❖অগ্নিসংযোগে অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা গৃহহীন
❖অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সীমান্ত ও নাফ নদীতে নিরাপত্তা জোরদার
❖থেমে নেই মর্টার শেলের বিস্ফোরণ
কয়েক সপ্তাহ লড়াইয়ের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিডং শহরটিও দখল করে নিয়েছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আরাকান আর্মির উদ্ধৃতি দিয়ে মিয়ানমারের নির্বাসিত সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতী গত রোববার বুচিডং শহর দখলের খবর প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং এএফপিও এমন খবর পরিবেশন করে। রয়টার্সের খবরে শহরটি দখলের সময় সেখানকার রোহিঙ্গা বসতিতে আরাকান আর্মির অগ্নিসংযোগের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। তবে আগুনের ঘটনায় নিজেদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আরাকান আর্মি।
এর আগে গত ১৮ মার্চ রাখাইন রাজ্যের আরেক শহর রাচিডং দখল করে নেয় আরাকান আর্মি। এখন মংডু শহরটি দখলে মরিয়া গোষ্ঠীটি। বাংলাদেশের টেকনাফের বিপরীতে (নাফ নদীর ওপারে) মংডু টাউনশিপের অবস্থান। মংডুর দক্ষিণে বুচিডং ও রাচিডং শহর হয়ে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ে (আকিয়াব) যেতে হয়। মাঝখানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় মংডুর সঙ্গে রাজধানী সিথুয়ের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সীমান্তের দুদিকেই চলাচল রয়েছে এমন কয়েকজন রোহিঙ্গা নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুচিডং দখলের আগে ও পরে সেখানকার কয়েকটি রোহিঙ্গাপল্লিতে অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনা ঘটে। গত তিন রাতের অগ্নিসংযোগে হাজারো বসতি পুড়ে ছাই হয়েছে। তাতে অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়ে। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফে পালিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা এখন নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তে জড়ো হয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সীমান্ত ও নাফ নদীতে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল তৎপরতা জোরদার এবং নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের কৌশলগত সামরিক কমান্ডের পতনের পর বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বুচিডং টাউনশিপের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে আরাকান আর্মি। বুচিডং টাউনের বাইরে সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীতে নিয়োগকারী রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষ অব্যাহত রেখেছে আরাকান আর্মি। এর আগে আরাকান আর্মি কর্তৃক বুচিডং টাউনের পাঁচটি লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ও বেশ কয়েকটি সীমান্তচৌকি দখল, বুচিডং টাউনশিপের মহাসড়কে নির্মিত একটি সেতু ধ্বংসের খবর প্রকাশ করে দ্য ইরাবতী।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাতে হঠাৎ সশস্ত্র গোষ্ঠীর কয়েক শ সদস্য বুচিডং টাউনের উত্তরের কয়েকটি গ্রামে ঢুকে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এ সময় ঘরের ধান-চাল, গরু ছাগল ও মূল্যবান সম্পদ লুট করা হয়। গত শনিবার ভোর পর্যন্ত কয়েক হাজার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়।
রাতভর শত শত ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তাতে অর্ধলক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। গত শনি ও রোববার রাতেও বুচিডং টাউনশিপের আশপাশের কয়েকটি রোহিঙ্গাপল্লিতে অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতা হয়েছে। তাতে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়ে। এ সময় আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারি বাহিনীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়।
রোহিঙ্গা বসতিতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল আরাকান আর্মির মুখপাত্র খিন থু কা রয়টার্সকে জানান, আগুনের জন্য জান্তা সরকার ও তাদের সমর্থক মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দায়ী। জান্তা বাহিনীর বিমান হামলায় বুচিডংয়ে আগুনের ঘটনা ঘটে।
বুচিডং শহর থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। গতকাল সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ফলকার টুর্ক সেখানকার চলমান সংঘাত অবিলম্বে বন্ধ করতে সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মিকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত মার্চ মাসে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সরকারি বাহিনীকে নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। নাগরিকত্ব প্রদান, চাকরিসহ নানা সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দিয়ে অন্তত দেড় হাজার রোহিঙ্গা তরুণ-যুবককে নিরাপত্তা বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। অস্ত্রধারী রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করছেন। তাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সে খবরও প্রকাশ পেয়েছে। মূলত সরকারি বাহিনীকে সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ করছে। রাখাইন রাজ্যে থাকা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে তারা আর নিরাপদ মনে করছে না।
গত রোববার সন্ধ্যা সাতটা থেকে গতকাল সকাল নয়টা পর্যন্ত মংডু শহরের পাশের চারটি গ্রাম সুধাপাড়া, মগনিপাড়া, নলবনিয়া ও ফাদংছাতে শতাধিক মর্টার শেল ও গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটেছে। টেকনাফ সীমান্তের অন্তত ১৩টি গ্রাম থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
টেকনাফ হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, মংডু টাউনশিপের মূল অংশ ছাড়া শহরটির চারপাশ আরাকান আর্মি ঘিরে রেখেছে। মংডু শহরটি দখলে নিতে পারলে রাখাইন রাজ্যে তিনটি শহর (মংডু, রাচিডং ও বুচিডং) এবং আশপাশের বিশাল এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন রাজধানী সিথুয়ে পরিস্থিতি নড়বড়ে হয়ে পড়বে। মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে টেকনাফ স্থলবন্দরে প্রভাব পড়ছে। তিন মাস ধরে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য শূন্যের কোটায় নেমে আসে।
রাখাইনের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। তবে এখন পর্যন্ত অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি।

























