⦿উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিদেশে যাচ্ছেন শিক্ষকরাও
⦿পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে বিদেশগামীদের ডকুমেন্ট সত্যায়নের চাপ বেড়েছে দ্বিগুণ
⦿দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমেছে বিদেশি শিক্ষার্থী
⦿ শিক্ষার সঙ্গে উপার্জন ও বসবাসের সুবিধা পেতেই বিদেশমুখি অনেকে
⦿দেশের চাকরি ক্ষেত্রেও বিদেশি ডিগ্রির মান বেশি দেখা হয়
⦿নিরাপদ জীবনের জন্য সন্তানদের শিক্ষার সুযোগে পরিবারও বিদেশমুখি হচ্ছে
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেও সামর্থ্যবান ও মেধাবী অনেকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবার মাস্টার্স করছেন। অনেকে আবার এমফিল-পিএইচডি ডিগ্রির জন্যও বিদেশে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত বিভিন্ন পরিমাণ স্কলারশিপ নিয়ে যেমন অনেকে বিদেশে যান, তেমনি নিজের টাকা খরচ করেও যাচ্ছেন কেউ কেউ। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও শিক্ষা ছুটি নিয়ে শিক্ষা বা গবেষণার নামে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ দেশে ফিরে এলেও অনেকে আবার প্রবাসেই স্থায়ী হচ্ছেন। প্রথমে নিজে গিয়ে পরে স্বজনদেরও বিদেশে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তাছাড়া সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ নিয়ে নিরাপদ জীবন যাপনের জন্য বিদেশকে বেছে নিচ্ছে অনেক বাবা-মা। আর বিদেশে শিক্ষার এ চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে স্টুডেন্ট ভিসা, কাউন্সেলিং, স্কলারশিপ, আইইএলটিএস, বিভিন্ন ভাষা কোর্সসহ নানা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও তৎপরতাও বাড়ছে। অথচ উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদেশিদের আগ্রহে। কারণ, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব কম হলেও তা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। এ অবস্থায় দেশের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি মেধাবীদের দেশে কাজে লাগানোর সুযোগ কমছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার এবং ওয়েলফেয়ার অনুবিভাগের পরিচালক (ওয়েলফেয়ার) লোকমান হোসেন গতকাল সবুজ বাংলাকে বলেন, বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের কাগজপত্র সত্যায়নের চাপ গত এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কোন দেশের জন্য কাগজপত্র সত্যায়ন করানো হচ্ছে তা বোঝা না গেলেও শিক্ষার জন্যই যে যাচ্ছে সেটা জানা গেছে। তবে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে শিক্ষার জন্য আগে যাওয়া সন্তানদের অভিভাবকরাও এখন তাদের কাছে যাচ্ছেন।
বিদেশগামী শিক্ষার্র্থীদের কাগজপত্র সত্যায়নের চাপ প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে প্রতিদিন চার থেকে ৫০০ টোকেন দেয়া হয়। প্রতিটা টোকেনের বিপরীতে ১৫/২০ পেজ কাগজপত্র থাকে। সে হিসেবে দিনে ১২ থেকে ১৪ হাজার পেজ কাগজ সত্যায়ন করা হয়ে থাকে। আগের চেয়ে এই সত্যায়নের চাপ অনেক বেশি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিদেশের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কারণ ও বাস্তবতা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষা গবেষক, মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী এবং রাজধানীর মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ সবুজ বাংলাকে বলেন, মূলত আমাদের দেশে শিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ নেই। শিক্ষা ও গবেষণার যে উদ্দেশ্য তার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে এখানে। যেমন গবেষণার জন্য যে ধরনের রিসোর্স, ফান্ড এবং রিসোর্স সেন্টার দরকার তা দেশে ঠিকমতো নেই। এজন্য মেধাবী ও চৌকস শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিদেশে যান।
অনেকে আবার পড়াশোনাকে মাধ্যম হিসেবে নিয়ে নিরাপদ, উন্নত ও শান্তিময় জীবন-যাপনের জন্য নাগরিকত্ব লাভ ও উপার্জনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমান বলে এই গবেষক জানান। কারণ, হিসেবে তিনি বলেন, দেশে অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা নেই ও সামাজিক অধিকার, অর্থনৈতিক সামঞ্জস্যতা নেই। শিক্ষা কারিকুলাম নিয়েও অসন্তোষ আছে। এজন্য সামর্থ্যবানরা তাদের সন্তানদের নিয়ে বাইরে যাচ্ছেন। এ দেশে বিদেশি কারিকুলামের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তা খুবই ব্যয়বহুল। সব জায়গায় এ ধরনের স্কুলও নেই। তাই সন্তানদের বিদেশে নিয়ে পড়ানোই লাভজনক মনে করছেন অনেকে। একই সঙ্গে নিজেরাও বিদেশে স্থায়ী হচ্ছেন।
দেশের চেয়ে বিদেশি ডিগ্রির মানও বেশি বলে দাবি করে ড. ওবায়দুল্লাহ আরও বলেন, আশার দিক হলো কিছু বিদেশি ডিগ্রিধারীরা দেশে এসে পরিবেশ পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। গবেষণা ক্ষেত্রে দেশে বড় বাধা হলো- বিদেশ থেকে গবেষকদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আনা হচ্ছে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ অনার্স-মাস্টার্স পাস করে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরাও যে বেতন পান, বিদেশ বা দেশ থেকে উচ্চ গবেষণা ডিগ্রি অর্জনকারীরাও একই বেতন পান। যা বিদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন। এজন্য অনেকেই দেশে আসতে চান না।
এদিকে দেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা যখন বিদেশে ছুটছেন, তখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থী আসার প্রবণতা হতাশাজনক। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিদেশি শিক্ষর্থীদের ১০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজার ৯৩৮ জন। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২৬ ও বেসরকারিতে ১৬১২ জন। ২০২১ সাল পর্যন্ত কিছুটা বেড়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ২৮১ জনে। এর মধ্যে পাবলিকে ৬৭৭ জন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬০৪ জন। তবে ২০২২ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৫৭ জনে। এর মধ্যে সরকারি বিশ^বিদ্যালয় ৬৭০ জন ও বেসরকারিতে ১২৮৭ জন।
























