➤ দেশে চিকিৎসার সুযোগ বাড়লেও খরচ বেশি
➤ জনপ্রতি ন্যূনতম খরচ ৮৫ হাজার, সর্বোচ্চ ২৫ লক্ষাধিক টাকা
➤ ভেজাল খাদ্যে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বছরে আক্রান্ত ২ লাখ
➤ সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যয় কমানো ও সেবার পরিধি বাড়ানোর তাগিদ
দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেন্টার না থাকায় সেবাপ্রত্যাশীরা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে যেমন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন, অপরদিকে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ক্যান্সার আক্রান্ত অনেক রোগী। দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে ৩০টি সেবা প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় অনেকটাই অপ্রতুল। তবে দেশে চিকিৎসার সুযোগ বাড়লেও খরচ অনেক বেশি। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের জনপ্রতি ন্যূনতম ব্যয় হচ্ছে ৮৫ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। তাদের চিকিৎসার ব্যয় করতে গিয়ে দিনের পর দিন নিঃস্ব হচ্ছে লাখো পরিবার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যাভাসে ও ভেজাল খাদ্যগ্রহণে প্রতিদিনই ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রোগীদের সেবা নিশ্চিতে ক্যান্সার কার্ড তৈরি করে সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যয় কমিয়ে সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। দেশের প্রতিটি ক্যান্সার ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ প্রদান ও চিকিৎসা সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে বর্তমানে ১৬ থেকে ১৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে ভুগছেন। প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ নতুন রোগী যুক্ত হচ্ছে। এজন্য দেশের ৮ বিভাগেই ক্যান্সার ইউনিট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গতকাল বুধবার রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে রোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেকেই চিকিৎসা নিতে ভিড় করছেন ঢাকা মেডিক্যাল, বিএসএমএমইউ ও মহাখালীর ক্যান্সার হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ও মেঝেতে বসে থাকা রোগীদের নানা কষ্টের চিত্র। অধিকাংশই এসেছেন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে। অনেকে থাকার জায়গা, চিকিৎসার খরচ মেটানো নিয়েই অজানা শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। নেত্রকোনা থেকে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা নিতে আসেন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী জোবেদা বেগম। তিনি জানান, দুই বছর আগে পেটে টিউমার ধরা পড়ে তার। এরপর জেলা সদর হাসপাতালে অপারেশনও করান। কিন্তু ভালো না হওয়ায় একপর্যায়ে ক্যান্সারে রূপ নেয়। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে কেমোথেরাপি দিতে তিনি এখানে এসেছেন।
বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় এই হাসপাতালে খরচ কিছুটা কম। কিন্তু প্রতি পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাকে। এ পর্যন্ত ৮টি কেমোথেরাপি দিয়েছেন। একবার কেমোথেরাপির খরচ হচ্ছে ২২ হাজার টাকা। ওষুধ, থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত খরচ কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা হয়। চিকিৎসা করাতে গিয়ে তার পুরো পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। একই কথা জানালেন নারায়ণগঞ্জের সালাউদ্দিনসহ আরো অনেকে। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নেওয়া এক রোগীর ছেলে জামাল জানান, তার দেশের বাড়ি শরীয়তপুরে। তার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লে ঢাকা মেডিক্যালের অনকোলজি বিভাগে এক অধ্যাপকের অধীনে ওয়ার্ডে ভর্তি করান। দিনের পর দিন ওষুধ কিনতে গিয়ে জমি-জমা বিক্রি করতে হয়েছে, গাউছিয়া মার্কেটের দোকানও ছেড়ে দিতে হয়েছে। শেষপর্যন্ত টানা দুই সপ্তাহ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধার-দেনা করে খরচের যোগান দিয়েও তার মাকে আর বাঁচাতে পারেননি। টাকাও খচর হলো মা’ও চলে গেলেন বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন হতদরিদ্র জামাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৬ থেকে ১৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে ভুগছেন। প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ৭৫ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। দেশের প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি সমন্বিত ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র দরকার। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন ১৮০টি সেন্টার। তবে বাস্তব চিত্র খুবই ভয়াবহ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে সরকারিভাবে ২২টি সেন্টার এবং বেসরকারিভাবে ১০টি সেন্টার ক্যান্সারের চিকিৎসা দিচ্ছে। নতুন করে হতে যাওয়া আটটি মেডিক্যাল কলেজে ক্যান্সার ইউনিট থাকছে। তবে, হিসাব বলছে, নতুন সেন্টার যুক্ত হলেও যে হারে রোগী বাড়ছে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এ খরচ সর্বনিম্ন ৮১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। ক্যান্সারের প্রথম স্তরে গড়ে চিকিৎসা খরচ ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকার কিছু বেশি। দ্বিতীয় স্তরে গড় খরচ প্রায় ৭ লাখ টাকা। ফলে, ক্যান্সারের চিকিৎসার খরচ যোগাতে নিঃস্ব হচ্ছে অনেক মানুষ।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জানান, একজন মানুষের শরীরে অনেক ধরনের ক্যান্সার হতে পারে। এর মধ্যে আছে সলিড ক্যান্সার, যেমন: ব্রেইন, লাং, ব্রেস্ট, পাকস্থলি, কোলন, লিভার, কিডনি, জরায়ু, ওভারি, প্রস্টেট ক্যান্সার ইত্যাদি। ব্লাড ক্যান্সারের মধ্যে লিউকোমিয়া, লিম্ফোমা, মাল্টিপল মায়েলোমা ইত্যাদি। ক্যান্সারের ব্যথা উপশমের সবচেয়ে ভালো ওষুধ মরফিন। দেশে ব্যথানাশক এ ওষুধ ক্রমান্বয়ে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। লাভ কম হওয়ায় ওষুধটি উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম। তারা বলছেন, দেশে ব্যথানাশক এ ওষুধ বছরে দরকার কমপক্ষে ৬০০ কিলোগ্রাম। পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৩ কিলোগ্রাম, যা প্রয়োজনের মাত্র ৪ শতাংশ। ফলে, মরফিনের অভাবেই বিপুল সংখ্যক রোগী যন্ত্রণা নিয়ে মারা যাচ্ছেন।
বিএসএমএমইউ’র অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লা বলেন, ভেজাল খাবার, খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, মদপান, পান, জর্দা, সুপারি এসবের কারণে অনেক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। খাওয়ার সমস্যার কারণে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের ক্যান্সার, কিডনির ক্যান্সার বেড়ে যাচ্ছে। কিছু ক্যান্সার জেনেটিক কারণে হয়। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অবশেষে মারা যাচ্ছেন। ক্যান্সারের ওষুধের ব্যয় অনেক বেশি। এখন আমাদের দেশের অনেকগুলো কোম্পানি ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করছে। তাই ব্যয় কিছুটা কমেছে। এসব ওষুধের কাঁচামাল দেশে তৈরি করা গেলে ওষুধের খরচ আরো কমবে।
প্রধান গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, মূল চিকিৎসার বাইরে অন্য যে খরচ রোগী ও তার স্বজনদের করতে হয়, তা অনেক বেশি। পরিস্থিতি বুঝে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হলে সবার আগে হাসপাতাল ও জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রোগী নিবন্ধন জরুরি, যা এখন পর্যন্ত দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে চেষ্টা করছে। এটিও সন্তোষজনক নয় বলে জানান বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক। তিনি বলেন, ক্যান্সারের বেশকিছু ওষুধ ফ্রান্স, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। সরকারকে এসব ওষুধের ওপর ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখার অনুরোধ করছি। তিনি বলেন, সমাজকল্যাণ ফান্ড থেকে যে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো, তা ১ লাখ টকায় উন্নীত করা হোক। অনেক রোগীকে বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে যাতায়াত করতে হয়। তাদের একটি ক্যান্সার কার্ড করে দিয়ে ৫০ শতাংশ যাতায়াত ভাড়া করে দেওয়া গেলে তারা ঢাকায় এসে চিকিৎসা নিতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকার ক্যান্সার চিকিৎসায় উন্নতি করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। দেশের ৮টি বিভাগে আলাদা করে ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান করে দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে রাজধানীমুখী রোগীদের সংখ্যা কমবে। বর্তমানে যারা জেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তারাও চিকিৎসার আওতায় আসবেন। তাদের অর্থ সাশ্রয় হবে।





















