০৭:০২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিকদেরও একটা রাজনীতি আছে : মাহমুদা চৌধুরী

স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেসব নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদা চৌধুরী। তিনি চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় থেকে পেশাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তার জীবনের না বলা অনেক কথা। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে তার সাক্ষাতকার ছাপা হচ্ছে।

 

 

 

পর্ব – ২

এইচএসসিতে পড়ার সময় বিয়ে এবং সংসার, তবে মনে ঘাপটি মেরে ছিল সাংবাদিকতার আকাঙ্খা

দীর্ঘদিন আমার পড়াশোনায় গ্যাপ গেছে। আমার ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গেল। ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে হাজব্যান্ডের বাড়িতে আসলাম। এর আগে আসি নাই। আমার তখন কথাই ছিল যে, পরীক্ষার পরে আসব। আমাকে বলত যে, বিয়ে দেওয়া হয়েছে তোমাকে শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। তখন বাবা মায়ের সঙ্গে খুবই একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। আমি বলতাম যে, আমার বাবা ভিলেন বাবা। সিনেমার ভিলেন বাবা। আমার খুব কষ্ট হতো, তখন বৈষম্য ছিল। আমরা তিনটা বোন ছিলাম। দুইটা ভাই ছিল। আমার অন্য বোনগুলো আমার চেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছিল। কিন্তু সবাইকেই আমাদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্লাস সেভেন থেকেই শুরু হয় বিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। গ্রামের যে একটা বৈশিষ্ট্য বাল্যবিবাহ দেওয়া সেটা আমাদের পাড়ার প্রতিটি পরিবারেই ছিল। আমার অন্যান্য ফ্রেন্ডদের কিন্তু নাইনে বিয়ে হয়ে গেছে। আমি কিন্তু তখন একা পড়ে আছি। শুধুমাত্র আমার গায়ের রং কালো আর আমি দেখতে ভাল না। এইজন্য আমি পিছিয়ে আছি। আমার বিয়ের দিক থেকে অতটা বাজার নাই আরকি! এজন্য আমার মাকে কথা শুনতে হতো পাড়ার লোকদের কাছে। কি অমুকের মা, তোমার মেয়ের বিয়ে হয়না কেন? বিয়ে দিচ্ছ না কেন? পাড়ার সব বাড়ির সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। তুমি দিচ্ছ না কেন? সমস্যাটা কি যে, এইরকম নানান কথা বলা হতো। মার আবার একটাই কথা ছিল। মা বলত, আমি আমার এই মেয়ের বিয়ে দিব না এখন, কারণ আমার মেয়ে তো কালো। মেয়েকে পড়াব। পড়িয়ে তারপর বিয়ে দেব। পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শে সে চালিত কিন্তু সে মনে করত যে, আমার মেয়েটাতো কালো, তাকে একটু লেখাপড়া শেখাব। আর মেজ চাচা একটা কথা বলতেন যে, আমার এই কালো ভাইঝিকে আমরা বিয়ে দেব না। আমরা পড়াব। শিক্ষিত করব। সে চাকরি করবে। আমাদের বংশের মেয়েরা কেউ শিক্ষিত হয়ে চাকরি করত না। আমার দাদা কিন্তু দেখ, সেই ব্রিটিশ আমলে বান্দুরা মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন উইথ লেটার মার্কস পাস করেছে। ঢাকা কলেজ থেকে সে আইএসসি পাস করে কলকাতা মেডিকেলে পড়েছে। একবছর পড়ার পরে তার মা মারা গেলো। তার মা মারা গেলে তার বাবা আবার বিয়ে করল। তখন তার বাবা বলল যে, বাবা আমি এখন তোমাকে পড়ার খরচ দিতে পারব না। তুমি তাড়াতাড়ি শেষ করো। উনি দেখলেন যে শর্ট কোর্সে ভেটেরিনারিটা করা যাবে। উনি তাই করলেন। উনি আইএসসি পাস করে ভেটেরিনারি সার্জন হয়ে গেলেন। তারপর সরকারি চাকরি পেয়ে গেলেন। তাদের তিন পুরুষের পরে কিন্তু আমি শিক্ষিত হলাম। আমিই যেতে পারলাম স্কুলে। এই যেতে পারার পেছনে আমার মা এবং চাচার লড়াই ছিল দাদার সঙ্গে।

আমার দাদার বাধা। তোমরা কেন মেয়েকে স্কুলে দিচ্ছ? এটা ঠিক না। তারপরে আমার মা, চাচা তারা বলত। চাচা সরাসরি দাদার সঙ্গে কথা বলত না। রাগ ছিল আমার দাদার প্রতি। কারণ, আমার একটামাত্র ফুফু তাকে সে স্কুলে পড়ায়নি। তাকে স্কুলে যেতেই দেয়নি। বাসায় লোক রেখে পড়িয়েছে। একজন ইরানী মহিলাকে রেখে পড়াইসে। আদব কায়দা শিখাবে। এমব্রয়ডারি করানো এগুলো তাকে শিখিয়েছে। কিন্তু তাকে স্কুলে যেতে দেয়নি। আমার মেজ চাচার খুব রাগ ছিল এটা নিয়ে। যে, ও কেন স্কুলে যায়না?

আমার মেজ চাচা একদিন বলল কথায় কথায়, এই কিছুদিন আগেই, বলল যে, আমার না কষ্ট লাগত। আমার দাদাতো আসামে সেটেল ছিল। আসামে নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন। তো ওখানে আমার বাবা-চাচাদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল। সেখানে মেয়েদের একটা স্কুল ছিল। সেই স্কুলে ব্রতচারী নাচ শেখাত। আমার চাচা আফসোস করত, আহা আমার একটা মাত্র বোন সে তো আজ নাচটা শিখতে পারত। তখন তার মনের মধ্যে ক্ষোভ জেগে উঠে। কারণ দাদার সঙ্গে তো আমার চাচা কম কথা বলত। মাকে যেহেতু আমার দাদা খুব আদর করত, তাই তাকে বলত যে আপনি বলবেন মেয়েকে পড়তে দিতেই হবে। আমার হাইস্কুলে ভর্তি করার পেছনে এই মেজচাচাই ছিল। সেই আমাকে স্কুলে ভর্তি করেছে। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেছে। সব স্কুলে উনি নিজে নিয়ে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছেন।

আমার এই চাচা আমাকে খুব শেখাতেন। সমাজবিজ্ঞানটাও আমার উনার কাছ থেকেই জানা যে, মানুষের ধর্মীয় যে শিক্ষা, মানুষের জন্ম কিভাবে হলো,  কিভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হলো এগুলো তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। আমার চাচা ভাষাসৈনিক ছিলেন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। উনি সিএসপি ছিলেন। ঐরকম একটা পরিবেশে পারিবারিকভাবেই সবাই জ্ঞানচর্চা করছে। তার মধ্য থেকেই আমার ভিতরটাও জেগে ওঠে। কিন্তু বিয়ের পরে যখন পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়, আমি বিএ পাস করি খুব কষ্ট করে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হয়েই স্বামীর বাধা আসে। হয় সংসার নয়ত উচ্চ শিক্ষা। কোনটা চাও?

আমি জগন্নাথ থেকে বিয়ে পাস করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই কিন্তু পড়তে পারিনি। পরে যখন আবার ভর্তি হতে গেলাম, ভার্সিটিতে তখন সুযোগ পাইনি। আমার বোটানিতে এবং জুলোজিতে খুব ভাল মার্ক ছিল। আমি জুলোজিতে পড়লাম যেহেতু আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার সংসার দেখতে হচ্ছে।  আবার আমার লেখাপড়া করতে হচ্ছে তখন আমার কষ্ট হতো খুব। তখন লিখিত পরীক্ষা ছিলনা। মৌখিক পরীক্ষা ছিল। মার্কসের মধ্য দিয়ে আমরা চান্স পেতাম। তারপর একটা মৌখিক পরীক্ষা হতো। আমি যখন এলাউ হয়ে গেছি। তখন আমার হাজব্যান্ড একটা কথা বলল, দেখ তোমাকে বেছে নিতে হবে। তুমি যদি পড়তে চাও তাহলে তুমি সংসার করতে পারবেনা। যদি তুমি পড়তে চাও তাহলে তুমি আমার কাছে থাকতে পারবেনা। উনি অপশন দিয়ে দিচ্ছেন।

আর যদি সংসার করো তাহলে তুমি পড়তে পারবে না। এই কথা বলার পরে আমি মাকে ফোন দিলাম। তখন মা বলল কি, দ্যাখ সেক্রিফাইস করো। সংসারতো করতে হবে। বিয়ে হয়ে গেছে এখন তো স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসতে পারবিনা। এখন তো এটা করা ঠিক হবেনা। এখন তুই সংসার কর। তুই লেখাপড়া করবি না। যেটুকু লেখাপড়া আছে সেটা দিয়েই চলবে। আমার খুব কষ্ট লেগেছে। আমার বান্ধবীরা, যারা আমার চেয়ে খারাপ রেজাল্টের ছিল তারাও কিন্তু ডক্টরেট করে ফেলেছে। আমি সবকিছুতে বাধা পেয়েছি। বাইরে যাওয়া বাধা ছিল। বাপের বাড়িতে যাওয়া বাধা ছিল। অনেক কিছুতে এত বাধা!

আস্তে আস্তে ভিতরে ভিতরে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে গেলাম। এরপরে আমি আমার হাজব্যান্ডকে (উনি জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে পাস করা) তখন বললাম যে, বিকালে ক্লাস হয় আমি সেখানে ভর্তি হই। তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। দেশে তখন একটু রাজনৈতিক পরিস্থিতি উলট পালট। মেয়েদের সমস্যা হচ্ছিল যাতায়াতে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, স্বাধীন হওয়ার পরে তিন চার বছর অগোছালো অবস্থা ছিল। তারপরে সে বলল, ওখান থেকে পুরান ঢাকায় আসা যাওয়া তোমার জন্য কঠিন হবে। রেসকোর্সের সামনে দিয়ে আসতে হতো। তখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়নি। তখন বড় বড় গাছের আড়াল থেকে মেয়েদেরকে টেনে নিয়ে যেত। এইরকম ছিল আর কি! তখন আর বিকেলেও পড়তে পারলাম না।

পরীক্ষাও দিতে পারলাম না। আমি ভর্তি হতে পারলাম না। ৭৩ সনে আমার সমবয়সী এক চাচা সে আমাকে এসে বলল যে, আলমগীর কবীরের একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট আছে। তুমি তো ফিল্মে খুব আগ্রহী। তুমি এক কাজ করো। সপ্তাহে একদিন জাস্ট একটা ডিপ্লোমা। এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আন্ডারে। উনার বন্ধু এটা করেছে। ও ফার্স্ট হয়েছে। ওর কাছে শুনলাম। তখন অলরেডি তিন মাস হয়ে গেছে। আমি বললাম কাকা আমাকে নিয়ে যান না! তো, আমার কাকা বলল আমি কথা বলে আসি।

তখন প্রেসক্লাবের উল্টা দিকে ছিল বাংলাদেশ পরিষদ। ওটার দোতলায় তখন ক্লাস হতো। আর আমি তখন থাকতাম পাঁচবিবি ঘাট লেন। কলতাবাজারের ওখানে থাকতাম।

সেখান থেকে সপ্তাহে একদিন তো আমি হিসাব করে নিলাম। বাসা থেকে তো পড়তে যেতে দিবেনা। রোববার দিন আমার হাজব্যান্ডের ছুটি ছিল। মেয়েটা তখন ছোট, মেয়েকে আমি মায়ের কাছে রেখে আসতাম। ওখান থেকে আমি যাব ক্লাস করতে। তারপর আলমগীর ভাইয়ের ওখানে ভর্তি হলাম। ওখানে জার্নালিজমের একটা পার্ট ছিল ক্রিটিসিজমের উপর। আমি থার্ড ব্যাচে ছিলাম। এটা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। থার্ড ব্যাচে আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম। এর আগে কোন মেয়ে ভর্তি হয়নি। ঐ সময় উনি যে ক্রিটিসিজম লিখতে দিতেন! ওখান থেকে আমি খুব হাইয়েস্ট মার্ক পেতাম। হয়ত উনি আমাকে বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি থাকব। আমার লেখার হাতটা ভাল। উনি খুব কম কথা বলার মানুষ তো অতটা তখন আমি বুঝি নাই।

জনপ্রিয় সংবাদ

সপরিবারে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন তারেক রহমান

সাংবাদিকদেরও একটা রাজনীতি আছে : মাহমুদা চৌধুরী

আপডেট সময় : ০৫:৩৫:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেসব নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদা চৌধুরী। তিনি চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় থেকে পেশাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তার জীবনের না বলা অনেক কথা। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে তার সাক্ষাতকার ছাপা হচ্ছে।

 

 

 

পর্ব – ২

এইচএসসিতে পড়ার সময় বিয়ে এবং সংসার, তবে মনে ঘাপটি মেরে ছিল সাংবাদিকতার আকাঙ্খা

দীর্ঘদিন আমার পড়াশোনায় গ্যাপ গেছে। আমার ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গেল। ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে হাজব্যান্ডের বাড়িতে আসলাম। এর আগে আসি নাই। আমার তখন কথাই ছিল যে, পরীক্ষার পরে আসব। আমাকে বলত যে, বিয়ে দেওয়া হয়েছে তোমাকে শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। তখন বাবা মায়ের সঙ্গে খুবই একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। আমি বলতাম যে, আমার বাবা ভিলেন বাবা। সিনেমার ভিলেন বাবা। আমার খুব কষ্ট হতো, তখন বৈষম্য ছিল। আমরা তিনটা বোন ছিলাম। দুইটা ভাই ছিল। আমার অন্য বোনগুলো আমার চেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছিল। কিন্তু সবাইকেই আমাদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্লাস সেভেন থেকেই শুরু হয় বিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। গ্রামের যে একটা বৈশিষ্ট্য বাল্যবিবাহ দেওয়া সেটা আমাদের পাড়ার প্রতিটি পরিবারেই ছিল। আমার অন্যান্য ফ্রেন্ডদের কিন্তু নাইনে বিয়ে হয়ে গেছে। আমি কিন্তু তখন একা পড়ে আছি। শুধুমাত্র আমার গায়ের রং কালো আর আমি দেখতে ভাল না। এইজন্য আমি পিছিয়ে আছি। আমার বিয়ের দিক থেকে অতটা বাজার নাই আরকি! এজন্য আমার মাকে কথা শুনতে হতো পাড়ার লোকদের কাছে। কি অমুকের মা, তোমার মেয়ের বিয়ে হয়না কেন? বিয়ে দিচ্ছ না কেন? পাড়ার সব বাড়ির সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। তুমি দিচ্ছ না কেন? সমস্যাটা কি যে, এইরকম নানান কথা বলা হতো। মার আবার একটাই কথা ছিল। মা বলত, আমি আমার এই মেয়ের বিয়ে দিব না এখন, কারণ আমার মেয়ে তো কালো। মেয়েকে পড়াব। পড়িয়ে তারপর বিয়ে দেব। পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শে সে চালিত কিন্তু সে মনে করত যে, আমার মেয়েটাতো কালো, তাকে একটু লেখাপড়া শেখাব। আর মেজ চাচা একটা কথা বলতেন যে, আমার এই কালো ভাইঝিকে আমরা বিয়ে দেব না। আমরা পড়াব। শিক্ষিত করব। সে চাকরি করবে। আমাদের বংশের মেয়েরা কেউ শিক্ষিত হয়ে চাকরি করত না। আমার দাদা কিন্তু দেখ, সেই ব্রিটিশ আমলে বান্দুরা মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন উইথ লেটার মার্কস পাস করেছে। ঢাকা কলেজ থেকে সে আইএসসি পাস করে কলকাতা মেডিকেলে পড়েছে। একবছর পড়ার পরে তার মা মারা গেলো। তার মা মারা গেলে তার বাবা আবার বিয়ে করল। তখন তার বাবা বলল যে, বাবা আমি এখন তোমাকে পড়ার খরচ দিতে পারব না। তুমি তাড়াতাড়ি শেষ করো। উনি দেখলেন যে শর্ট কোর্সে ভেটেরিনারিটা করা যাবে। উনি তাই করলেন। উনি আইএসসি পাস করে ভেটেরিনারি সার্জন হয়ে গেলেন। তারপর সরকারি চাকরি পেয়ে গেলেন। তাদের তিন পুরুষের পরে কিন্তু আমি শিক্ষিত হলাম। আমিই যেতে পারলাম স্কুলে। এই যেতে পারার পেছনে আমার মা এবং চাচার লড়াই ছিল দাদার সঙ্গে।

আমার দাদার বাধা। তোমরা কেন মেয়েকে স্কুলে দিচ্ছ? এটা ঠিক না। তারপরে আমার মা, চাচা তারা বলত। চাচা সরাসরি দাদার সঙ্গে কথা বলত না। রাগ ছিল আমার দাদার প্রতি। কারণ, আমার একটামাত্র ফুফু তাকে সে স্কুলে পড়ায়নি। তাকে স্কুলে যেতেই দেয়নি। বাসায় লোক রেখে পড়িয়েছে। একজন ইরানী মহিলাকে রেখে পড়াইসে। আদব কায়দা শিখাবে। এমব্রয়ডারি করানো এগুলো তাকে শিখিয়েছে। কিন্তু তাকে স্কুলে যেতে দেয়নি। আমার মেজ চাচার খুব রাগ ছিল এটা নিয়ে। যে, ও কেন স্কুলে যায়না?

আমার মেজ চাচা একদিন বলল কথায় কথায়, এই কিছুদিন আগেই, বলল যে, আমার না কষ্ট লাগত। আমার দাদাতো আসামে সেটেল ছিল। আসামে নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন। তো ওখানে আমার বাবা-চাচাদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল। সেখানে মেয়েদের একটা স্কুল ছিল। সেই স্কুলে ব্রতচারী নাচ শেখাত। আমার চাচা আফসোস করত, আহা আমার একটা মাত্র বোন সে তো আজ নাচটা শিখতে পারত। তখন তার মনের মধ্যে ক্ষোভ জেগে উঠে। কারণ দাদার সঙ্গে তো আমার চাচা কম কথা বলত। মাকে যেহেতু আমার দাদা খুব আদর করত, তাই তাকে বলত যে আপনি বলবেন মেয়েকে পড়তে দিতেই হবে। আমার হাইস্কুলে ভর্তি করার পেছনে এই মেজচাচাই ছিল। সেই আমাকে স্কুলে ভর্তি করেছে। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেছে। সব স্কুলে উনি নিজে নিয়ে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছেন।

আমার এই চাচা আমাকে খুব শেখাতেন। সমাজবিজ্ঞানটাও আমার উনার কাছ থেকেই জানা যে, মানুষের ধর্মীয় যে শিক্ষা, মানুষের জন্ম কিভাবে হলো,  কিভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হলো এগুলো তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। আমার চাচা ভাষাসৈনিক ছিলেন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। উনি সিএসপি ছিলেন। ঐরকম একটা পরিবেশে পারিবারিকভাবেই সবাই জ্ঞানচর্চা করছে। তার মধ্য থেকেই আমার ভিতরটাও জেগে ওঠে। কিন্তু বিয়ের পরে যখন পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়, আমি বিএ পাস করি খুব কষ্ট করে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হয়েই স্বামীর বাধা আসে। হয় সংসার নয়ত উচ্চ শিক্ষা। কোনটা চাও?

আমি জগন্নাথ থেকে বিয়ে পাস করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই কিন্তু পড়তে পারিনি। পরে যখন আবার ভর্তি হতে গেলাম, ভার্সিটিতে তখন সুযোগ পাইনি। আমার বোটানিতে এবং জুলোজিতে খুব ভাল মার্ক ছিল। আমি জুলোজিতে পড়লাম যেহেতু আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার সংসার দেখতে হচ্ছে।  আবার আমার লেখাপড়া করতে হচ্ছে তখন আমার কষ্ট হতো খুব। তখন লিখিত পরীক্ষা ছিলনা। মৌখিক পরীক্ষা ছিল। মার্কসের মধ্য দিয়ে আমরা চান্স পেতাম। তারপর একটা মৌখিক পরীক্ষা হতো। আমি যখন এলাউ হয়ে গেছি। তখন আমার হাজব্যান্ড একটা কথা বলল, দেখ তোমাকে বেছে নিতে হবে। তুমি যদি পড়তে চাও তাহলে তুমি সংসার করতে পারবেনা। যদি তুমি পড়তে চাও তাহলে তুমি আমার কাছে থাকতে পারবেনা। উনি অপশন দিয়ে দিচ্ছেন।

আর যদি সংসার করো তাহলে তুমি পড়তে পারবে না। এই কথা বলার পরে আমি মাকে ফোন দিলাম। তখন মা বলল কি, দ্যাখ সেক্রিফাইস করো। সংসারতো করতে হবে। বিয়ে হয়ে গেছে এখন তো স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসতে পারবিনা। এখন তো এটা করা ঠিক হবেনা। এখন তুই সংসার কর। তুই লেখাপড়া করবি না। যেটুকু লেখাপড়া আছে সেটা দিয়েই চলবে। আমার খুব কষ্ট লেগেছে। আমার বান্ধবীরা, যারা আমার চেয়ে খারাপ রেজাল্টের ছিল তারাও কিন্তু ডক্টরেট করে ফেলেছে। আমি সবকিছুতে বাধা পেয়েছি। বাইরে যাওয়া বাধা ছিল। বাপের বাড়িতে যাওয়া বাধা ছিল। অনেক কিছুতে এত বাধা!

আস্তে আস্তে ভিতরে ভিতরে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে গেলাম। এরপরে আমি আমার হাজব্যান্ডকে (উনি জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে পাস করা) তখন বললাম যে, বিকালে ক্লাস হয় আমি সেখানে ভর্তি হই। তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। দেশে তখন একটু রাজনৈতিক পরিস্থিতি উলট পালট। মেয়েদের সমস্যা হচ্ছিল যাতায়াতে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, স্বাধীন হওয়ার পরে তিন চার বছর অগোছালো অবস্থা ছিল। তারপরে সে বলল, ওখান থেকে পুরান ঢাকায় আসা যাওয়া তোমার জন্য কঠিন হবে। রেসকোর্সের সামনে দিয়ে আসতে হতো। তখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়নি। তখন বড় বড় গাছের আড়াল থেকে মেয়েদেরকে টেনে নিয়ে যেত। এইরকম ছিল আর কি! তখন আর বিকেলেও পড়তে পারলাম না।

পরীক্ষাও দিতে পারলাম না। আমি ভর্তি হতে পারলাম না। ৭৩ সনে আমার সমবয়সী এক চাচা সে আমাকে এসে বলল যে, আলমগীর কবীরের একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট আছে। তুমি তো ফিল্মে খুব আগ্রহী। তুমি এক কাজ করো। সপ্তাহে একদিন জাস্ট একটা ডিপ্লোমা। এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আন্ডারে। উনার বন্ধু এটা করেছে। ও ফার্স্ট হয়েছে। ওর কাছে শুনলাম। তখন অলরেডি তিন মাস হয়ে গেছে। আমি বললাম কাকা আমাকে নিয়ে যান না! তো, আমার কাকা বলল আমি কথা বলে আসি।

তখন প্রেসক্লাবের উল্টা দিকে ছিল বাংলাদেশ পরিষদ। ওটার দোতলায় তখন ক্লাস হতো। আর আমি তখন থাকতাম পাঁচবিবি ঘাট লেন। কলতাবাজারের ওখানে থাকতাম।

সেখান থেকে সপ্তাহে একদিন তো আমি হিসাব করে নিলাম। বাসা থেকে তো পড়তে যেতে দিবেনা। রোববার দিন আমার হাজব্যান্ডের ছুটি ছিল। মেয়েটা তখন ছোট, মেয়েকে আমি মায়ের কাছে রেখে আসতাম। ওখান থেকে আমি যাব ক্লাস করতে। তারপর আলমগীর ভাইয়ের ওখানে ভর্তি হলাম। ওখানে জার্নালিজমের একটা পার্ট ছিল ক্রিটিসিজমের উপর। আমি থার্ড ব্যাচে ছিলাম। এটা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। থার্ড ব্যাচে আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম। এর আগে কোন মেয়ে ভর্তি হয়নি। ঐ সময় উনি যে ক্রিটিসিজম লিখতে দিতেন! ওখান থেকে আমি খুব হাইয়েস্ট মার্ক পেতাম। হয়ত উনি আমাকে বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি থাকব। আমার লেখার হাতটা ভাল। উনি খুব কম কথা বলার মানুষ তো অতটা তখন আমি বুঝি নাই।