➣ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন অনেকে
➣ বিএনপির বহিষ্কৃত ৭ জনের জয়
➣ কৌশলে সফলতা দেখছে আ.লীগ
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ১ম ধাপ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। যদিও উপজেলা নির্বাচনে এটিই সবচেয়ে কম ভোটের রেকর্ড। তবে অধিকাংশ উপজেলায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে প্রার্থীদের মধ্যে। নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণ না থাকায় প্রায় উপজেলায় লড়াই হয়েছে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। ২৮ উপজেলায় দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়ী হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭ জন।
আওয়ামী লীগের ঘরের লড়াইয়ে এবার আলোচনায় রয়েছে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়া। ১ম ধাপে শেষ পর্যন্ত ১৩ উপজেলায় নির্বাচনে ছিলেন এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনরা। তাদের মধ্যে জয় পেয়েছেন ১০ জন। আর জাতীয় পার্টির একজন জয়লাভ করেছেন। বাকি জয়ীদের সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
জনগণ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। নির্বাচনে উপস্থিতি কম হলেও সন্তোষজনক মনে করছে আওয়ামী লীগ। মূলত নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে দলটি। কিছু উপজেলায় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে জয়লাভ করলেও তা হাতে গোনা কয়েকটি। এছাড়াও বিএনপিসহ সমমনাদলগুলোর ভোট বর্জনের মাঝেও ভোটার উপস্থিতি, প্রতিযোগিতামূলক ও সুষ্ঠু ভোট হওয়ায় সফলতা দেখছে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সদস্যরা।
যেসব মন্ত্রী-এমপির স্বজন জিতলেন : মাদারীপুর-২ আসনের এমপি শাহজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর সদর উপজেলায়, নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলায়, পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই এস এম নুরে আলম সিদ্দিকী নাজিরপুর উপজেলায়, বগুড়া-১ আসনের এমপি শাহদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল সারিয়াকান্দি উপজেলায় এবং ভাই মিনহাদুজ্জামান লিটন সোনাতলা উপজেলায়, খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার জামাতা বিশ্ব প্রদীপ কারবারী রামগড় উপজেলায়, কুষ্টিয়া সদর আসনের এমপি মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। আর ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি মাজহারুল ইসলাম সুজনের দুই চাচা ও এক চাচাতো ভাই বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়েন। তাদের মধ্যে জয়ী হন ছোট চাচা শফিকুল ইসলাম।
এর আগে হাতিয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নোয়াখালী-৬ আসনের এমপি মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী অমি ও মুন্সীগঞ্জ-৩-এর এমপি মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের চাচা আনিছ উজ্জামান আনিস বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
আর জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও পাবনা-১ আসনের এমপি শামসুল হক টুকুর ছোট ভাই আব্দুল বাতেন ও ভাতিজা আব্দুল কাদের দুজন একই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে হেরে গেছেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের এমপি ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুনার রশিদ হিরা ধনবাড়ী উপজেলায় নির্বাচনে হেরে গেছেন। নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার আশরাফ খানের শ্যালক শরীফুল হক পলাশ উপজেলায় হেরেছেন। মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সাহাব উদ্দিনের ভাগ্নে সোয়েব আহমেদ বড়লেখা উপজেলায় পরাজিত হয়েছেন।
বিএনপির বহিষ্কৃত ৭ জনের জয় : জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা ভোটেও বিএনপি অংশ নেয়নি। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন। যদিও তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রথম ধাপে বহিষ্কৃত বিএনপির ৭৩ নেতার মধ্যে চেয়ারম্যান পদে অংশ নেন ২৮ জন। তাদের ৭ জন চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তারা হলেন, বান্দরবান সদর উপজেলায় বিজয়ী হন আব্দুল কুদ্দুছ। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় আমিনুল ইসলাম বাদশা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায় আশরাফ হোসেন আলিম ও ভোলাহাট উপজেলায় আনোয়ার হোসেন। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় মোহাম্মদ আবদুল হামিদ। গাজীপুর সদর উপজেলায় জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান ইজাদুর রহমান মিলন। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সুহেল আহমদ চৌধুরী।
বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন অনেকে : গত বুধবার ১ম ধাপের ১৫০ উপজেলার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৩৯ উপজেলায়। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। চেয়ারম্যান ছাড়াও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৯ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ জন বিনাপ্রতীদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। ১ম ধাপের ধারাবাহিকতায় ২য় ধাপেও বিনাপ্রতীদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছেন অনেকে। দ্বিতীয় ধাপে ২১ জন একক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যাদের ৭ জন করে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। দ্বিতীয় ধাপে ১৬০ উপজেলায় ২১ মে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ ধাপে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল ৩০ এপ্রিল। দ্বিতীয় ধাপের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রতীক পেয়ে ইতোমধ্যে প্রচারে রয়েছেন। ২ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত প্রচারণা করতে পারবেন তারা।
কৌশলে সফলতা দেখছে আ.লীগ : আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সূত্র বলছে, মূলত জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা ভোটও অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। ফলে বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মুখেও নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। এছাড়াও ভোটার উপস্থিতির হারও ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়াও নির্বাচনের আগে সংঘাত-সহিংসতার পরিমাণও কমানো গেছে বলে মনে করছেন নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সদস্যরা। ফলে ভোটের দিন কিছু স্থানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। সারা দেশেই শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। ১ম ধাপে এমন ভোট পরবর্তী তিনধাপে ভোটার উপস্থিতি আরো বাড়াবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
নির্বাচনে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করায় অনেক স্থানে এমপি-মন্ত্রীদের নিকাটাত্মীয় নির্বাচনে অংশ নেন; যা দলের তৃণমূলে নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে। বেশ কিছু স্থানে এমপি-মন্ত্রীরা স্বজনদের পক্ষে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। আবার কোনো স্থানে এসব প্রার্থীরাও এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব খাটিয়ে অন্য প্রার্থীদের উপর চাপ তৈরি করছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে দলের পক্ষ থেকে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ১ম ধাপে কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী স্বজন নির্বাচন থেকে সরে আসলেও অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ১০ জন জয়লাভও করেছেন। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত না মানার শাস্তির বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে এখনও শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।
দলীয় সূত্র বলছে, নির্দেশনা দেওয়া হলেও মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন না সেটি মাথায় রেখেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তবে নির্দেশের সরাসরি প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। নির্দেশনার পর থেকে উপজেলা পর্যায় থেকে কেন্দ্রে মন্ত্রী-এমপি ও তাদের আত্মীয় প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ আসার সংখ্যা কমেছে। মন্ত্রী-এমপিরা যেমন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থেকে সরে এসেছেন, তাদের আত্মীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছেন। প্রশাসনও অনেকটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ফলে দলের পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তা উপেক্ষিত হলেও কৌশল সফল হয়েছে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারণী ফোরাম সদস্যরা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সবুজ বাংলাকে বলেন, নির্বাচনে আমাদের দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আমাদের স্বজনরা কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তারপরও কিছু জায়গায় অংশ নিয়েছে, কিছু জায়গায় তারা প্রার্থিতা তুলে নিয়েছে। সারা দেশে এত জায়গায় দু-একটা ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে সার্বিকভাবে ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. আফজাল হোসেন সবুজ বাংলাকে বলেন, আমি মনে করি, আমাদের দলের মূল বিষয় ছিল নির্বাচনে কোনো প্রভাব বিস্তার হবে না, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হবে, ভোটাররা খুশিমতো প্রার্থীকে বেছে দিবেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন কোনো অবনতি না হয় সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহয়তা দেওয়া হবে। ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা তেমন ঘটেনি। ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে। আরো বেশি ভোটার উপস্থিতি হতে পারতো। তবে বৈরী আবহাওয়া ও ধান কাটার মৌসুম হওয়ায় ভোট কিছু কম পড়েছে। আগামী যে তিন ধাপে ভোট হবে, ভোটার উপস্থিতি আরো বাড়বে বলে আমি মনে করি।
























