রাঙামাটির রাজস্থলীর চুশাক পাড়া—দূর-পাহাড়ের এক দুর্গম গ্রাম। সেখান থেকেই উঠে এসে আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিসে নতুন ইতিহাস গড়েছেন খই খই সাই মারমা। ১৮ বছর বয়সেই তিনি দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে পদক এনে বাংলাদেশকে নতুন গৌরব দিলেন। সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে মিশ্র দ্বৈতে রূপা জিতে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিরল এক সাফল্য সৃষ্টি করেছেন তিনি।
কৃষক পরিবারের সন্তান খই খইয়ের জীবনপথ কখনোই সহজ ছিল না। রাঙামাটি সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে রাজস্থলী উপজেলা—অন্যতম দুর্গম এলাকা। নতুন সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হলেও এখনো অনেক কিলোমিটার রাস্তা ভাঙাচোরা ও ঝুঁকিপূর্ণ। সেই এলাকাতেই মাচাংঘর-বেষ্টিত চুশাক পাড়া। অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠা এই মেয়েটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন মায়ের হাত ধরে বান্দরবানের লামায় কোয়ান্টামে ভর্তি হয়। সেখান থেকেই শুরু তার টেবিল টেনিস জীবনের প্রথম অধ্যায়।

কোয়ান্টামে খেলাধুলার বিস্তৃত সুযোগ ছিল, আর সেখানকার ম্যাডামদের জোরাজুরিতে খই খই প্রথম টেবিল টেনিস হাতে নেয়। খুব অল্প সময়েই তাঁর প্রতিভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইন্টার স্কুলসহ ঢাকার বেশ কিছু টুর্নামেন্টে নজর কাড়েন তিনি। অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়া, সিনিয়রে কোয়ার্টার পর্যন্ত খেলা, ফেডারেশন কাপে শিরোপা জেতা—সব মিলিয়ে অল্প বয়সেই তিনি দেশের সেরা খেলোয়াড়দের কাতারে জায়গা করে নেন। বর্তমানে মেয়েদের র্যাংকিংয়ে তিনি দ্বিতীয়।

২০২০ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় কোয়ান্টাম থেকে হাসান মুনীম সুমনের হাত ধরে জাতীয় ফেডারেশনে ক্যাম্পে যোগ দেন খই খই। এরপরই তার উন্নতির গতিপথ দ্রুত উর্ধ্বমুখী হয়। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয়। প্রথম বছর তেমন সাফল্য না পেলেও পরের বছর ভারতের দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ইয়ুথ সিঙ্গেলসে ব্রোঞ্জ, শ্রীলঙ্কায় মিশ্র দ্বৈতে ব্রোঞ্জসহ একের পর এক অর্জন তাকে জাতীয় টেবিল টেনিসে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ২০২৩ সালে কোরিয়াতে নিজের প্রথম এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন। চলতি বছর নেপালের দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে জিতেছেন আরও দুইটি ব্রোঞ্জ।
সবশেষে সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চমক হয়ে ওঠেন তিনি। সিঙ্গেলস ও ডাবলসে না পারলেও মিক্সড ডাবলসে দুর্দান্ত লড়াই করে প্রথমে আফ্রিকার গায়েনার বিরুদ্ধে ৩-২ ব্যবধানে জিতেন। এরপর মালদ্বীপকে হারিয়ে নিশ্চিত করেন ব্রোঞ্জ। সেমিফাইনালে বাহরাইনকে হারিয়ে ওঠেন ফাইনালে। ফাইনালে শক্তিশালী তুরস্কের কাছে হেরে গেলেও রূপা জিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনায় সক্ষম হন খই খই।

বিকেএসপির উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খই খই জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা—“আরও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলে এবং জাতীয় দলে স্থায়ী বিদেশি কোচ থাকলে বাংলাদেশ টেবিল টেনিসে আরও ভালো করবে। আমি চাই একদিন অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে।”
কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি তিনি—কোয়ান্টাম, কোচ, ফেডারেশন, বিকেএসপি ও সেনাবাহিনীসহ সকলের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তবে একটি আক্ষেপও রয়েছে—নিজ গ্রামে যেতে হলে এখনও কঠিন ভাঙাচোরা রাস্তা পেরোতে হয়। দ্রুত রাস্তার উন্নয়ন হয়েছে দেখার আশা তাঁর।
কৃষক কন্যার এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তাঁর পরিবার ও গ্রামের মানুষ। মা মোহ্লাচিং মারমা বলেন, “আমার মেয়েকে যারা সহযোগিতা করেছেন, সবার জন্য দোয়া ও ধন্যবাদ।” বড় বোন হ্লাহ্লাউ মারমা বলেন, “আমার বোন দেশকে আর আদিবাসী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করছে—এটাই আমাদের গর্ব।”

এলাকার কার্বারি উনুমং মারমা জানান, “অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হওয়া খই খইয়ের এই সাফল্যে আমরা সবাই গর্বিত। গ্রামবাসী তাকে সংবর্ধনা দেবে। তার আরও সাফল্য কামনা করি।”
দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের এই কিশোরী এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের আলো। খই খইয়ের সাফল্য শুধু তার নিজের নয়—এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর, রাঙামাটির এবং পুরো বাংলাদেশের গৌরব।
এমআর/সবা


























