্রিল ২০২৪

◉ জায়গা নেই হাসপাতালে, চলছে চিকিৎসা তাঁবুতে
◉বৃহত্তম হাসপাতাল এখন সমাধিক্ষেত্র : ডব্লিউএইচও
◉ ইসরায়েলের প্রায় ৫০ জায়গায় বিক্ষোভ-সমাবেশ

 

দখলদার ইসরায়েলি নৃশংসতার ছয় মাস পার করলেন স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনের গাজাবাসী। এই সময়টাতে দুর্দশার চরম রূপটা দেখেছেন উপত্যকাটির বাসিন্দারা। শিগগিরই এ দুর্দশা কাটার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞের মতে, চলমান সংঘাত থামাতে ইসরায়েলের কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নেই। যদিও রক্তক্ষয়ী এ সংঘাত ঘিরে নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছে দেশটি। গত বছরের সাত অক্টোবর থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা কর্তৃপক্ষ শনিবার জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় গত ছয় মাসে উপত্যকাটিতে ৩৩ হাজার ১৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৫ হাজার ৮১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০ শতাংশই নিরপরাধ শিশু। রয়েছেন বহু নারীও।

হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও গত ছয় মাসে গাজায় অবর্ণনীয় তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরায়েল। উপত্যকাটির অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ৩৯২টি স্থাপনা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের ২৪টির বেশি সেবা দিতে পারছে না। ১২৩টি অ্যাম্বুলেন্স আর ব্যবহারযোগ্য নেই। ইসরায়েলে হামলা থেকে রেহাই পায়নি সেখানকার ১৮৪টি মসজিদও। হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি গাজা অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। প্রয়োজনীয় ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না। এতে চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন গাজার বাসিন্দারা। সেখানে নেই খাবার, নেই পানি, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। তারপর আবার হামলার মুখে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার তিন-চতুর্থাংশ বাসিন্দা। সতর্কতা জারি করে জাতিসংঘ বলেছে, গাজা দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়ছে ইসরায়েল সরকার। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রও এখন গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার সমালোচনায় মুখর হয়েছে। বিশ্বজুড়ে চলছে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ। সাত অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের দেশে ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভের জোয়ার উঠেছে ইসরায়েলেও। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করছেন অনেক ইসরায়েলি।

লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ ইসরায়েল : ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর সময় গাজায় দুটি লক্ষ্যের কথা জানিয়েছিল ইসরায়েল। প্রথমটি : উপত্যকাটির শাসকগোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল। দ্বিতীয়টি : হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের দেশে ফিরিয়ে আনা। বিশ্লেষকদের ভাষ্য, গত ছয় মাসে এই দুই লক্ষ্যের কোনোটিই অর্জন করতে পারেননি নেতানিয়াহু। যদিও চলমান সংঘাতে গাজায় নিজেদের সফলতার কিছু ফিরিস্তি দিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। তাদের দাবি, শীর্ষস্থানীয় বেশির ভাগ নেতাসহ হামাসের কয়েক হাজার সদস্যকে হত্যা করেছে তারা। গত নভেম্বরে যুদ্ধবিরতির সময় শতাধিক জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এরপরও হামাসের হাতে বর্তমানে জিম্মি প্রায় ১৩০ জন। আশঙ্কা তাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক খালেদ এলগিন্দি বলেন, গাজায় চলমান সংঘাতের স্থায়িত্ব, তীব্রতা, ব্যাপকতা ও প্রাণহানি নিয়ে সবাই যে আশঙ্কা করছিলেন, আমার ধারণা, তা বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে। গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে ইসরায়েলের কোনো কার্যকর পরিকল্পনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। কেউই জানেন না কবে, কীভাবে এ যুদ্ধ শেষ হবে।

হামাস নির্মূল অসম্ভব : ২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন শুরু করে হামাস। তখন থেকেই উপত্যকাটির নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক নানা বিষয়ের দেখভাল করে আসছে সংগঠনটি। হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্য নিয়ে ইসরায়েল হামলা শুরু করেছিল, তার পক্ষে দেশটির প্রায় সব মানুষ। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। ৭ অক্টোবর গাজাজুড়ে বোমাবর্ষণ শুরুর পর ওই মাসের শেষের দিকে উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। পরে দক্ষিণেও স্থল অভিযান চালানো হয়। ইসরায়েলের দাবি, এসব অঞ্চলে হামাসকে পরাজিত করেছে তারা। এখন ইসরায়েলের লক্ষ্য সর্ব দক্ষিণে মিসর সীমান্তের রাফা এলাকা। হামলার মুখে গাজার ২৪ লাখ বাসিন্দার বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। জেরুজালেমভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও লেখক নাথান থরাল বলেন, ‘ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করতে পারবে না। কারণ, পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। বিগত মাসগুলোয় হামাসের জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে। উত্তরে হামাসকে পরাজিত করা হয়েছে ইসরায়েলের এমন দাবির পর থেকে আপনি দেখতে পাবেন, প্রতি সপ্তাহেই সেখানে ইসরায়েলি সেনারা মারা যাচ্ছেন। ইসরায়েল রাফায় হামলা চালাক বা না চালাক, তাই এটা পরিষ্কার যে, যুদ্ধের পরও হামাস থেকে যাবে। এর অর্থ সংঘাত থেকে বের হওয়ার কার্যকর কোনো পথ খোলা নেই ইসরায়েলি নেতাদের সামনে।

ভবিষ্যতে কী হবে : গত ফেব্রুয়ারিতে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, যুদ্ধের পর তিনি গাজাকে সম্পূর্ণ অস্ত্রমুক্ত করতে চান। মিসরের সঙ্গে উপত্যকাটির সীমান্তও বন্ধ করবেন। ঢেলে সাজাবেন সেখানকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। একই সময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মহলের যে চাপ রয়েছে, তা–ও অগ্রাহ্য করেন তিনি। যুদ্ধের পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের গাজা শাসনের বিষয়টিও উড়িয়ে দিয়েছে তার সরকার। গাজায় শিগগিরই যুদ্ধবিরতির কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। গত নভেম্বরের পর নতুন যুদ্ধবিরতির সব আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হলেও তা নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার। জাতিসংঘের সমালোচনা করে নেতানিয়াহু সরকার বলেছে, কেউ পাশে না থাকলেও গাজায় হামলা চালিয়ে যাবে তারা। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কী হতে পারে, তা সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছেন গবেষক খালেদ এলগিন্দি। তিনি বলেন, যেটা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তা হলো গাজায় অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী থেকে যাবে। এতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। বিশৃঙ্খলা বাড়তে পারে। কেউ যদি মনে করে গাজায় এমন অবস্থা চলছে, তা ইসরায়েলিদের জন্য নিরাপত্তা বয়ে আনবে, তাহলে তিনি বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।

ইসরায়েলে লাখো মানুষের সমাবেশ : গাজায় থাকা জিম্মিদের মুক্তির জন্য চুক্তি দাবি করে এক লাখ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরোধীরা। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জিম্মি এলাদ কাৎজিরের মরদেহ উদ্ধার করার পর তেল আবিবসহ ইসরায়েলের অন্যান্য শহরে সমাবেশ হয়। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা এখনই নির্বাচন, এলাদ, আমরা দুঃখিত বলে স্লোগান দেন। গতকাল ইসরায়েল-হামাস মধ্যকার চলমান যুদ্ধের ছয় মাস পূর্ণ হয়। গাজায় থাকা জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা ইসরায়েলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেন। বিক্ষোভকারীরা গাজায় হামাস ও সংগঠনটির সহযোগীদের হাতে থাকা প্রায় ১৩০ জিম্মিকে মুক্ত করতে ইসরায়েল সরকারের অক্ষমতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।

গত শনিবার গাজা থেকে এলাদের মরদেহ উদ্ধার করে আইডিএফ। গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাস হামলা চালিয়ে তাকেসহ অন্যদের জিম্মি করে নিয়েছিল হামাস। গত জানুয়ারিতে হামাস প্রকাশিত এক ভিডিওতে এলাদকে জীবিত দেখা গিয়েছিল। আয়োজকেরা বলেন, বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের প্রায় ৫০ জায়গায় সমাবেশ করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে এলাদের বোন কারমিট পালটি কাৎজির বলেছেন, সরকার একটি নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হলে এলাদ জীবিত ফিরে আসতেন। আমাদের নেতৃত্ব কাপুরুষ এবং রাজনৈতিক বিবেচনা দ্বারা চালিত। যে কারণে এই চুক্তিটি এখনো হয়নি।

জায়গা নেই হাসপাতালে, চলছে চিকিৎসা তাঁবুতে মধ্য গাজার আল আকসা হাসপাতালে জায়গা না থাকায় বাইরে টেন্টে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসাকর্মীরা। শনিবার এই পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন হাসপাতালের এক মুখপাত্র। এদিকে গাজায় ১৯৬ ত্রাণকর্মী নিহতের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে জাতিসংঘ। অন্যদিকে গাজা থেকে জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এছাড়া আল-আকসা মসজিদ থেকে ১৬ মুসল্লিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাসপাতালের মুখপাত্র জানান, প্রতিদিন কয়েক ডজন আহত ফিলিস্তিনিকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। এতো চাপে পরিস্থিতি অস্বাস্থ্যকর হয়ে গেছে। তাছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামেরও সরবরাহ নেই। তাই নতুন রোগীদের জন্য বাইরে তাবু স্থাপন করা হয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ, ওষুধ ও জ্বালানি পর্যাপ্ত পরিমাণ নেই। অপারেটিং রুমে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে অর্থোপেডিকসের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ নেই।

এদিকে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর ‘সামরিক অভিযানে’ ১৯৬ ত্রাণকর্মী নিহত হওয়ার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে জাতিসংঘ। গত সোমবার গাজার দেইর আল বালাহতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক খাদ্য সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের (ডব্লিউসিকে) গাড়িতে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এতে ৭ ত্রাণকর্মী নিহত হন। তাদের মধ্যে একজন অস্ট্রেলিয়ার, তিন জন যুক্তরাজ্যের, একজন যুক্তরাষ্ট্রের, একজন পোল্যান্ডের ও একজন ফিলিস্তিনের নাগরিক। ইসরায়েল প্রথমে এ ঘটনার দায় সুকৌশলে এড়াতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপে দখলদার নেতানিয়াহু প্রশাসন দায় স্বীকার করতে বাধ্য হয় ও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়। এমনকি এ ঘটনায় দায়ী দুই সেনা কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করে ইসরায়েলি প্রশাসন।

শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ইসরায়েল তাদের ভুল স্বীকার করেছে। এটা ইতিবাচক হলেও ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধকৌশল ও পদ্ধতির কারণে গাজায় এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ১৯৬ জন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। আমরা প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। আমরা জানতে চাই, কেন ত্রাণকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া, গাজায় হামলার পাশাপাশি সেখানে ত্রাণ সরবরাহেও বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। ফলে অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় বসবাসরত ২২ লাখ ফিলিস্তিনি ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়েছে। খাবার-পানির অভাবে উপত্যকাটিতে মানুষের মৃত্যুও শুরু হয়েছে। এ ইস্যুতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, যখন সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তখন ক্ষুধার জ্বালা শুরু হয়। বর্তমানে গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ভয়াবহ ক্ষুধার মুখোমুখি। এমনকি, খাদ্য ও পানির অভাবে শিশুরা মারা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি সহ্য করার মতো নয় এবং চাইলেই এটি এড়ানো সম্ভব। এজন্য ইসরায়েলকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে।

গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল এখন সমাধিক্ষেত্র : ডব্লিউএইচও ইসরায়েলের হামলার পর গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল এখন একটি কঙ্কালসার কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়েছে, যার ভেতরে রয়েছে শুধুই মরদেহ এবং সমাধি, দাবি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। দুই সপ্তাহ অভিযান চালানোর পর গত সোমবার গাজার আল-শিফা হাসপাতাল থেকে সরে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েল দাবি করে, এই পুরো সময়টায় তারা হাসপাতালের ভেতর ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধ করেছে। এরপর শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দল ওই হাসপাতালের ভেতর ঢোকার অনুমতি পায়। তারা ২৫ মার্চ থেকেই আল-শিফায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল। হাসপাতালটির ভেতরে তারা অন্তত পাঁচটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে। পেয়েছে অনেকের সমাধি। গাজায় স্বাস্থ্যসেবার মেরুদণ্ড ছিল এই হাসপাতালটি। কিন্তু ইসরায়েলের হামলায় তার প্রতিটি ইঞ্চি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। হাসপাতালের মূল্যবান সরঞ্জাম হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নয়তো একেবারেই ধুলোয় মিশে গেছে। ভবিষ্যতে এই হাসপাতাল আবার ব্যবহারযোগ্য হবে কিনা তাও বলার উপায় নেই। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মাঝে মাত্র ১০টি আংশিক চলমান আছে বর্তমানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস বলেছেন, গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন, ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রোগ, হামলায় আহত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। গাজায় থাকা অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনার সুরক্ষা চান তিনি, এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মী এবং ত্রাণকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানান। গাজায় নির্বিঘ্নে ত্রাণ প্রবেশ এবং যুদ্ধবিরতির দাবি করেন তিনি।