⦿নিওম শহর প্রকল্প বাঁচাতে চীনের দ্বারস্থ সৌদি
বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চাকাক্সক্ষী প্রকল্পের তকমা পেয়েছিল সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ট্রিলিয়ন ডলারের নিওম শহর। তেলনির্ভরতা থেকে সৌদি আরবকে বের করে আনতে আয়নায় ঘেরা অত্যাধুনিক এই মরু শহর নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু তার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। লোহিত সাগরের প্রবেশদ্বারে আকাবা উপসাগরের মুখ থেকে তাবুক প্রদেশে ১৭০ কিলোমিটার লম্বা শহর নির্মাণের পরিকল্পনা। ‘দ্য লাইন’ নামে এই রৈখিক শহর নিওম প্রকল্পের একটি অংশ। মাত্র ১৩ বর্গমাইল এলাকায় ৯০ লাখ মানুষের বসবাস হবে বলে ভাবনা ছিল। এর জন্য যত খরচ হবে, তা জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে রাজতন্ত্র। অর্থসংকটে প্রকল্পটির বিস্তার কমে আসছে বলে ব্লুমবার্গ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
এই প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল। প্রকল্প ঘোষণার শুরু থেকেই এটি ঘিরে নানা সংশয় ও সমালোচনার ঝড় ছিল। বিশেষ করে যেখানে এই শহরের অবস্থান, সেখানে হোয়াইয়াত উপজাতির আদিনিবাস ছিল। আদি পুরুষের জমিতে শহর নির্মাণের পরিকল্পনার প্রতিবাদ করায় ওই জাতিগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর প্রকল্প ঘিরে সংশয় তৈরি হয়। সাম্প্রতিক খবর হলো, সৌদি যুবরাজের ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রৈখিক শহর প্রকল্প ছোট হয়ে ১ শতাংশের কাছে নেমেছে। ৯৮ দশমিক ৬ শতাংশই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ মাত্র ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার নির্মাণ করা হবে, তাও ২০৩০ সাল নাগাদ সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এক ঠিকাদার শ্রমিকদের ছাঁটাই শুরু করেছে। যুবরাজের প্রকল্পটির রূপকল্পে বারবার পরিবর্তন, বাজেটের অতিরিক্ত ব্যয় এবং মূল কর্মীদের ক্রমাগত পরিবর্তনের খবর পাওয়া গেছে। যারা এই প্রকল্পে কাজ করেছেন, তাদের কেউ কেউ এটিকে ‘বাস্তবতাবিবর্জিত’ বলে বর্ণনা করেছেন।
প্রকল্পের প্রচারমূলক প্রদর্শনীতে ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির’ মতো দৃশ্য দেখানো হয়। কয়েকশ’ মিটার প্রশস্ত রৈখিক শহরটিকে নগর পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ হিসেবে প্রচার করা হয়। এই শহরে হাঁটার দূরত্বেই মিলবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আর বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম ট্রেনের মাধ্যমে এলাকাগুলো সংযুক্ত থাকবে। দ্য লাইনকে প্রায় রহস্যময় ভাষায় বর্ণনা করে বলা হয়েছে, একটি ‘জ্ঞানীয় শহর’ এবং ‘সভ্যতার বিপ্লব’, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সব সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করা হবে।
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত যুবরাজ মোহাম্মদ ‘আজকের শহুরে জীবনে মানবতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার’ উপায় হিসেবে নগর প্রকল্পটিকে বর্ণনা করেছেন। তবে তার এই চকচকে প্রস্তাব সবাইকে মুগ্ধ করতে পারেনি। ২০২১ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিওম শহরের চকচকে দেয়ালের মধ্যে বসবাসের সম্ভাবনা বর্ণনা করে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক রবার্ট ওয়ার্থ। তিনি বলেছিলেন, যুবরাজের প্রচারমূলক ভিডিওটি দেখার মানে হলো, ধর্মীয় বিজয় এবং রাজকীয় আড়ম্বরের মিশ্রণে তৈরি সৌদি দম্ভে ডুব দেওয়া।
এদিকে নিওম প্রকল্প নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে এবার এটির একটি ডিজিটাল প্রদর্শনী নিয়ে চীনে গেছে সৌদি আরব। গত সোমবার বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহেই নিওম প্রকল্পের কর্মকর্তারা চীনা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে দেশটির বেইজিং, সাংহাই এবং হংকং সফর করেছেন। তারা রহস্যময় ওই মেগাসিটির নানা সুবিধা ও সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করেছেন। এ ধরনের তৎপরতার পরও এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি ঘোষণা করা হয়নি। প্রদর্শনীর সময় নিওম শহরের কর্মকর্তারা এই শহর নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু নেতিবাচক প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা দেননি।
তবে প্রকল্পের প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া হংকং ইনোভেটিভ টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান লিওনার্ড চ্যান বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, প্রদর্শনীটি নিওমকে রহস্যের মোড়ক থেকে বের করে এনেছে। উচ্চাভিলাষী ওই প্রকল্প যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের বেশির ভাগই নিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। নিজে বিনিয়োগকারী হলেও ‘দ্য লাইন’ খ্যাত নিওম সিটি প্রকল্পে বিনিয়োগের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি চ্যান। প্রদর্শনীতে দেখানো নিওম শহর প্রকল্পকে তিনি অনেকটা ভিডিও গেমের সিমসিটির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
চলতি মাসের শুরুতেই ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্য লাইনে যে পরিমাণ মানুষের বসবাসের কথা ছিল সেই সংখ্যাটি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে সৌদি আরব। ২০৩০ সালের মধ্যে ওই শহরটিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে কমিয়ে ৩ লাখ লক্ষ্যমাত্রা দেখিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তবে নিওমের নির্বাহী পরিচালক তারেক কাদ্দুমি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে এই শহরে ৯০ লাখ মানুষের বসবাস নিশ্চিত করা হবে। সৌদি যুবরাজের ভিশন-২০৩০ প্রকল্পে ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিষয়ে ব্যাপক উদ্বেগ উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে, নিওম প্রকল্পে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। এ অবস্থায় দেশটি নিওম এবং অন্যান্য ভিশন-২০৩০ মেগাপ্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ঋণ নিতে শুরু করেছে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। গত সপ্তাহে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, অর্থ সংগ্রহের জন্য নিওম প্রকল্পটি প্রথমবারের মতো বন্ড ইস্যু করারও পরিকল্পনা করছে। নাম প্রকাশ না করা একটি সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, ওই বন্ডের মাধ্যমে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অর্থ সংগৃহীত হতে পারে।

























