প্রায়শই আমরা সংবাদে দেখি, বাংলাদেশি শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গড়ে তোলা সুউচ্চ ভবন, আকাশছোঁয়া টাওয়ার কিংবা অভিজাত বাসভবনে ঘাম ঝরাচ্ছেন। তাঁদের পরিশ্রমে আলোকিত হচ্ছে অন্যের নগরী, কিন্তু সেই আলো কখনোই পৌঁছায় না তাঁদের জীবনে। এই অন্ধকারের মূলেই রয়েছে কুখ্যাত কাফালা ব্যবস্থা।
কাফালা ব্যবস্থা হলো এক ধরনের অভিভাবকত্ব বা তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা, যেখানে শ্রমিকের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থাকে নিয়োগকর্তার (কফিল) হাতে। পাসপোর্ট থেকে শুরু করে কর্মস্থল পরিবর্তন বা দেশে ফেরার অনুমতি সবকিছুই নির্ভর করে কফিলের ইচ্ছার উপর। ফলাফল হিসেবে, হাজার হাজার শ্রমিক পরিণত হন আধুনিক দাসে।
কাফালা ব্যবস্থায় শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় স্বাধীনতা হারানোর মাধ্যমে। পাসপোর্ট জব্দ হওয়ায় তারা ইচ্ছামতো চাকরি বদলাতে বা দেশে ফিরতে পারেন না। কাজের শর্ত একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়। নিয়োগকর্তার মর্জি অনুযায়ী তাঁদের বেতন ও কর্মপরিবেশ নির্ধারিত হয়। স্বাধীনতার এই অভাব শ্রমিকদের জীবনে এক অদৃশ্য শৃঙ্খল তৈরি করে।
বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার আগে অধিকাংশ শ্রমিক এজেন্ট ফি, ভিসা ও যাতায়াত খরচ জোগাতে ঋণ নেন। তাঁরা ভাবেন, বিদেশে গিয়ে উপার্জন করবেন আর ঋণ শোধ করে সংসার চালাবেন। কিন্তু কাফালা ব্যবস্থার কারণে কাজের শর্ত পরিবর্তন বা বেতন বৃদ্ধির সুযোগ না থাকায় সেই ঋণ একসময় পরিণত হয় অন্তহীন দুঃস্বপ্নে। অনেকেই ঋণের বোঝা বইতে বইতে সারাজীবন কাটিয়ে দেন। কারও কারও জীবন কাটে ২০-২৫ বছর দেশের বাইরে, শুধু ঋণ শোধের দায়ে। এই দীর্ঘ প্রবাসজীবন তাঁদের জন্য হয়ে ওঠে বন্দিদশার মতো।
অর্থনৈতিক শোষণই সব নয়; কাফালা ব্যবস্থার আরেক নির্মম দিক হলো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। গৃহকর্মীরা একনাগাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেন, কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ পান না। নির্মাণশ্রমিকরা জীবন বাজি রেখে কাজ করেন, অথচ ন্যায্য মজুরিও পান না। কেউ কেউ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, কিন্তু অভিযোগ জানানোর সুযোগ থাকে না। পাসপোর্ট জব্দ থাকায় পালিয়ে যাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কফিলদের ‘সান্ডা’ (একটি সরীসৃপ প্রাণী) ধরার ভিডিও নিয়ে হৈচৈ হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে এটি হাস্যকর মনে হলেও এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর বেদনাদায়ক বাস্তবতা। কারণ, বিদেশে থাকা শ্রমিকদের জীবনে বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই। পরিবার ও স্বজনদের থেকে দূরে, দীর্ঘ একঘেয়েমি ও বিষণ্নতার মধ্যে দিন কাটাতে হয় তাঁদের। ফলে এই ধরনের তুচ্ছ ঘটনাও হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে ক্ষণিকের বিনোদন।
বিদেশে শ্রমিকরা প্রায়শই পরিবারের কাছে কেবল টাকা পাঠানো একটি মেশিনে পরিণত হন। সন্তানরা বড় হয়, বাবা-মা বার্ধক্যে পৌঁছায়, সংসার চলে তাঁদের ঘামে উপার্জিত টাকায়, কিন্তু সেই শ্রমিকরা নিজে থাকেন দূরে, এক অনন্ত নিঃসঙ্গতায়। প্রবাসজীবনের এই ত্যাগের মূল্য তাঁদের স্বাস্থ্য, মানসিক শান্তি ও ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে দিতে হয়।
এই ব্যবস্থায় শ্রমিকদের কোনো সুরক্ষা নেই। তাঁদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নিয়োগকর্তার হাতে। শোষণের শিকার হলেও অভিযোগ করার অধিকার নেই, কর্মস্থল বদলের সুযোগও নেই। এমন একতরফা নিয়ন্ত্রণ শ্রমিকদের মৌলিক মানবাধিকারকে চরমভাবে লঙ্ঘন করে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই কাফালা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু দেশ সীমিত সংস্কার করলেও এখনো বড় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলো শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বাস্তবতায় শ্রমিকদের কষ্ট কমেনি।
কাফালা ব্যবস্থা শুধু শ্রমিকদের অর্থনৈতিক শোষণ করে না, বরং তাঁদের মর্যাদা, স্বাধীনতা ও স্বপ্ন কেড়ে নেয়। যাঁরা রোদে-ঘামে পরিশ্রম করে বিদেশের অট্টালিকা গড়ে দেন, তাঁরা নিজের জীবন চালাতে গিয়ে বন্দি হয়ে পড়েন ঋণ, নির্যাতন আর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে।
লেখা: সারা সাদবিন
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস।
সারা সাদবিন 
























