০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ক্ষেতে কীটনাশ, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

  • মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে
  • ধ্বংস হচ্ছে উপকারী পোকামাকড়
  • দেখা দিচ্ছে কিডনি-যকৃতে সমস্যা, বাড়ছে ক্যানসারের ঝুঁকি
  • কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ মিলেছে ৩০ শতাংশ সবজিতে
  • হুমকিতে পড়ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ

পোকা দমন ও ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি জমিতে ব্যাপক হারে ছিটানো হচ্ছে কীটনাশক। কীটনাশকের ব্যবহারে মানা না কোনো নিয়মনীতি। চলতি বোরো মৌসুমে ধানসহ সবজি খেতে কৃষক যে পরিমাণ ঝাঁঝাল গন্ধযুক্ত কীটনাশক ছিটাচ্ছে তাতে ফসলি জমির পাশ দিয়ে মানুষ নাক চেপে ধরে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। এর যথেচ্ছা ব্যবহারে মানুষের স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি কীটনাশক খেয়ে ফেলছে মাটির উর্বরতা শক্তি। যার বড় একটি অংশ নানাভাবে যাচ্ছে মানব শরীরে। এতে করে মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি জলজ প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শস্যের উপকারী পোকামাকড় ও ফড়িং শেষ হওয়ার পথে। বাজারে ভেজাল ও নিম্নমানের কীটনাশকেও সয়লাব। জনসচেতনতা কিংবা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা নেই কৃষিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের।
উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, ‘কৃষিতে ছত্রাকনাশক, কীটনাশক ও আগাছানাশক একত্রে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ছত্রাকনাশকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যা প্রায় ৪৫ থেকে ৪৬ শতাংশ। এরপর রয়েছে কীটনাশক (৩৩ শতাংশ) এবং আগাছানাশক (২০-২১ শতাংশ)। পাশাপাশি কৃমিনাশক, ব্যাকটেরিয়ানাশক ও ইঁদুরনাশকও ব্যবহৃত হয়। দেশের ৩০ শতাংশ সবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। শসায় ৫০ শতাংশ, টমেটোতে ৪০ শতাংশ, বেগুন ও ফুলকপিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ও বাঁধাকপিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সবজিতে। অনেক কৃষক না বুঝে সবজি চাষে অতিরিক্ত পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করেন। সবজি সাধারণত অল্প সময়ের ব্যবধানে চাষ করা হয়। অল্প রান্না করে খাওয়া হয় ফলে কীটনাশকের প্রভাব বেশি থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৩০ শতাংশ সবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। শসায় ৫০ শতাংশ, টমেটোতে ৪০ শতাংশ, বেগুন ও ফুলকপিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ও বাঁধাকপিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, ‘কৃষকরা যখন কীটনাশক প্রয়োগ করেন। সেটি শুধু গাছে নয় বরং মাটিতেও পৌঁছে যায়। পরে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে ভূগর্ভস্থ পানি, পুকুর, নালা বা খালের পানি দূষিত করে। কিছু উদ্বায়ী কীটনাশক বাতাসে মিশে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় অণুজীব কীটনাশক শোষণ করে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে। যেসব কীটনাশকের অর্ধ-জীবনকাল বেশি। সেগুলো দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে দূষণ ছড়ায়। ফলে উপকারী কেঁচো, মাইট, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকসহ অনেক উপকারী প্রাণী মারা যায়। মাটির উর্বরতা কমে, জলজ প্রাণী ও মৌমাছিও ক্ষতির শিকার হয়। বাংলাদেশে বালাইনাশক ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিয়মের দুর্বল বাস্তবায়ন বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক শাহজাহান। বাজারে অনেক নিম্নমানের ও অনিয়ন্ত্রিত বালাইনাশক সহজে পাওয়া যায়। অনেক সময় চোরা পথে আনা পণ্যও বাজারে ঢুকে পড়ে যা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। দ্বিতীয়ত, দেশে পর্যাপ্ত মনিটরিং বা তদারকি ব্যবস্থা নেই। কৃষকদের সচেতন করা জরুরি এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, ‘সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম)। শুধুমাত্র জৈব পদ্ধতি সবসময় সম্ভব নয় তাই বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। জমি প্রস্তুতির পর কিছুদিন ফেলে রাখলে অনেক ক্ষতিকর পোকা আপনাতে মারা যায়। সঙ্গে জৈব কীটনাশক বা বায়ো এজেন্ট ব্যবহারে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ‘ট্রাইকোডারমা’ ছত্রাকজাত রোগ দমনে কার্যকর। অণুজীব কীটনাশক, উদ্ভিদের নির্যাস বা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েও পোকা দমন করা যায়। ফসলের বৈচিত্র্য আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে কীটনাশক শরীরে জমলে তা পশুর কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করে। মাংসপেশিতে জমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পুরুষ পশুর ক্ষেত্রে স্পার্মাটোজেনেসিস ও নারী পশুর ক্ষেত্রে ও ওজেনেসিস বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রজনন ক্ষমতা কমে। তিনি বলেন, ‘সরকার ভর্তুকি দিলে জৈব কীটনাশকের সহজলভ্যতা বাড়বে এবং গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে আরও উৎসাহিত হবেন। প্রশিক্ষণ ও কৃষি সম্প্রসারণ জোরদার করলে কৃষকদের সচেতনতা বাড়বে। এটি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক হবে। বাকৃবির উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘গবাদি পশু কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে প্রধানত দুইভাবে, সরাসরি ও পরোক্ষভাবে। সরাসরি সংস্পর্শ ঘটে যখন পশু খোলা পরিবেশে অবস্থান করে এবং বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানো কীটনাশক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। পেস্টিসাইডের মাত্রা যদি পশুর সহনশীলতার বাইরে যায়। তাহলে তাদের শরীরে বিভিন্ন বিষক্রিয়াজনিত উপসর্গ দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে কীটনাশক শরীরে জমলে তা পশুর কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করে। মাংসপেশিতে জমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পুরুষ পশুর ক্ষেত্রে স্পার্মাটোজেনেসিস ও নারী পশুর ক্ষেত্রে ও ওজেনেসিস বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রজনন ক্ষমতা কমে। এর ফলে পশুর উৎপাদন, মাংসের গুণগত মান ও পরিমাণ, দুধ উৎপাদন কমে যায়। সর্বোপরি দেশের পশুসম্পদ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। ‘কীটনাশক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা মানবদেহের জন্য একেবারে অচেনা বা ‘ফরেন সাবস্ট্যান্স’। এসব কখনো শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান নয় বরং এগুলো টক্সিক রাসায়নিক যা সরাসরি বা খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করে। এসব রাসায়নিক শরীরে জমে কোষে মিউটেশন ঘটায় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে তোলে। অধ্যাপক শফিকুল বলেন, ‘কৃষি খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশকের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন অরগানোফসফেট, অরগানোক্লোরিন, কার্বামেট, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো যে সব বালাইনাশক যেগুলোর লিপিডের প্রতি আকর্ষণ বা জমে থাকার প্রবণতা বেশি। এসব বালাইনাশক সহজে শরীর থেকে বের হয় না এবং গবাদি পশুর মাংস, দুধ ও ডিমে জমে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করে। দুধ ও ডিমের মাধ্যমে কিছু কীটনাশক বের হলেও, মাংসে এগুলো বেশি জমে থাকে। এগুলো দীর্ঘদিন শরীরে থেকে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে এবং শরীরের অ্যামিনো অ্যাসিড সিকোয়েন্সে পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এ গবেষক বলেন, ‘কীটনাশক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা মানবদেহের জন্য একেবারে অচেনা বা ‘ফরেন সাবস্ট্যান্স’। এসব কখনো শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান নয় বরং এগুলো টক্সিক রাসায়নিক যা সরাসরি বা খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করে। এসব রাসায়নিক শরীরে জমে কোষে মিউটেশন ঘটায় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে তোলে। বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য সাধারণ টক্সিক উপাদানের তুলনায় বালাইনাশকের মিউটেশন ক্যাপাসিটি ৫১ থেকে ৯১ গুণ বেশি যা অত্যন্ত ভয়াবহ। এসব রাসায়নিক শরীরে ঢুকে চর্বি বা ফ্যাট টিস্যুতে জমা হয়। ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, লিভার ও কিডনিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করায় শরীরের বিষাক্ত পদার্থ অপসারণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বোনম্যারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও রক্ত উৎপাদন ব্যাহত হয়, স্পার্ম ও ডিম্বাণু উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রজনন ক্ষমতা ব্যাহত হয়। অধ্যাপক শফিকুল বলেন, ‘গবেষণা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ এবং জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকি মুক্ত করতে বাংলাদেশ সরকারকে গবেষণায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে প্রাণিসম্পদ খাতকে আরও গবেষণামুখী করতে হবে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

সানজিদা তন্বীর বিয়ের খবর জানালেন ফেসবুকে নিজের হৃদয়গ্রাহী পোস্টে

ক্ষেতে কীটনাশ, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

আপডেট সময় : ০৭:২৫:৪৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
  • মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে
  • ধ্বংস হচ্ছে উপকারী পোকামাকড়
  • দেখা দিচ্ছে কিডনি-যকৃতে সমস্যা, বাড়ছে ক্যানসারের ঝুঁকি
  • কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ মিলেছে ৩০ শতাংশ সবজিতে
  • হুমকিতে পড়ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ

পোকা দমন ও ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি জমিতে ব্যাপক হারে ছিটানো হচ্ছে কীটনাশক। কীটনাশকের ব্যবহারে মানা না কোনো নিয়মনীতি। চলতি বোরো মৌসুমে ধানসহ সবজি খেতে কৃষক যে পরিমাণ ঝাঁঝাল গন্ধযুক্ত কীটনাশক ছিটাচ্ছে তাতে ফসলি জমির পাশ দিয়ে মানুষ নাক চেপে ধরে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। এর যথেচ্ছা ব্যবহারে মানুষের স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি কীটনাশক খেয়ে ফেলছে মাটির উর্বরতা শক্তি। যার বড় একটি অংশ নানাভাবে যাচ্ছে মানব শরীরে। এতে করে মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি জলজ প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শস্যের উপকারী পোকামাকড় ও ফড়িং শেষ হওয়ার পথে। বাজারে ভেজাল ও নিম্নমানের কীটনাশকেও সয়লাব। জনসচেতনতা কিংবা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা নেই কৃষিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের।
উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, ‘কৃষিতে ছত্রাকনাশক, কীটনাশক ও আগাছানাশক একত্রে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ছত্রাকনাশকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যা প্রায় ৪৫ থেকে ৪৬ শতাংশ। এরপর রয়েছে কীটনাশক (৩৩ শতাংশ) এবং আগাছানাশক (২০-২১ শতাংশ)। পাশাপাশি কৃমিনাশক, ব্যাকটেরিয়ানাশক ও ইঁদুরনাশকও ব্যবহৃত হয়। দেশের ৩০ শতাংশ সবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। শসায় ৫০ শতাংশ, টমেটোতে ৪০ শতাংশ, বেগুন ও ফুলকপিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ও বাঁধাকপিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সবজিতে। অনেক কৃষক না বুঝে সবজি চাষে অতিরিক্ত পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করেন। সবজি সাধারণত অল্প সময়ের ব্যবধানে চাষ করা হয়। অল্প রান্না করে খাওয়া হয় ফলে কীটনাশকের প্রভাব বেশি থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৩০ শতাংশ সবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। শসায় ৫০ শতাংশ, টমেটোতে ৪০ শতাংশ, বেগুন ও ফুলকপিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ও বাঁধাকপিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, ‘কৃষকরা যখন কীটনাশক প্রয়োগ করেন। সেটি শুধু গাছে নয় বরং মাটিতেও পৌঁছে যায়। পরে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে ভূগর্ভস্থ পানি, পুকুর, নালা বা খালের পানি দূষিত করে। কিছু উদ্বায়ী কীটনাশক বাতাসে মিশে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় অণুজীব কীটনাশক শোষণ করে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে। যেসব কীটনাশকের অর্ধ-জীবনকাল বেশি। সেগুলো দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে দূষণ ছড়ায়। ফলে উপকারী কেঁচো, মাইট, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকসহ অনেক উপকারী প্রাণী মারা যায়। মাটির উর্বরতা কমে, জলজ প্রাণী ও মৌমাছিও ক্ষতির শিকার হয়। বাংলাদেশে বালাইনাশক ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিয়মের দুর্বল বাস্তবায়ন বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক শাহজাহান। বাজারে অনেক নিম্নমানের ও অনিয়ন্ত্রিত বালাইনাশক সহজে পাওয়া যায়। অনেক সময় চোরা পথে আনা পণ্যও বাজারে ঢুকে পড়ে যা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। দ্বিতীয়ত, দেশে পর্যাপ্ত মনিটরিং বা তদারকি ব্যবস্থা নেই। কৃষকদের সচেতন করা জরুরি এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, ‘সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম)। শুধুমাত্র জৈব পদ্ধতি সবসময় সম্ভব নয় তাই বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। জমি প্রস্তুতির পর কিছুদিন ফেলে রাখলে অনেক ক্ষতিকর পোকা আপনাতে মারা যায়। সঙ্গে জৈব কীটনাশক বা বায়ো এজেন্ট ব্যবহারে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ‘ট্রাইকোডারমা’ ছত্রাকজাত রোগ দমনে কার্যকর। অণুজীব কীটনাশক, উদ্ভিদের নির্যাস বা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েও পোকা দমন করা যায়। ফসলের বৈচিত্র্য আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে কীটনাশক শরীরে জমলে তা পশুর কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করে। মাংসপেশিতে জমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পুরুষ পশুর ক্ষেত্রে স্পার্মাটোজেনেসিস ও নারী পশুর ক্ষেত্রে ও ওজেনেসিস বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রজনন ক্ষমতা কমে। তিনি বলেন, ‘সরকার ভর্তুকি দিলে জৈব কীটনাশকের সহজলভ্যতা বাড়বে এবং গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে আরও উৎসাহিত হবেন। প্রশিক্ষণ ও কৃষি সম্প্রসারণ জোরদার করলে কৃষকদের সচেতনতা বাড়বে। এটি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক হবে। বাকৃবির উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘গবাদি পশু কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে প্রধানত দুইভাবে, সরাসরি ও পরোক্ষভাবে। সরাসরি সংস্পর্শ ঘটে যখন পশু খোলা পরিবেশে অবস্থান করে এবং বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানো কীটনাশক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। পেস্টিসাইডের মাত্রা যদি পশুর সহনশীলতার বাইরে যায়। তাহলে তাদের শরীরে বিভিন্ন বিষক্রিয়াজনিত উপসর্গ দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে কীটনাশক শরীরে জমলে তা পশুর কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করে। মাংসপেশিতে জমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পুরুষ পশুর ক্ষেত্রে স্পার্মাটোজেনেসিস ও নারী পশুর ক্ষেত্রে ও ওজেনেসিস বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রজনন ক্ষমতা কমে। এর ফলে পশুর উৎপাদন, মাংসের গুণগত মান ও পরিমাণ, দুধ উৎপাদন কমে যায়। সর্বোপরি দেশের পশুসম্পদ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। ‘কীটনাশক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা মানবদেহের জন্য একেবারে অচেনা বা ‘ফরেন সাবস্ট্যান্স’। এসব কখনো শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান নয় বরং এগুলো টক্সিক রাসায়নিক যা সরাসরি বা খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করে। এসব রাসায়নিক শরীরে জমে কোষে মিউটেশন ঘটায় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে তোলে। অধ্যাপক শফিকুল বলেন, ‘কৃষি খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশকের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন অরগানোফসফেট, অরগানোক্লোরিন, কার্বামেট, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো যে সব বালাইনাশক যেগুলোর লিপিডের প্রতি আকর্ষণ বা জমে থাকার প্রবণতা বেশি। এসব বালাইনাশক সহজে শরীর থেকে বের হয় না এবং গবাদি পশুর মাংস, দুধ ও ডিমে জমে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করে। দুধ ও ডিমের মাধ্যমে কিছু কীটনাশক বের হলেও, মাংসে এগুলো বেশি জমে থাকে। এগুলো দীর্ঘদিন শরীরে থেকে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে এবং শরীরের অ্যামিনো অ্যাসিড সিকোয়েন্সে পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এ গবেষক বলেন, ‘কীটনাশক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা মানবদেহের জন্য একেবারে অচেনা বা ‘ফরেন সাবস্ট্যান্স’। এসব কখনো শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান নয় বরং এগুলো টক্সিক রাসায়নিক যা সরাসরি বা খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করে। এসব রাসায়নিক শরীরে জমে কোষে মিউটেশন ঘটায় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে তোলে। বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য সাধারণ টক্সিক উপাদানের তুলনায় বালাইনাশকের মিউটেশন ক্যাপাসিটি ৫১ থেকে ৯১ গুণ বেশি যা অত্যন্ত ভয়াবহ। এসব রাসায়নিক শরীরে ঢুকে চর্বি বা ফ্যাট টিস্যুতে জমা হয়। ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, লিভার ও কিডনিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করায় শরীরের বিষাক্ত পদার্থ অপসারণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বোনম্যারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও রক্ত উৎপাদন ব্যাহত হয়, স্পার্ম ও ডিম্বাণু উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রজনন ক্ষমতা ব্যাহত হয়। অধ্যাপক শফিকুল বলেন, ‘গবেষণা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ এবং জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকি মুক্ত করতে বাংলাদেশ সরকারকে গবেষণায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে প্রাণিসম্পদ খাতকে আরও গবেষণামুখী করতে হবে।