◉ মারাত্মক হুমকির মুখে পরিবেশ
◉ বনসৃজনে উত্তরাঞ্চল পুরোপুরি অবহেলিত
◉ বাড়ছে তাপপ্রবাহ, নামছে পানির স্তর
দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় নেই কোনো বনভূমি। যেটুকু বৃক্ষরাজি আছে সেগুলোও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা হচ্ছে। আর এর প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়ছে ঐসব জেলাগুলোসহ সারা দেশে। ফলশ্রুতিতে দিনে দিনে ঐ সব জেলায় বাড়ছে তাপপ্রবাহ, নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। কমছে বৃষ্টি। এই অবস্থা প্রতিরোধে বন সৃষ্টির প্রতি জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে খরাপ্রবণ অঞ্চল হচ্ছে উত্তরবঙ্গ। সারাবছরে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অনেক কম। বনহীন এ অঞ্চলে নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে জলাভূমির পরিমাণ। নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। দেশের ১৬টি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত হলেও এই অঞ্চলে সবুজ বনভূমি নেই। আছে মাত্র ৫টি জাতীয় উদ্যান। নতুনভাবে কোনো বনসৃজনের উদ্যোগ বন বিভাগের পরিকল্পনায় নেই। আছে শুধু বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। অবিলম্বে এই অঞ্চলকে মরুভূমি হওয়া প্রতিরোধে ও খরাপ্রবণতা কমাতে বনসৃজনের উদ্যোগ গ্রহণ ও জলবায়ুবান্ধব কার্যক্রম নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা।
দেশের উত্তরাঞ্চল মোট ১৬টি নিয়ে গঠিত। জেলাগুলো রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাট।
বন অধিদপ্তরের জেলাভিত্তিক বনায়নের জেলাগুলো হচ্ছে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম। বন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যত বনায়ন কার্যক্রম তা উপকূলীয় এলাকা এবং সুন্দরবন এলাকাকে ঘিরে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী দেশের খরাপ্রবণ জেলা হচ্ছে ২২টি। এগুলোর মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৫৪ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। খরাপ্রবণ এসব এলাকা মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এর মধ্যে খরাপ্রবণ জেলা ১৩টি, খরা ও বন্যাপ্রবণ জেলা ছয়টি, খরা ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি জেলা। নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও এ ছয়টি জেলা খুবই উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। ‘সাসটেইনিং গ্রাউন্ড ওয়াটার ইরিগেশন ফর ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য নর্থইস্ট রিজিয়ন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির স্তর নামছে।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, নওগাঁর ধামুরহাট উপজেলায় আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। এর আয়তন ২৬৪.১২ হেক্টর। দিনাজপুরে ২৭.৭৫ হেক্টর আয়তনের রামসাগর জাতীয় উদ্যান, ৩০৫.৬৯ হেক্টর আয়তনের সিংড়া জাতীয় উদ্যান, ৫১৭.৬১ হেক্টর আয়তনের নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান ও ১৬৮.৫৬ হেক্টর আয়তনের বিরগঞ্জ জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। পাবনা জেলায় নগরবাড়ী মোহনগঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যার আয়তন ৪০৮.১১ ৩৬ হেক্টর, শিলন্দা-নাগডারমা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, আয়তন ২৪.১৭ ৩৭ হেক্টর, নাজিরগঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ১৪৬.০০ হেক্টর। দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক নূরুন্নাহার বলেন, আমাদের অধীনে ২৭ হাজার ২৭২ একর বনভূমি রয়েছে।
সামাজিক বন বিভাগ রাজশাহীর সহকারী বন সংরক্ষক মো. মেহেদীজ্জামান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমরা সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে ২৬৫ সিবলিং কিলোমিটারে গাছ লাগাব। ১০০০ চারা রোপণ করলে ১ কিলোমিটার হয়। প্রতিটি রাস্তা বা বাঁধের দুধারে ৫০০ করে ১০০০ চারা রোপণ করলে ১ সিবলিং কিলোমিটার হয়। এছাড়া আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ব্রজপাত নিরোধক হিসেবে ১ লাখ ৪৮ হাজার ২শ২৭টি তালগাছ রোপণ করা। জনসাধারণকে আমরা প্রতিবছরই বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ক্লাব, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও তৃণমূলে আমরা বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করি। এর পরিমাণ ২ লাখ ৫০ হাজার চারা।
সড়ক বিভাগ রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য গাছ কেটে ফেলে। এখনও এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেখানেই রাস্তা সম্প্রসারণ সেখানেই গাছ কাটা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মো. মেহেদীজ্জামান বলেন, সড়ক বিভাগ যেখানে রাস্তা সম্প্রসারণ করছে সেই প্রকল্পে তারা বনায়নের টাকা ধরে রাখছে। ওখানে পরবর্তীতে তারাই গাছ লাগায়।
ঝুঁকির মধ্যে থাকা অন্যতম জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পৌরসভায় প্রবেশ করলে দেখা যায়, দ্বারিয়াপুর থেকে বিশ^রোড মোড় হয়ে অক্ট্রয় মোড় পর্যন্ত পুরো রাস্তার ধারে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের গাছ লাগানো হয়নি। ১৯৯৪ সালে এই রাস্তার দুধারে পুরোনো বয়স্ক আমের গাছ থাকলেও সেগুলো রাস্তা সংস্করণের নামে কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকে এই রাস্তায় নতুন কোনো গাছ লাগানো হয়নি। রাস্তার ধারে গাছ নেই পৌরসভার বিশ^রোড মোড় থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু পর্যন্ত। কোনো গাছ নেই পৌরসভার হুজরাপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায়। এ প্রসঙ্গে সামাজিক বন বিভাগ রাজশাহীর সহকারী বন সংরক্ষক মো. মেহেদীজ্জামান বলেন, বনবিভাগ গাছের চারা বরাদ্দ দেয় কিন্তু পৌরসভার মধ্যে যে রাস্তা থাকে সেগুলোতে গাছ লাগানোর দায়িত্ব পৌরসভার। এ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ মো. ইমরান হোসাইন বলেন, আমরা গাছ লাগাব। কাউন্সিলরদের কাছ থেকে তালিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। হাইওয়ের পাশে গাছ লাগানোটা আমাদের এখতিয়ার বহির্ভূত। এই রোডটি ডাবল লেন করার প্রস্তাব দেওয়া আছে। এটা হওয়ার পর আমরা সেখানে গাছ লাগাব। তবে, এবারের বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চলবে। সমগ্র পৌরসভা এলাকায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর সঙ্গে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর সংযোগ সড়ক, ১ কিলোমিটার এটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। সেই রাস্তাটিসহ মোট ১৫টি ওয়ার্ডে সাড়ে সাত হাজার গাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা আছে।
পরিবেশবিদ ও তরুণ গবেষক ইসমত হাসনাইন বলেন, দেশে জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ এবং সম্পদের ঘাটতি বন শেষ করতে ভূমিকা রাখছে। দেশে যত বন আছে এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সুন্দরবন। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোতে সুন্দরবনও কমছে। সুন্দরবনে নদীর ভাঙন সবসময় একরকম হয় না। যার কারণে বন ধ্বংস হয়। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। যত সাইক্লোন হয় সুন্দরবনে চাপ তত বাড়ে। সে সাইক্লোনের চাপটা নেয় বলে, আমাদের দেশের ক্ষতি কম হয়। আমরা যদি পাহাড়ের দিকে দেখি সেখানেও আদিবাসীরা পাহাড়ে থাকে। সেখানে উন্নয়নের জন্যে পাহাড় কাটা হয়। জনসংখ্যার চাপই বন ধ্বংস হওয়া পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো. শহীদুল ইসলাম সরকার বলেন, এখানে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে গাছ লাগাই। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ারোধে আমাদের উপরের পানির উপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। আমাদের মহানন্দা নদী, জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে। নদীকে রক্ষা করে নদীর পানি ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টির পানিকে ব্যবহার করতে হবে।
রাজশাহীর জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. চিন্ময় দাস বলেন, শহরের এখন যে পরিস্থিতি তা অত্যন্ত ভয়াবহ। এই শহরে বন থাকবে কিভাবে? যেটুকু গাছপালা আছে সেগুলো সবই উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা হচ্ছে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে আমরা সারা দেশেই বৃক্ষরোপণ করে থাকি। সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক ২০৩০ সাল পর্যন্ত ধ্বংস না করতে নিষেধাজ্ঞা আছে। আমরা নতুন বনায়ন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি। রাজধানীর পূর্বাচলে ১৪৪ একরের একটি মাল্টি ফরেস্ট তৈরি হবে।
প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কৃষক দেলোয়ার জাহান বলেন, প্রজাপতি, পাখি, মৌমাছি, গাছ, বন্যপ্রাণী, পশু, সবকিছু মিলেই প্রকৃতি। এগুলো সবকিছুকে বাদ দিয়ে যে যার ইচ্ছেমতো গাছ লাগাচ্ছে। আমরা চাইলে ঢাকা শহরের মধ্যেই ৫/১০ ফুটের মধ্যেই বন গড়ে তুলতে পারি। বন থেকে খাবার আসবে, আবার বনের উপকারিতাও আসবে। এই নতুন ধারণাগুলো আমাদের সরকারিভাবে প্রমোট করা জরুরি। বন রক্ষা একা সরকারের ব্যাপার না, এটা সম্মিলিতভাবে সবার উদ্যোগ হতে হবে।
























