- বছরের ব্যবধানে নিত্যপণ্যের দামে ‘বড় ঊর্ধ্বগতি’
- কিছু পণ্যের দাম কমলেও স্থিতিশীল নয় বাজার
- বোরো মৌসুমেও কমেনি চালের দাম, নাগালের বাইরে সয়াবিন তেল ও ইলিশ
‘কৃষকরা ন্যায্য দাম না পেলেও ভোক্তাদের বেশি দরে পণ্য কিনতে হচ্ছে। যথাযথ বাজার অভিযানের অভাবে ভোক্তাদের পকেট থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। ’ – এস এম নাজের হোসেন, সহসভাপতি, ক্যাব
গত এক বছরে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। চাল, তেল, মাছ, সবজি—প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে, যা এক প্রকার ‘অঘোষিত মূল্যস্ফীতি’ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে। অর্থনৈতিক সংকট, সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতা ও বাজার তদারকির ঘাটতি—এই তিন কারণকে সামনে রেখে চলছে মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কিছু প্রচেষ্টা থাকলেও তা বাস্তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হচ্ছে না বলেই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
চালের বাজারে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে আটাশ ও মিনিকেট চালের দামে। যদিও আমন ও বোরো দুই মৌসুমেই চাষ ভালো হয়েছে এবং উৎপাদনও সন্তোষজনক, তার পরেও বাজারে চালের দাম কমেনি। ঢাকার মোহাম্মদপুর, হাতিরপুল, কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক বছর আগে যে আটাশ চাল ৫০–৫৮ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। মিনিকেট বা চিকন চালের দাম ৭৫–৮৫ টাকা কেজিতে পৌঁছে গেছে, যা এক বছরে ১৩–১৪ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং টিসিবির পরিসংখ্যানেও এই তথ্য মিলেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ১৫.৩৯ শতাংশ, মোটা চাল ১৪ শতাংশের বেশি এবং চিকন চাল প্রায় ১৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা এবং রাইসমিল পর্যায়ে মনিটরিং না থাকায় মিলমালিকরা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। ফসল ভালো হলেও খুচরা বাজারে তার সুফল পৌঁছাচ্ছে না।
তেলের বাজারেও চলছে একই চিত্র। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এক বছরে লিটারপ্রতি ১৬৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৮৮ টাকায় উঠেছে, অর্থাৎ বেড়েছে ১৫ শতাংশ। পামতেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। বিশেষ করে খোলা সয়াবিন তেলের বাজারে অনেক বেশি অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। খোলা তেল ১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬২ টাকায় এক বছরে ১১.৭২ শতাংশ বৃদ্ধি। এখানেও মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয় এবং বাজার তদারকির দুর্বলতা। মাছের বাজারে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ইলিশ মাছের দাম। যেখানে এক বছর আগে এক কেজি ওজনের ইলিশ ১,৫০০–১,৭০০ টাকায় মিলত, এখন তা ২,২০০ টাকায় পৌঁছেছে। ছোট ইলিশও ১,২০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ৩৩.৩৩ শতাংশ। একজন ক্রেতা মন্তব্য করেন, ইলিশ এখন সাধারণের মাছ নয়, ধনীদের বিলাসিতা।
পাঙাশ, তেলাপিয়া ও রুই মাছের দামেও বেড়েছে ১৫–২০ শতাংশ হারে, যা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে নতুন চাপ তৈরি করছে। গ্রীষ্মকালীন সবজির মৌসুমেও দাম কমছে না। বিশেষ করে পটোল, ঢ্যাঁড়স, চিচিঙ্গা প্রভৃতি সবজির দাম বেড়েছে ২০-৩৩ শতাংশ। গত বছরের জুনে যেখানে পটোল পাওয়া যেত ২৫-৪৫ টাকায়, সেখানে এখন ৪০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঢ্যাঁড়সের দাম ৩০-৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০-৬০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। তবে ক্যাব বলছে, এর পেছনে মূলত বাজার মনিটরিংয়ের ঘাটতি এবং অসাধু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিই দায়ী।
মূল্যবৃদ্ধির এ প্রবণতার মাঝেও কিছু পণ্যে স্বস্তি ফিরেছে। ডিম, ব্রয়লার মুরগি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, চিনি, রসুন ও আদার দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ডিমের দাম কমে এখন কেজিতে ৫-৮ টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি এখন ১৫-২০ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। চিনির দামও ৫-৭ টাকা কমেছে। তবে এই স্বস্তির তালিকা ছোট এবং এর পরিসর খুবই সীমিত। বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তাসংগঠনগুলোর মতে, দেশের বাজার ব্যবস্থায় একটি কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে—চাল, তেল, মাছ ও সবজি—বাজার মনিটরিং, বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ ও মাঠপর্যায়ে নজরদারিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ ছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধ করতে হবে উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সরবরাহচেইনে স্বচ্ছতা আনতে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বাজার তদারকির অভাবে মিলমালিকরা ইচ্ছামতো চালের দাম বাড়াচ্ছেন। এ জন্য চালের দাম বাড়ছেই। মিডিয়ায় নিউজ হলে ভোক্তা অধিদপ্তর খুচরা বাজারে অভিযান চালায়। কাউকে কাউকে জরিমানা করে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। কারণ রাইসমিলে ধরা হয় না বলেই ধানের মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। ইলিশ মাছেরও দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। এখানে সরকারের সংশ্লিষ্টদের দেখা দরকার। কৃষকরা ন্যায্য দাম না পেলেও ভোক্তাদের বেশি দরে পণ্য কিনতে হচ্ছে। যথাযথ বাজার অভিযানের অভাবে ভোক্তাদের পকেট থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাসির-উদ-দৌলা বলেন, আমরা যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করি। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় বাজারে সে দাম বজায় থাকে না। বাজার পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

























