* সংস্কারে রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করলে আন্তর্জাতিকভাবে হবে প্রশ্নবিদ্ধ
* স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিরোধে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
‘জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন সরকারকে সংস্কার কাজ ত্বরান্বিত করতে একটি বড় মানসিক শক্তি জুগিয়েছে’
-মাসদার হোসেন, সদস্য, আইন বিশেষজ্ঞ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
‘ফ্যাসিস্টের ভূমিকায় যেন কেউ অবতীর্ণ হতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। সেটির চূড়ান্ত বন্দবস্ত না হলে, পরবর্তীতেও যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও ফ্যাসিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন’
-ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি।
জুলাই আন্দোলন নিয়ে প্রতিবেদনে বিচার, পুলিশ, রাজনীতি ও দুর্নীতি দমন সংস্কারে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। শেখ হাসিনার মতো আর কেউ যেন স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে সেই লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ঋণ আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিতদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন কঠোর ও সমভাবে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে সংস্কার অনেক সহজ হবে। এছাড়া, প্রয়োজনীয় সংস্কারে কোনো রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করলে তারা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিরোধে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি। এজন্য জাতিসংঘের এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি নিয়ে তৈরি করা এ প্রতিবেদন গত বুধবার প্রকাশ করে জাতিসংঘ। ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে নির্বিচারে হত্যার ঘটনায় নির্দেশদাতা এবং নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাসহ ৪১ সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। এতে ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অবাধ ও প্রকৃত নির্বাচনের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ঋণ আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিতদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন কঠোর ও সমভাবে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক, সংখ্যালঘু নেতা, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক বা রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশকারীরা যেন অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, সেই সুপারিশও করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জবাবদিহিতা ও বিচার বিভাগ, পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগ, নাগরিক পরিসর, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সুশাসন খাতে এসব সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
এছাড়াও প্রতিবেদনে ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও বিচার ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারে জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কথাও বলা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, আইনের অপব্যবহার, জোরপূর্বক গুম এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সমন্বিত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা; যেসব অপরাধী নির্দেশদাতা ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তাদের বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কার্যকর প্রতিকার এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই আন্দোলন নিয়ে প্রতিবেদনে বিচার, পুলিশ, রাজনীতি ও দুর্নীতি দমন সংস্কারে জাতিসংঘের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি। তারা বলছেন, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিরোধে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন গুরুতপূররণ ভূমিকা রাখবে। তারা বলছেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সব স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে একটা জবাবদিহিতার বিষয় চলে আসবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করলে আন্তর্জাতিকভাবেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা রাখা গেলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সহজ হবে বলছেন তারা। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচারের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ। সন্ত্রাসদমন আইন সংশোধন, গণমাধ্যম ও বিরোধীমত রোধে ব্যবহৃত আইন বাদ দিতে বলেছে। আইনজীবীরা বলছেন, কোনো রাজনৈতিক দল এসব সুপারিশ প্রত্যাখান করতে পারবে না। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করা সম্ভব নয় বলে মত অধিকাংশ আইনজীবীর।
এ বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারবিভাগ গড়তে জাতিসংঘের দেওয়া সুপরিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবেও রয়েছে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন সরকারকে সংস্কার কাজ ত্বরান্বিত করতে একটি বড় মানসিক শক্তি জুগিয়েছে। যার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রকাশ করা খুবই প্রাসঙ্গিক, মানবিক এবং আমি মনে করি উচিত। সবাই কিন্তু আমরা আয়নার সামনে, ক্যামেরার সামনে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ফ্যাসিস্টের রেজাল্টটা হয়েছে অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, লুটপাট- এসব একদিনে হয়নি। যে যে কারণগুলোতে এসব ডেভেলপ করেছে সেই কারণগুলো দেখিয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবেদন। যেমন, কারো কোনো বিচার হতো না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যে বিচারালয়ে আসত তা কলুষিত ছিল।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম বলেন, ফ্যাসিস্টের ভূমিকায় যেন কেউ অবতীর্ণ হতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। সেটির চূড়ান্ত বন্দবস্ত না হলে, পরবর্তীতেও যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও ফ্যাসিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
























