- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে দূরত্ব
- লন্ডনে ইউনূস-তারেক বৈঠকে বাকি দলগুলোতে অস্বস্তি
- ১০টি রাজনৈতিক দলের একাত্মতায় বিএনপির পাল্টা প্রতিক্রিয়া
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে পিআর পদ্ধতি (প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদের আসন) ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই পদ্ধতিতে ভোট না হলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে আওয়ামীবিরোধী বলে পরিচিত ১০টি রাজনৈতিক দল গত শনিবার একমঞ্চে উঠে পিআর পদ্ধতির দাবি তুলে ধরেছেন। এদিকে বিএনপি এই ঘটনায় পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, পিআর পদ্ধতির দাবি তুলে একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। পিআর পদ্ধতি কই থেকে আসে? কে দেয় বুদ্ধি আপনাদের? এই সব কু পরামর্শ নিয়ে, এই দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একদল লোক আজকে মাঠে নেমেছে। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অস্বস্তিতে রয়েছে। এজন্য তারা একাত্মতা পোষণ করে বিএনপিকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে বিএনপিও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের ফলে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলো কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে। কারণ, রাজনৈতিক মহলে তখন আলোচনা উঠেছে, রাজনীতিতে বিএনপির রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব কমেছে। অনেকের মতে, এমন পরিস্থিতিতে অন্য দলগুলো একাট্টা হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামপন্থিদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর নেপথ্য ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। এরই অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনার পর অবশেষে গত শনিবার ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে একমঞ্চে উঠেছেন ওইসব দলের নেতারা। ওই মঞ্চ থেকে বক্তৃতাকালে সব দলের নেতাই বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। রাজনৈতিক চিত্রটা এমনভাবে উঠেছে যে, এই দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে বিএনপি। ফলে ওই দিনই বিএনপি এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় তাদের উদ্দেশ্য আছে। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতে পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে।
এদিকে, গত শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে ‘ইসলামপন্থি’ রাজনৈতিক দলগুলো একমঞ্চে উঠেছে। এই দলগুলোকে নিয়ে আগামী মাসে জামায়াতে ইসলামী একই ধরনের শোডাউন করবে। সে সময় এই দলগুলো আবারও একমঞ্চে উঠে পিআর পদ্ধতি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে শুধু বিএনপিতে নয়, নির্বাচন প্রশ্নে সরকারেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। এই দলগুলো যদি পাল্টা চাপ সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও জটিলতা তৈরি হতে পারে। অপরদিকে, বিএনপি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে।
অন্যদিকে এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও নেপালে এ পদ্ধতি চালু আছে। তবে সব আসনে নয়। বিগত চারটি নির্বাচনের ফলাফল বিশে¬ষণে দেখা গেছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৩.৬১ শতাংশ, ২০০১ সালে বিএনপি ৪০.৮৬ শতাংশ ও আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৩.২০ শতাংশ ভোট পায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসন ও বিএনপি ৩০ আসন পায়। কিন্তু আনুপাতিক হারে হলে ২৩০ আসন থেকে কমে আওয়ামী লীগের আসন দাঁড়াত ১৪৭-এ। অপরদিকে বিএনপির বেড়ে দাঁড়াত ৯৯টি আসন। ফলে, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে একদিকে জয়ী দলগুলোর আসন কমবে, অন্যদিকে সংসদের বিরোধীদলসহ ছোট দলগুলোর আসন বাড়বে।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যাপারে সবাই একমত। বিশ্বের ৬০-৬২টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে ভোট হয়। পিআর পদ্ধতিতে ভোট কারচুপি, পেশিশক্তির ব্যবহার, কালো টাকার ব্যবহার এবং কেন্দ্র দখলের সুযোগ থাকবে না। আমরা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকব। ‘কেয়ারটেকার সরকার’-এর অধীনে নির্বাচনের দাবি আমরা প্রথম তুলেছিলাম। এবং নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার দাবি বাস্তবায়ন হয়েছে। আশা করি, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিও জনগণ মেনে নেবে।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানানো হলেও রাজপথে কোনো সংঘাত হবে না। কারণ, প্রত্যেক দলের আদর্শ, দর্শন ও নীতি ভিন্ন থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। ফ্যাসিজম ও স্বৈরতন্ত্র মোকাবিলার একমাত্র নিরাপদ পদ্ধতি হলো পিআর।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, আমরা আংশিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। বর্তমান ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। তাই ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধি নির্বাচনে আংশিক পিআর পদ্ধতিতে নিুকক্ষে ও পূর্ণ পিআর পদ্ধতি উচ্চকক্ষে চালু করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কথা বলার অধিকার আছে। তবে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। আমরা যদি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, তাহলে এই প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতি নিয়ে জনগণের কাছে গিয়ে ম্যান্ডেট চাইতে হবে। জনগণ ম্যান্ডেট দিলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।


























