➢ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ নগরজীবন
➢৪১.৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়ছে চুয়াডাঙ্গা, যশোর
দেশজুড়ে বইছে তাপপ্রবাহ। পাশাপাশি বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় গরমের তীব্রতা ভোগাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে রাস্তায় মানুষ কম থাকলেও গরমে বেশি অস্বস্তিতে ছিল খেটে খাওয়া মানুষ। রোদ্রের খরতাপে পুড়ছে দেশ। তাই, দেশজুড়ে তিনদিনের হিট এলার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রায় পুড়ছে চুয়াডাঙ্গা ও যশোর। ইতিমধ্যে এই দুই জেলার তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এরই মধ্যে রেড এলার্ট জারি করেছে। তারা খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করেছে।
একইসঙ্গে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিকের স্বাক্ষরিত আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, সারা দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এই তাপপ্রবাহ আগামী তিনদিন কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। এসময় জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়তে পারে।
রাজধানী ঢাকায় গতকাল শুক্রবার বেশ রোদের তাপ পরিলক্ষিত হয়। শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন থাকায় এদিন রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা দেখা যায়। লোকজন খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হননি। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ দেখা যায়। তবে, বিকালের পর রোদের তাপ কমলে অনেকেই দোকানপাট খুলেছেন। রাজধানীর লালবাগ এলাকার রিকশাচালক মাহমুদ জানান, সকাল সাতটা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত তিনি মাত্র তিনজন যাত্রী পেয়েছেন। বাকি সময় রিকশায় বসে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করেছেন। অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ে তিনি ৮-১০ জন যাত্রীর ভাড়া নিয়ে যেতে পারেন। তিনি বলেন, এত রোদের তাপ বেশি যে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। যদি রিকশা চালানোর কষ্ট না থাকত তাহলে আমিও ঘর থেকে বের হতাম না। উপায় নাই তাই বের হয়েছি।
দুপুরে রাজধানীর পল্টন মোড়ে কথা হয় বংশাল থেকে আসা সুন্দর আলী নামে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, সকাল থেকে গরম বেড়েই চলছে। এ প্রখর রোদে ভ্যান নিয়ে বাইরে থাকাটাই কষ্ট। আজ রাস্তায় মানুষ কম থাকলেও গরমের কমতি নেই। তীব্র তাপে ঘেমে জামা ভিজে আবার শুকাচ্ছে। এরপরও পেটের দায়ে বের হতে হয়।
জমিরুল নামে কাকরাইলের এক বাসিন্দা বলেন, এত গরমে যে বাতাস বইছে সেটাতেও গরম। আজ রাস্তায় যানজট নেই, তবুও লোকাল বাসে উঠে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। একটু বৃষ্টি না হলে আর স্বস্তি নেই। একই কথা বলেন রিকশাচালক রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, সকাল থেকে শরবত আর আইসক্রিম খেয়েই আছি। গরমে অন্য কোনো খাবার খেতে মন চায় না। আজ ছুটির দিন হওয়ায় যাত্রী কম, এরপরও পেটের দায়ে আমাদের তো রাস্তায় থাকতে হয়। রাজধানীর আইসিডিডিআর,বির কলেরা হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে। রোদের তাপমাত্রা না কমলে এই অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে। সেখানে কর্মরত চিকিৎসকেরা বলছেন, ডায়রিয়া মূলত পানিবাহিত রোগ। এর থেকে রক্ষা পেতে বিশুদ্ধ খাবার পানি পান বাধ্যতামূলক। দূষিত পানি, দূষিত খাবার এবং পরিবেশের কারণে মানুষ বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এজন্য সবসময় হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত-পা ধুতে হবে। ছোট শিশুদের শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হবে এবং অবশ্যই রোগীকে ডায়রিয়া হলে ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল ৬টায় ঢাকায় বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৮৭ শতাংশ। দেশের চার জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এছাড়া বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বইছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। গত বৃহস্পতিবারও ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে, তাপদাহ থেকে বাঁচতে চুয়াডাঙ্গা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করতে মাইকিং করছে প্রশাসন খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। শিশু ও বয়স্কদের বিশেষ যত্ন নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। আবহাওয়াবিদ তরিকুল নেওয়াজ কবির জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। টানা তিন দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে এ জেলায়।
গত তিনদিন থেকে চ্য়ুাডাঙ্গা ও যশোর অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রায় খুব বেশি পার্থক্য না থাকায় অতিষ্ঠ এ অঞ্চলের জনজীবন। প্রচণ্ড তাপদাহে এ অঞ্চলের হাসপাতালে বাড়ছে গরমজনিত রোগীর সংখ্যা। অসহনীয় গরমে বিপাকে পড়েছে খেটেখাওয়া নিম্নআয়ের মানুষ। প্রয়োজনের তাগিদে ঘর থেকে বেরিয়েও কাজ করতে পারছে না তারা। গত বছরের ১৯ ও ২০ এপ্রিল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অতি তীব্র দাবদাহ। কাছাকাছি সময়ে বৃষ্টি না হলে গত বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে যেতে পারে।
তাপপ্রবাহে পুড়ছে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম মুক্ত জেলা যশোর। যশোর বিমানবন্দর মতিউর রহমান ঘাঁটিস্থ আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল দুপুর পর্যন্ত যশোরের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার জানিয়েছেন, যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আজকের অবস্থাও সেদিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে আমরা দ্রুত কিছু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কতা বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতে যাচ্ছি। লোকজন যেন এই রোদে ঘর থেকে বের না হয়, প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে ইত্যাদি। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে এই জেলার জনগণের মধ্যে গরমজনিত ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা মাত্র পাঁচ। সেখানে ভর্তি আছে ২৫ রোগী। যার মধ্যে ১১ জনই শিশু রোগী।
তীব্র তাপদাহে পুড়ছে বরেন্দ্রভূমিখ্যাত রাজশাহী। দিনের তাপমাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। বৈশাখের পাঁচদিনে রাজশাহী তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। গতকাল বেলা ২টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় গত ১৭ এপ্রিল ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সিনিয়র পর্যবেক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যাওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ছে। যা আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকবে।
এদিকে সারা দেশে ঈদের দীর্ঘ ছুটি শেষে আগামীকাল রোববার বিদ্যালয় খোলার কথা রয়েছে। কিন্তু অভিভাবকদের মধ্য থেকে চলমান দাবদাহ নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দাবি করছেন অভিভাবকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটির আগেই গরমের ছুটির দাবি করেছেন কেউ কেউ। তবে, এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।





















