- দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতিতে দেশিবিদেশি বিনিয়োগ খরা
- বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়
- দেশি উদ্যোক্তারাও নতুন প্রকল্পে হাত দিতে সাহস পাচ্ছেন না
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতিমালা, তলানিতে অর্থনীতি
- পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে।
অর্থনীতির খরা যেন কাটছেই না। টানা তিন বছর সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন আরও নাজুক। দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতি যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে দেশিবিদেশি বিনিয়োগ খরায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আপাতত পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়। আর দেশি উদ্যোক্তারাও নতুন প্রকল্পে হাত দিতে সাহস পাচ্ছেন না, ঝুঁকি নিচ্ছেন না। এরই মধ্যে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বহু শ্রমিক হয়েছেন বেকার। যেসব শিল্প টিকে আছে, সেগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বাড়তি দুশ্চিন্তা হচ্ছে, এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ-পরবর্তী প্রতিযোগিতার। তাদের শঙ্কা, তখন শুল্ক সুবিধা হারালে অনেক খাতই প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। এদিকে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে সংকুচিত হয়েছে। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়ার পাশাপাশি বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে আছে। স্বল্পন্নোত দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একবছর আগে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় নানা ধরনের অনিশ্চয়তা দেশের টেকসই অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের পথে গুরুতর বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) নিট এফডিআই ৮৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১৬ কোটি ডলার-অর্থাৎ ২৬% হ্রাস। বিশ্বব্যাংকের সহায়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশে পাঁচটি মূল বাধা চিহ্নিত করা হয়েছে : বিদ্যুৎ ঘাটতি, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিপত্য এবং উচ্চ করের বোঝা। বিনিয়োগ খরার প্রভাব কর্মসংস্থানে সরাসরি পড়ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারলে বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের সুযোগ তৈরি হতে পারে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। বড় উদ্যোক্তারা এ মুহূর্তে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী নন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, ঋণের উচ্চ সুদ আসলেই চিন্তার বিষয়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার এ সময়ে কেউ এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করার চিন্তা করবে না। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি এখনো পরিষ্কার হয়নি। সবমিলিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছেন। এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর তথ্যে দেখা গেছে, টানা দুই মাস ধরে কমেছে রপ্তানি আয়। সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ, ইউরোপে ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়া এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি- এই তিন কারণে রপ্তানি কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ না আসায়ও অনেক শিল্পকারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে রপ্তানি আয়ও কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
এদিকে, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২০২৪ সালের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে চলতি বছর ২১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছবে, যা কভিড-পরবর্তী সময় তথা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে দেশের শ্রমবাজারের দুর্বল চিত্র উঠে এসেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি নিরুৎসাহিত করছে। অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও সেগুলোর বাস্তব প্রভাব এখনো দেখা যায়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীরা কোনো আস্থা পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষা করছেন সবাই। তাদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের সীমাবদ্ধতা, উচ্চ সুদ, জ্বালানির ঘাটতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতিমালা অর্থনীতিকে তলানির দিকে ঠেলে দিয়েছে। উচ্চ সুদের হারও ব্যবসাবান্ধব নয়। সুদ এক অঙ্কে নামানো গেলে অন্তত নতুন বিনিয়োগের সাহস জাগতে পারে বলেও জানান তারা। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও নানা ধরনের ব্যাংকিং জটিলতার মুখে পড়ছে। অনেকে বলছেন, সময়মতো ঋণ বা এলসি অনুমোদন না মেলায় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ১৫-১৬ শতাংশ সুদ দিয়ে কি কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করার চিন্তা করবে? যেনেশুনে কেউ লোকসানের বোঝা নিতে চাইবে না। শিল্পকারখানাগুলো এখন রুগ্ন অবস্থায় আছে। অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট এখনো পুরোপুরি মিটছে না। ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন ব্যাংকিং। ব্যবসা জাহান্নামে যাক বা বন্ধ হয়ে যাক এতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ব্যবসায়ীদের নিঃশেষ করতে তারা নতুন নতুন সিস্টেম নিয়ে আসছে। ব্যাংক মালিকদের লুটপাটের ক্ষত দেশের ব্যবসায়ীরা বয়ে বেড়াচ্ছে। এস আলম গ্রুপ তাদের ব্যাংকগুলো থেকে যেভাবে টাকা লুটপাট করেছে, এতে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ব্যবসায়ীরা।


























