০৮:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘মাসোহারায়’ চলছে অবৈধ ক্লিনিক,  রোগীর মৃত্যুতে নেয়া হয়না ব্যবস্থা

যশোরের অবৈধ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেখেও দেখে না স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। অবৈধ প্রতিষ্ঠানে ভুল অস্ত্রোপচার ও অপচিকিৎসায় প্রায় ঘটছে রোগী মৃত্যুর ঘটনা। এতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়িত্ব শেষ করেন কর্মকর্তারা। কোন প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই। আবার অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ নিরব থাকে। অভিযোগ উঠেছে, সিভিল সার্জন কার্যালয়ে প্রতি মাসে মাসোহারা দিয়ে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্বচ্ছন্দে চলছে। ফলে মালিকেরা নিজস্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-সেবিকা, প্যাথলজিস্ট, ল্যাব টেকনিশিয়ান না থাকাসহ সরকারি কোন মানছেন না।
সিভিল সার্জন অফিসের সূত্রমতে, যশোর জেলায় মোট ৩৫৯ টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে ক্লিনিক ১৭০ টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৮৯ টি। তবে খাতা কলমের বাইরে জেলায় আরও শতাধিক  ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। সেগুলোর তালিকার তৈরির কাজ চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সিভিল সার্জন অফিস অবৈধ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে অভিযান পরিচালনা করছে না। কিন্তু বিগত দিনে কর্তৃপক্ষ অবৈধ একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করে । বন্ধ ঘোষণা করা অবৈধ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো যশোর শহরের মুজিব সড়কে অবস্থিত পিস হসপিটাল ছাড়াও তার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোটারি হেলথ সেন্টারের প্যাথলজি ল্যাব, ঘোপ জেল রোডের এমসি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেন্ট্রাল হসপিটালের প্যাথলজি ল্যাব ও ভোলা ট্যাংক রোডের নুরুল ইসলাম ডায়াবেটিক সেন্টার, মণিরামপুর উপজেলার মডার্ন ক্লিনিক, রাজগঞ্জ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কপোতাক্ষ ক্লিনিক ,পারবাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বেনাপোল পৌর শহরে অবস্থিত বেনাপোল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্টার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ঝিকরগাছা উপজেলার ফেমাস মেডিকেল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ছুটিপুর প্রাইভেট ক্লিনিক, আয়েশা মেমোরিয়াল মেডিকেল সেন্টার, মোহাম্মদ আলী ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সীমান্ত ডায়াগনস্টিক এন্ড ডায়াবেটিস কেয়ার, ছুটিপুর প্রাইভেট ক্লিনিক, সালেহা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও আনিকা ক্লিনিক, বাঘারপাড়া উপজেলার হাজি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নিম্মমানের এসব প্রতিষ্ঠানে নানা অনিয়ম ও  ত্রুটির মধ্যে রোগীর অস্ত্রোপচার, চিকিৎসা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হতো। অথচ মানসম্মত যন্ত্রপাতি বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট ছিলো না কারো। এছাড়া ভাড়াটিয়া চিকিৎসক ডেকে অপারেশন করানো হতো। অপারেশনের পর আর কোন খোঁজ না থাকার অভিযোগে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ ঘোষণা করা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নিয়মনীতি না মেনেই চাল করা হয়েছে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট ২৮৭ টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে নতুন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স গ্রহণ ও পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘোষণা অনুযায়ী সময়সীমা বেধে দেয়া হয়। এরমধ্যে ২৩৪ টি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। বাকি ৫৩ প্রতিষ্ঠান মালিক সরকারি আদেশ প্রথম অবস্থায় মানেননি। যে কারণে প্রতিষ্ঠান মালিকদের কারণ দর্শনো নোটিশ জারি করা হয়। এরমধ্যে ৩৬ টি প্রতিষ্ঠানের মালিক নোটিশের জবাব ছিলো অসন্তোষজনক। পরবর্তীতে সূর্যের হাসি ক্লিনিকছাড়া সব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে অনলাইনে আবেদন পাঠায়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে পক্ষে বিপক্ষে কর্তৃপক্ষের কাছে মতামত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সিভিল সার্জন অফিস আরও জানিয়েছে, মতামত প্রতিবেদনে জেলার ৮৯ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স পাওয়ার অযোগ্য বলে জানানো হয়। ওই সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সেবিকা ও প্যাথলজিস্ট নেই। এছাড়া নিম্নমানের অস্ত্রোপচার কক্ষ, প্যাথলজি বিভাগ নোংরা পরিবেশছাড়াও মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়।  ফলে ৮৯  হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স পাওয়ার অযোগ্য বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহিন। এসব নামমাত্র প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে হালনাগাদ লাইসেন্স ছাড়াই চলছে বেসরকারি হসপিটাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখানে চিকিৎসাসেবায় নানা ধরণের অনিয়ম হলেও দেখার কেউ নেই। আবার নতুন করে গড়ে ওঠা একাধিক ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ফ্রি-স্টাইলে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। মালিকপক্ষ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই কার্যক্রম শুরু করলেও স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

চৌগাছা উপজেলা শহরে গড়ে ওঠা
 সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ গত সেপ্টেম্বর মাসে সিভিল সার্জন অফিসে আবেদন করে। আবেদনে ডিপ্লোমা পাস করা প্যাথলজিস্ট হিসেবে তানভীর রহমান মিঠুর নাম দেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, তানভীর রহমান মিঠু সততা ডায়াগনস্টিকে কাজ করেন না। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদনে তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার আগেই সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অবৈধভাবে চিকিৎসা ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সকল কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (প্যাথলজিস্ট), একজন রিপোর্ট প্রদানকারী, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানা হয়নি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হিসাব কর্মকর্তা ইমরান হোসেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সেজে সব গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন (রিপোর্ট) দিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হলেও সিভিল সার্জন এখনো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকপক্ষের কাছ থেকে মোট অংকের মাসোহারা নিয়ে অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। একই ভাবে চলছে যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডে অবস্থিত প্রিন্স ডায়াগনস্টিক সেন্টার । লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চালু করা হয় কার্যক্রম। লাইসেন্স না মিললেও ১ বছরের বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে চালু রয়েছে।
এছাড়া বিগত দিনে বন্ধ ঘোষণা করা একাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমতি ছাড়া কিভাবে কার্যক্রম শুরু করা হলো তা নিয়েও নানা সমালোচনা রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সিভিল সার্জন অফিসের জড়িত একজন কর্মচারীর সাথে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকরা সম্পর্ক রেখে অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে  দুই জন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক জানান, তাদের সিভিল সার্জনের অফিসে প্রতি মাসে মাসোহারা দিতে হয়। সেখানকার একজন কর্মচারির মাধ্যমে মাসোহারা পৌঁছে দেন। তবে মাসোহারা আদায় করা কর্মচারির নাম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে, লাইসেন্স হালনাগাদ করতে সিভিল সার্জন অফিসে ৫০ হাজার টাকা ও নতুন ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স পেতে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। অন্যথায় লাাইসেন্স পাওয়ার উপযোগী হিসেবে ‘ডান’ করা হয়না। ঘুষ বাণিজ্যের জন্য সিভিল সার্জন অফিসে নির্দিষ্ট একজন কর্মকর্তা রয়েছে।
সূত্র জানায়, মাসোহারার বিনিময়ে লাইসেন্স ছাড়া মালিকপক্ষ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কার্যক্রম শুরুর সাহস পেয়ে থকে। অনুমতি ছাড়া প্রকাশ্যে কার্যক্রম চলার বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিকভাবে তদারকি ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকায় বৈধ অবৈধ বেসরকারি হসপিটাল ও ক্লিনিকে দায়সারা চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে যশোর জেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে ভুল অস্ত্রোপচার ও অপচিকিৎসায় অসংখ্য রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গত ৩১ জুলাই শহরের পঙ্গু সেবা কেন্দ্রে ডা. নজরুল ইসলামের ত্রুটিপূর্ণ অপারেশনে রসুল ওরফে রাসেল ( ৩৬) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। অপারেশনের আগে ডা. নজরুল নিজেই রোগীর অ্যানেস্থেসিয়া দেন। রাসেল যশোর সদর উপজেলার হাশিমপুর গ্রামের তরফদার পাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে। এই ঘটনায় মৃতের স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে হট্টগোল করেন। পরে সিভিল সার্জনের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।  গত ৩০ জুন অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ার ফাতেমা প্রাইভেট হসপিটালে মুনজুরুল মুরশিদের ভুল সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারে মারা যান চুয়াডাঙ্গার দর্শনা উপজেলার রাজের স্ত্রী ও অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের আরশাফ শেখের মেয়ে ইতি বেগম (২২)। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ জুন নওয়াপাড়ার আরোগ্য সদন প্রাইভেট ক্লিনিকে ভুল অস্ত্রোপচারে আরেক প্রসূতি অর্চনার (২৫) মৃত্যু হয়। ডা. মিলন কান্তি বোস তার সিজার করেছিলেন। অর্চনার মৃত্যুতেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
যশোর সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের আব্দুল হাকিমের স্ত্রী কাজলকে  ২৪ জুন রাত ১০ টার দিকে যশোর শহরের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডের সিটি হসপিটালে সিজার করা হয়। অস্ত্রোপচার করেন ডাক্তার ফারজানা পারভীন। অজ্ঞানের চিকিৎসক ছিলেন ডা. আহসান কবির বাপ্পি। সিজারের পর রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জুন ভোরে প্রসূতি কাজল মারা যান। এ ঘটনায় তার স্বজনেরা ক্ষুব্ধ হয়ে হসপিটালের সামনে বিক্ষোভ করেন। ২৬ জুন বুধবার সিভিল সার্জনের নির্দেশে বুধবার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। ২৪ জুন  সদর উপজেলার রুপদিয়ার গ্রামীণ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে  সিজারের পর মারা যান নরেন্দ্রপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রিমা। এ ঘটনায় প্রসূতির স্বজন ও এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ক্লিনিকটি ভাংচুর করেছে। পালিয়ে রক্ষা পান এমবিবিএস ডা. নুরছালী ও তার স্বামী ক্লিনিক মালিক জামাল হোসেন। পরে সিভিল সার্জনের নির্দেশে ক্লিনিকটিকে সিলগালা ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কাজল ও রিমা ছাড়াও  নামমাত্র বিভিন্ন ক্লিনিক ও হসপিটালে ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা অবহেলায় মারা গেছেন যশোর সদর উপজেলার মুনসেফপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুস সাত্তারের মেয়ে রুনা বেগম (২৬), মুড়লি মোড়ের জোড়া মন্দির এলাকার বিপ্লব হোসেনের ছেলে ইরহাম (৪১ দিন), চাঁচড়া মধ্যপাড়ার রবিউল ইসলামের মেয়ে মীম খাতুন (১২),  চাঁচড়া মধ্যপাড়ার রবিউল ইসলামের মেয়ে মীম খাতুন (১২), ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা ইউনিয়নের বামন আলী চাপাতলা গ্রামের ড্রাইভার গোলাম রসুলের স্ত্রী আসমা বেগম (৩২) ও মণিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের এনায়েতপুর  আব্দুস সাত্তার মিস্ত্রির ছেলে আব্দুল মান্নান (৪০)। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায় সিভিল সার্জন অফিস তদন্ত কমিটি গঠন করে। অথচ একটি ঘটনায় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি। অজ্ঞাত কারণে তদন্ত প্রতিবেদন ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
জানা গেছে, যশোর শহরে সরকারের নির্দেশনা না মেনে নিজেদের ইচ্ছামতো হসপিটাল ও ক্লিনিক  গড়ে বহাল তবিয়তে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। না বুঝে মানুষ সেখানে চিকিৎসার জন্য গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।  একাধিক নামমাত্র বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাসেবায় ঝুঁকির আশংকা রয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার জন্য এসে মাশুল গুনতে হচ্ছে রোগী স্বজনদের। চিকিৎসাসেবা নামে প্রতারণা করা যেনো মালিক পক্ষের লক্ষ্য। দালাল নির্ভর অধিকাংশ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান মালিকদের উদ্দেশ্য যেনতেন চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো। অথচ মানসম্মত অপারেশন থিয়েটার (ওটি) রোগ নির্ণয়ের জন্য উন্নতমানের কোন যন্ত্রপাতি নেই। আবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হলেও মুহুর্তে ফের কার্যক্রম চালু হয়ে যায়।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা.মাহমুদুল হাসান জানান, বেসরকারি হসপিটাল ক্লিনিক মালিকদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ তিনি শুনেছেন। দায়িত্বরতদের তিনি  অর্থবাণিজ্য বন্ধ করার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। এরপরও কেউ বাণিজ্যের
সাথে জড়িত প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানান, চৌগাছার সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রোগী মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জনপ্রিয় সংবাদ

‘মাসোহারায়’ চলছে অবৈধ ক্লিনিক,  রোগীর মৃত্যুতে নেয়া হয়না ব্যবস্থা

আপডেট সময় : ০৪:৪৬:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
যশোরের অবৈধ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেখেও দেখে না স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। অবৈধ প্রতিষ্ঠানে ভুল অস্ত্রোপচার ও অপচিকিৎসায় প্রায় ঘটছে রোগী মৃত্যুর ঘটনা। এতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়িত্ব শেষ করেন কর্মকর্তারা। কোন প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই। আবার অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ নিরব থাকে। অভিযোগ উঠেছে, সিভিল সার্জন কার্যালয়ে প্রতি মাসে মাসোহারা দিয়ে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্বচ্ছন্দে চলছে। ফলে মালিকেরা নিজস্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-সেবিকা, প্যাথলজিস্ট, ল্যাব টেকনিশিয়ান না থাকাসহ সরকারি কোন মানছেন না।
সিভিল সার্জন অফিসের সূত্রমতে, যশোর জেলায় মোট ৩৫৯ টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে ক্লিনিক ১৭০ টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৮৯ টি। তবে খাতা কলমের বাইরে জেলায় আরও শতাধিক  ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। সেগুলোর তালিকার তৈরির কাজ চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সিভিল সার্জন অফিস অবৈধ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে অভিযান পরিচালনা করছে না। কিন্তু বিগত দিনে কর্তৃপক্ষ অবৈধ একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করে । বন্ধ ঘোষণা করা অবৈধ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো যশোর শহরের মুজিব সড়কে অবস্থিত পিস হসপিটাল ছাড়াও তার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোটারি হেলথ সেন্টারের প্যাথলজি ল্যাব, ঘোপ জেল রোডের এমসি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেন্ট্রাল হসপিটালের প্যাথলজি ল্যাব ও ভোলা ট্যাংক রোডের নুরুল ইসলাম ডায়াবেটিক সেন্টার, মণিরামপুর উপজেলার মডার্ন ক্লিনিক, রাজগঞ্জ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কপোতাক্ষ ক্লিনিক ,পারবাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বেনাপোল পৌর শহরে অবস্থিত বেনাপোল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্টার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ঝিকরগাছা উপজেলার ফেমাস মেডিকেল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ছুটিপুর প্রাইভেট ক্লিনিক, আয়েশা মেমোরিয়াল মেডিকেল সেন্টার, মোহাম্মদ আলী ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সীমান্ত ডায়াগনস্টিক এন্ড ডায়াবেটিস কেয়ার, ছুটিপুর প্রাইভেট ক্লিনিক, সালেহা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও আনিকা ক্লিনিক, বাঘারপাড়া উপজেলার হাজি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নিম্মমানের এসব প্রতিষ্ঠানে নানা অনিয়ম ও  ত্রুটির মধ্যে রোগীর অস্ত্রোপচার, চিকিৎসা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হতো। অথচ মানসম্মত যন্ত্রপাতি বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট ছিলো না কারো। এছাড়া ভাড়াটিয়া চিকিৎসক ডেকে অপারেশন করানো হতো। অপারেশনের পর আর কোন খোঁজ না থাকার অভিযোগে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ ঘোষণা করা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নিয়মনীতি না মেনেই চাল করা হয়েছে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট ২৮৭ টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে নতুন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স গ্রহণ ও পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘোষণা অনুযায়ী সময়সীমা বেধে দেয়া হয়। এরমধ্যে ২৩৪ টি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। বাকি ৫৩ প্রতিষ্ঠান মালিক সরকারি আদেশ প্রথম অবস্থায় মানেননি। যে কারণে প্রতিষ্ঠান মালিকদের কারণ দর্শনো নোটিশ জারি করা হয়। এরমধ্যে ৩৬ টি প্রতিষ্ঠানের মালিক নোটিশের জবাব ছিলো অসন্তোষজনক। পরবর্তীতে সূর্যের হাসি ক্লিনিকছাড়া সব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে অনলাইনে আবেদন পাঠায়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে পক্ষে বিপক্ষে কর্তৃপক্ষের কাছে মতামত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সিভিল সার্জন অফিস আরও জানিয়েছে, মতামত প্রতিবেদনে জেলার ৮৯ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স পাওয়ার অযোগ্য বলে জানানো হয়। ওই সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সেবিকা ও প্যাথলজিস্ট নেই। এছাড়া নিম্নমানের অস্ত্রোপচার কক্ষ, প্যাথলজি বিভাগ নোংরা পরিবেশছাড়াও মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়।  ফলে ৮৯  হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স পাওয়ার অযোগ্য বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহিন। এসব নামমাত্র প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে হালনাগাদ লাইসেন্স ছাড়াই চলছে বেসরকারি হসপিটাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখানে চিকিৎসাসেবায় নানা ধরণের অনিয়ম হলেও দেখার কেউ নেই। আবার নতুন করে গড়ে ওঠা একাধিক ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ফ্রি-স্টাইলে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। মালিকপক্ষ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই কার্যক্রম শুরু করলেও স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

চৌগাছা উপজেলা শহরে গড়ে ওঠা
 সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ গত সেপ্টেম্বর মাসে সিভিল সার্জন অফিসে আবেদন করে। আবেদনে ডিপ্লোমা পাস করা প্যাথলজিস্ট হিসেবে তানভীর রহমান মিঠুর নাম দেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, তানভীর রহমান মিঠু সততা ডায়াগনস্টিকে কাজ করেন না। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদনে তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার আগেই সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অবৈধভাবে চিকিৎসা ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সকল কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (প্যাথলজিস্ট), একজন রিপোর্ট প্রদানকারী, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানা হয়নি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হিসাব কর্মকর্তা ইমরান হোসেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সেজে সব গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন (রিপোর্ট) দিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হলেও সিভিল সার্জন এখনো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকপক্ষের কাছ থেকে মোট অংকের মাসোহারা নিয়ে অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। একই ভাবে চলছে যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডে অবস্থিত প্রিন্স ডায়াগনস্টিক সেন্টার । লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চালু করা হয় কার্যক্রম। লাইসেন্স না মিললেও ১ বছরের বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে চালু রয়েছে।
এছাড়া বিগত দিনে বন্ধ ঘোষণা করা একাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমতি ছাড়া কিভাবে কার্যক্রম শুরু করা হলো তা নিয়েও নানা সমালোচনা রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সিভিল সার্জন অফিসের জড়িত একজন কর্মচারীর সাথে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকরা সম্পর্ক রেখে অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে  দুই জন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক জানান, তাদের সিভিল সার্জনের অফিসে প্রতি মাসে মাসোহারা দিতে হয়। সেখানকার একজন কর্মচারির মাধ্যমে মাসোহারা পৌঁছে দেন। তবে মাসোহারা আদায় করা কর্মচারির নাম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে, লাইসেন্স হালনাগাদ করতে সিভিল সার্জন অফিসে ৫০ হাজার টাকা ও নতুন ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স পেতে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। অন্যথায় লাাইসেন্স পাওয়ার উপযোগী হিসেবে ‘ডান’ করা হয়না। ঘুষ বাণিজ্যের জন্য সিভিল সার্জন অফিসে নির্দিষ্ট একজন কর্মকর্তা রয়েছে।
সূত্র জানায়, মাসোহারার বিনিময়ে লাইসেন্স ছাড়া মালিকপক্ষ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কার্যক্রম শুরুর সাহস পেয়ে থকে। অনুমতি ছাড়া প্রকাশ্যে কার্যক্রম চলার বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিকভাবে তদারকি ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকায় বৈধ অবৈধ বেসরকারি হসপিটাল ও ক্লিনিকে দায়সারা চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে যশোর জেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে ভুল অস্ত্রোপচার ও অপচিকিৎসায় অসংখ্য রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গত ৩১ জুলাই শহরের পঙ্গু সেবা কেন্দ্রে ডা. নজরুল ইসলামের ত্রুটিপূর্ণ অপারেশনে রসুল ওরফে রাসেল ( ৩৬) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। অপারেশনের আগে ডা. নজরুল নিজেই রোগীর অ্যানেস্থেসিয়া দেন। রাসেল যশোর সদর উপজেলার হাশিমপুর গ্রামের তরফদার পাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে। এই ঘটনায় মৃতের স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে হট্টগোল করেন। পরে সিভিল সার্জনের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।  গত ৩০ জুন অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ার ফাতেমা প্রাইভেট হসপিটালে মুনজুরুল মুরশিদের ভুল সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারে মারা যান চুয়াডাঙ্গার দর্শনা উপজেলার রাজের স্ত্রী ও অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের আরশাফ শেখের মেয়ে ইতি বেগম (২২)। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ জুন নওয়াপাড়ার আরোগ্য সদন প্রাইভেট ক্লিনিকে ভুল অস্ত্রোপচারে আরেক প্রসূতি অর্চনার (২৫) মৃত্যু হয়। ডা. মিলন কান্তি বোস তার সিজার করেছিলেন। অর্চনার মৃত্যুতেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
যশোর সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের আব্দুল হাকিমের স্ত্রী কাজলকে  ২৪ জুন রাত ১০ টার দিকে যশোর শহরের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডের সিটি হসপিটালে সিজার করা হয়। অস্ত্রোপচার করেন ডাক্তার ফারজানা পারভীন। অজ্ঞানের চিকিৎসক ছিলেন ডা. আহসান কবির বাপ্পি। সিজারের পর রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জুন ভোরে প্রসূতি কাজল মারা যান। এ ঘটনায় তার স্বজনেরা ক্ষুব্ধ হয়ে হসপিটালের সামনে বিক্ষোভ করেন। ২৬ জুন বুধবার সিভিল সার্জনের নির্দেশে বুধবার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। ২৪ জুন  সদর উপজেলার রুপদিয়ার গ্রামীণ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে  সিজারের পর মারা যান নরেন্দ্রপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রিমা। এ ঘটনায় প্রসূতির স্বজন ও এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ক্লিনিকটি ভাংচুর করেছে। পালিয়ে রক্ষা পান এমবিবিএস ডা. নুরছালী ও তার স্বামী ক্লিনিক মালিক জামাল হোসেন। পরে সিভিল সার্জনের নির্দেশে ক্লিনিকটিকে সিলগালা ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কাজল ও রিমা ছাড়াও  নামমাত্র বিভিন্ন ক্লিনিক ও হসপিটালে ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা অবহেলায় মারা গেছেন যশোর সদর উপজেলার মুনসেফপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুস সাত্তারের মেয়ে রুনা বেগম (২৬), মুড়লি মোড়ের জোড়া মন্দির এলাকার বিপ্লব হোসেনের ছেলে ইরহাম (৪১ দিন), চাঁচড়া মধ্যপাড়ার রবিউল ইসলামের মেয়ে মীম খাতুন (১২),  চাঁচড়া মধ্যপাড়ার রবিউল ইসলামের মেয়ে মীম খাতুন (১২), ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা ইউনিয়নের বামন আলী চাপাতলা গ্রামের ড্রাইভার গোলাম রসুলের স্ত্রী আসমা বেগম (৩২) ও মণিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের এনায়েতপুর  আব্দুস সাত্তার মিস্ত্রির ছেলে আব্দুল মান্নান (৪০)। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায় সিভিল সার্জন অফিস তদন্ত কমিটি গঠন করে। অথচ একটি ঘটনায় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি। অজ্ঞাত কারণে তদন্ত প্রতিবেদন ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
জানা গেছে, যশোর শহরে সরকারের নির্দেশনা না মেনে নিজেদের ইচ্ছামতো হসপিটাল ও ক্লিনিক  গড়ে বহাল তবিয়তে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। না বুঝে মানুষ সেখানে চিকিৎসার জন্য গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।  একাধিক নামমাত্র বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাসেবায় ঝুঁকির আশংকা রয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার জন্য এসে মাশুল গুনতে হচ্ছে রোগী স্বজনদের। চিকিৎসাসেবা নামে প্রতারণা করা যেনো মালিক পক্ষের লক্ষ্য। দালাল নির্ভর অধিকাংশ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান মালিকদের উদ্দেশ্য যেনতেন চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো। অথচ মানসম্মত অপারেশন থিয়েটার (ওটি) রোগ নির্ণয়ের জন্য উন্নতমানের কোন যন্ত্রপাতি নেই। আবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হলেও মুহুর্তে ফের কার্যক্রম চালু হয়ে যায়।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা.মাহমুদুল হাসান জানান, বেসরকারি হসপিটাল ক্লিনিক মালিকদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ তিনি শুনেছেন। দায়িত্বরতদের তিনি  অর্থবাণিজ্য বন্ধ করার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। এরপরও কেউ বাণিজ্যের
সাথে জড়িত প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানান, চৌগাছার সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রোগী মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।