◉দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বনভূমি
◉বর্ষা মৌসুমে ৮ কোটি ৩৩ লাখ গাছ লাগানোর টার্গেট
◉রাজধানীতে তাপপ্রবাহ কমাতে হবে ১৪৪ একর মাল্টিফরেস্ট
◉রাস্তা প্রশস্ত হলে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা থাকতে হবে : প্রধান বন সংরক্ষক
◉বন উজাড়ে জড়িতদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা
◉গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্টের নির্দেশনা
স্বাভাবিক নিয়মে একটি দেশের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। সেখানে বাংলাদেশে আছে নয় শতাংশ। এটিও বিভিন্ন উপায়ে গাছ কাটার মাধ্যমে বা আগুন লেগে ধ্বংস হচ্ছে। আর বন উজাড়ে অন্যতম অভিযুক্ত করা হচ্ছে বন কর্মকর্তাদেরই। এমন যখন পরিস্থিতি ঠিক সেই সময়ে সামাজিক বনায়নের দিকে জোর দিচ্ছে সরকার। এমনটিই বলছেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী।
বনের নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন প্রহরীদের প্রহরা জোরদার করা, বন রক্ষায় স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা, অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বন রক্ষা উদ্যোগ গ্রহণ এবং বনের কোনো কর্মকর্তা বন ধ্বংসে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিচ্ছে বন রক্ষার সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি, গতবছর সারা দেশে ৭ কোটি ৬০ লাখ গাছের চারা রোপণ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এ বছর তারা আগামী জুন মাসে অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে গাছের চারা রোপণের টার্গেট রেখেছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ।
স্মরণকালের ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে গত এপ্রিল মাস পার করেছে সারাদেশ। এমন ভয়াবহ তাপপ্রবাহে জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ। এই অবস্থায় প্রচণ্ড গরম ও তীব্র রোদ্দুর থেকে রক্ষা পেতে কি করণীয় এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে সুধীমহলে। এ অবস্থায় একটি কথাই বারবার উঠে এসেছে গাছ লাগানো ছাড়া এই গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। প্রতি বছরের মতো এবারও গাছ লাগানোর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বন অধিদপ্তর।
তীব্র তাপপ্রবাহ প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠানটি বৃক্ষ দিয়ে সাজাই দেশ, সমৃদ্ধ করি বাংলাদেশ – এই স্লোগানকে সামনে রেখে জুন মাসে বৃক্ষরোপণ করতে যাচ্ছে। বন অধিদপ্তর সামাজিক বনায়নের আওতায় ১৯৮১-১৯৮২ সাল থেকে ২০২২-২০২৩ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার ১৪৮.১৬ হেক্টর ব্লক এবং ৮০ হাজার ১৪১.৩৬ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান সৃজন করা হয়েছে। বাগানে ৭ লাখ ৬৭ হাজার ২৬৯ জন উপকারভোগী সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে নারী উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৩১ জন। এর মধ্যে বাগান কেটে ফেলা হয়েছে ৫৪ হাজার ৬৬৩.৫৬ হেক্টর ব্লক এবং ৬৪.৮৫ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান কাটা হয়েছে। যার বিক্রয় মূল্য ১ হাজার ৯৪৮ কোটি ৬০ লাখ ১২ হাজার ১৫৩ টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৯ জন উপকারভোগী এই অর্থ পেয়েছে যা ৪৭৮ কোটি ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৭৮৭ টাকা।
বন অধিদপ্তরের জেলাভিত্তিক বনায়নের জেলাগুলো হচ্ছে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম। বন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যত বনায়ন কার্যক্রম তা উপকূলীয় এলাকা এবং সুন্দরবন এলাকাকে ঘিরে নেয়া হয়েছে। খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় নেই কোন বনায়ন কার্যক্রম। বন অধিদপ্তরের তালিকাতেও নেই উত্তরাঞ্চলের কোনো বনের তথ্যতালিকা।
বন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বন সংরক্ষক ও প্রকল্প পরিচালক গোবিন্দ রায় দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, গাছ লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় পলিব্যাগ, গোবর, সার, সুথুলি এগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হয়। এই টেন্ডার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এখন গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে আমরা সারা দেশেই বৃক্ষরোপণ করে থাকি। তবে, এলাকাভেদে গাছের ধরণের পরিবর্তন হয়। এরমধ্যে উপকূলীয় এলাকায় কেওড়া, বাইন গাছের চারা লাগাই। ফলের গাছের মধ্যে লাগাই কাঁঠাল, আম, জলপাই, নারিকেল, জাম। সাতক্ষীরায় লাগানো হয় তাল। বরেন্দ্র অঞ্চলে শাল (গজারি), চিকরাশি, মেহগনি, আমলকি লাগানো হয়। সড়ক ও মহাসড়কের ধারে লাগানো হয়, শিলকড়ই, কালাকড়ই, মেহগনি, অর্জুন, দেবদারু, ঝাউ, চিকরাশি, তেলসুর, রকুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, নিম, লোহাকাঠ ইত্যাদি। পানি জমে থাকে এমন জায়গায় জারুল, কদম, হিজল, জাম, মান্দার ইত্যাদি।
সামাজিক বনায়ন সম্পর্কে এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা গাছ লাগানোর পর সেগুলো রক্ষণাবেক্ষনের জন্য পাহারাদার রাখি। সাধারণ মানুষেরা এই গাছের অংশীদার হয়। এই গাছগুলো কাটার পরে গাছের মূল্যের ৫০ ভাগ তারা পাবে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবছর বৃক্ষমেলা ও বৃক্ষরোপন কর্মসূচির উদ্বোধন করার সময় সবচেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া ১০ জনের হাতে এই চেক হ্যান্ডওভার করেন।
রাস্তার ধারের গাছ কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছোট রাস্তা বড় করার জন্য রাস্তার ধারের গাছকাটা প্রয়োজন। এ সময় আমাদেরকে সড়ক বিভাগ জানালে আমরা টেন্ডারের মাধ্যমে গাছ কেটে বিক্রি করে দিই। এতে উপকারভোগীরা থাকলে তাদের মধ্যে এই টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। ১ কিলোমিটারের মধ্যে কতজন উপকারভোগী থাকবে। সেটা স্থানীয় চেয়ারম্যান, উপজেলা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নামে তালিকা দেয়।
তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি হবে। লাগানো গাছটিতো ১৫ বছর পর কাটা হবে। তখন যে অফিসার গাছ লাগিয়েছেন তিনি বদলি হয়ে যাবেন। তাই, গাছ কাটার পরে তালিকার ভিত্তিতে সুবিধাভোগীদের কাছে তাদের অর্থ বণ্টন করা হবে।
রাজধানীর ঢাকার তাপপ্রবাহ কমাতে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক ২০৩০ সাল পর্যন্ত ধ্বংস না করতে নিষেধাজ্ঞা আছে। এর পাশাপাশি আমরা নতুন বনায়ন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি। রাজধানীর পূর্বাচলে ১৪৪ একরের একটি মাল্টি ফরেস্ট তৈরি হবে। এটি নিয়ে রাজউকের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আমরা কথা বলছি, তাদের সঙ্গে ফাঁকা জায়গায় নগর বনায়নের কার্যক্রম নেওয়া হবে। এই বন তৈরি হলে এই শহরের হিটওয়েভ কিছুটা কমবে। গাছগুলোতো কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করেই বেঁচে থাকে। গাছ যখন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করবে তখন অবশ্যই শহরের তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমবে।
নগরীর রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এগুলো সংস্কারের নামে প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হয় এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি গাছ কাটার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, মানুষের জীবনে কাঠের চাহিদা আছে। শিশু যখন ভূমিষ্ট হচ্ছে তখনও তার কাঠের প্রয়োজন হয়। বনজ দ্রব্য লাগে। জীবনের প্রতিটি স্তরে কাঠের প্রয়োজন হয়। এই যে প্রয়োজনীয় কাঠ এগুলো কোথা থেকে আসবে? বনায়ন এবং গাছ কাটার বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। রাস্তার প্রশস্ত করার জন্য গাছ কাটা হলো। এই রাস্তা প্রশস্ত হয়ে যাবার পরে আমরা যেন নতুন ভাবে আবার গাছ লাগাতে পারি। সেই পরিকল্পনা আমাদের থাকতে হবে। জন্ম নেবার সময় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের জীবনে কাঠের প্রয়োজন হয়।
এদিকে পরিবেশ রক্ষায় সারা দেশে গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে কেন একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। এতে বিবাদীদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়েছে, সারা দেশে গাছ কাটা বন্ধে (ব্যক্তি মালিকানাধীন গাছ ব্যতীত) ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, ঢাকা শহরসহ অন্যান্য জেলা এবং উপজেলা শহরে গাছ কাটা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০০৪ এর বিধানে গাছ লাগানোর চুক্তিভুক্ত পক্ষকে অর্থ প্রদানের বিধান সংযুক্ত করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে ৭ দিনের মধ্যে পরিবেশবাদী, পরিবেশ বিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপকের সমন্বয়ে একটি সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করার কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, গাছ কাটা বন্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৭ দিনের মধ্যে একটি সার্কুলার জারি করে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জেলা পরিবেশ অফিসার, সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, সমাজকর্মী, পরিবেশবাদী, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি বা সেক্রেটারি এবং সিভিল সার্জনের সমন্বয়ে কমিটি কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, গাছ কাটা বন্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৭ দিনের মধ্যে একটি সার্কুলার জারি করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে; কলেজের অধ্যক্ষ, সমাজকর্মী, পরিবেশবাদী, সমাজকল্যাণ অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং এলজিইডি এর নির্বাহী প্রকৌশলীর সমন্বয়ে কমিটি গঠনের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, কমিটি হওয়ার আগ পর্যন্ত বিবাদীদের নিজ নিজ এলাকায় যাতে কোনো গাছ কাটা না হয় সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট।
























