ফিলিস্তিনের গাজায় আট মাস ধরে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধে ৯ বছর বয়সের ইউনিস জুমার হাড় ও মাংস উভয়ই কমেছে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে হাসপাতালের শয্যায় চেতন-অবচেতনের মধ্যে সে শোয়ে আছে। তার দিকে তাকানো কঠিন! তার বাহু ও পা দুটি দেখতে ম্যাচের শলার মতো; তার হাঁটুর জোড়া যেন ফুলে উঠেছে; পাতলা চামড়ায় গোনা যাচ্ছে বুকের সবগুলো হাড়।
ইউনিসের মা ঘানিমা জুমা বলেন, ‘আমার ছেলের স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো ছিল; সে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অপুষ্টি আর পানি শূন্যতায় তার এখন এ অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনো বোতলজাত পানি নেই। শিশুরা অনেক দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করে। এ পানি আমাদের কাছে আসতে আসতেই দূষিত হয়ে যায়।’ নাসের হাসপাতালের বারান্দার কাছাকাছি একটি শয্যায় শুয়ে আছে পাঁচ বছরের তালা ইব্রাহিম মুহাম্মদ আল জালাত। সে হয়তো জেগে আছে। কিন্তু শরীরে শক্তি না থাকায় নড়াচড়ার কোনো সামর্থ্য নেই। তার কাতর চোখ দুটি উল্টানো। ছোট্ট তালাও চরমভাবে পুষ্টিহীনতা ও পানিশূন্যতায় ভুগছে।
পাশেই তার হাত ধরে বসে আছেন বাবা আব্রাহিম মুহাম্মদ আল-জালাত। তিনি জানান, গাজার বিরূপ আবহাওয়া, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও বিশুদ্ধ পানির অভাব কীভাবে তার মেয়েকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। অসহায় কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। আমাদের তাঁবুর তাপমাত্রা কল্পনার বাইরে এবং আমরা যে পানি পান করছি, সেটাও নিশ্চিতভাবে দূষিত। এতে তরুণ-বৃদ্ধ সবাই অসুস্থ হচ্ছেন।’ যুদ্ধে গাজায় ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে; লাখ লাখ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন স্থানে তাঁবুতে অবস্থান করছেন। এসব তাঁবুতে সূর্যের ঝাঁঝালো তেজ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশুদ্ধ হোক বা দূষিত পানি পাওয়াটা সেখানে নিত্যদিনের সংঘাত। যেসব স্থানে পানি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে দেখা যায় দীর্ঘ সারি।
বোমা হামলার কারণে গাজার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; অবশিষ্ট আছে অল্প কিছু টয়লেট। আল নাসের হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ড. আহমেদ আল-ফারি বলেন, এটা এখন কোনো গোপন কিছু নয় যে, দূষিত পানির কারণে গাজায় শিশুদের সবচেয়ে বেশি অন্ত্রের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রথম সমস্যা হলোÑ বমি ও ডায়রিয়া দিয়ে এ সমস্যা আত্মপ্রকাশ করে। এতে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। দ্বিতীয় সমস্যা- শিশুরা হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘সি’তে আক্রান্ত হচ্ছে। এগুলো অন্ত্রের সমস্যার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স বলছে, গাজার পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার ৬৭ শতাংশ এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। খান ইউনিস মিউনিসিপ্যালিটির পানিবিষয়ক প্রকৌশলী সালাম শরাব বলেন, পানি ও পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জোরালো আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। খান ইউনিসে ১৭০ থেকে ২০০ কিলোমিটার এলাকায় পানির পাইপ নষ্ট হয়ে গেছে; কূপ ও পানির ট্যাঙ্কি সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা প্রতিদিন প্রায় ২০০টি মানবিক সহায়তা বহনকারী ট্রাক কেরেম শালোম ক্রসিং দিয়ে গাজা উপত্যকায় প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। কিন্তু ত্রাণ সংস্থাগুলো তা বিতরণ করছে না।
ত্রাণ সংস্থাগুলোর যুক্তি, দক্ষিণ গাজার রাফার আশপাশের এলাকায় ক্রমাগত যুদ্ধ চলছে। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে কাজ করা খুবই বিপজ্জনক। তারা বলছেন, যেটুকু সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় তা সমুদ্রের একটি ফোঁটার সমতুল্য।


























