০১:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গ্যাসের ৯৫৫ কোটি টাকা ইউনাইটেড গ্রুপের পেটে

 

  • উচ্চ আদালতে হারার পরও পাওনা পরিশোধ করছে না ইউনাইটেড পাওয়ার
  • শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিলেও ক্যাপটিভ রেটে গ্যাসের মূল্য দিতে অনীহা
  • তিন ইপিজেডে বিকল্প ব্যবস্থা করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের
  • তিতাস গ্যাস ব্যবস্থা নিলেও অদৃশ্য কারণে নিশ্চুপ কেজিডিসিএল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটা বড় নাম ইউনাইটেড গ্রুপ। চট্টগ্রাম ও ঢাকার তিন ইপিজেডে নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তারা। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে দুই ইপিজেডে প্রতিষ্ঠা করে গ্যাসনির্ভর দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করলেও সরকার নির্ধারিত ক্যাপটিভ রেটে গ্যাসের মূল্য দিতে অনীহা ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ইউপিজিডি)। দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তিতাস (টিজিটিডিএল) ও কর্ণফুলী গ্যাসের (কেজিডিসিএল) সরবরাহ করা গ্যাসের ৯৫৫ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা এই গ্রুপের পেটে থাকলেও তা আদায় করতে পারছে না তিতাস ও কর্ণফুলী। অন্যদিকে বকেয়া আদায় না হওয়ায় ইতোমধ্যে তিন ইপিজেডের কারখানাগুলোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থায় পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করে ইউনাইটেড পাওয়ারের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ডিইপিজেডে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে টিজিটিডিএল ব্যবস্থা নিলেও অদৃশ্য কারণে নিশ্চুপ কেজিডিসিএল।
পিডিবি, ইউপিজিডি, পেট্রোবাংলা, টিজিটিডিএল ও কেজিডিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ডিইপিজেডে ৩৫ মেগাওয়াট ও ২০০৯ সালের আগস্টে সিইপিজেডে ৪৪ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার আলাদা দুটি বিদ্যুৎ প¬্যান্ট নির্মাণ করে ইউনাইটেড গ্রুপ। দুই প¬্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রথমে ডিইপিজেড ও সিইপিজেডের কারখানাগুলোর পাশাপাশি জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে পিডিবিকে সরবরাহ করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ডিইপিজেডের প¬্যান্টে তিতাস গ্যাস ও সিইপিজেডের প¬্যান্টে কেজিডিসিএল গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। শিল্প গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করলেও সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্য আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প¬্যান্ট) রেটে পরিশোধ করে ইউনাইটেড পাওয়ার। এর মধ্যে গত সরকারের আমলে পাওয়ার প¬্যান্ট দুটির ব্যাপ্তি বাড়িয়ে বর্তমানে ডিইপিজেডের প¬্যান্টটি থেকে ৮৬ মেগাওয়াট ও সিইপিজেডের প¬্যান্টটি থেকে ৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ডিইপিজেডের প¬্যান্ট থেকে ডিইপিজেড, পিডিবি, বিআরইবির পাশাপাশি বাইরের শিল্প গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ইউপিজিডি। সিইপিজেড প¬্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সিইপিজেড, সংলগ্ন কর্ণফুলী ইপিজেড ও পিডিবিকে সরবরাহ করা হয়।
মূলত সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি), বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (সিওপিপি) এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে আলাদা রেটে গ্যাস সরবরাহ করে পেট্রোবাংলার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে আইপিপিগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে পিডিবিকে সরবরাহ করে। অন্যদিকে ক্যাপটিভ পাওয়ার মূলত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব উদ্যোগ ও বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত। ক্যাপটিভ পাওয়ার শ্রেণির বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ নিজেদের কারখানায় ব্যবহার করে। এজন্য আইপিপির চেয়ে ক্যাপটিভ পাওয়ারে সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্য তুলনামূলক বেশি থাকে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া আইপিপিগুলোতে গ্যাসের মূল্য প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা। ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারির আগে এ রেট ছিল ১৪ টাকা। একইভাবে পুরোনো ক্যাপটিভ পাওয়ারগুলোতে বর্তমানে গ্যাসের রেট প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা। প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট থাকায় বর্তমানে এলএনজি আমদানি করে গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ দেয় পেট্রোবাংলা।
গত ১৯ জুন কেজিডিসিএলের ২৩৩তম বোর্ডসভায় আলোচনার একটি গোপনীয় নোট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে আইপিপি রেটে গ্যাসের দাম দিয়ে এলেও ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে পিডিবি ও বিআরইবিকে সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মূল্য আইপিপি রেটে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মূল্য ক্যাপটিভ পাওয়ার রেটে আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে ২০১৯ সালের ২৯ মে ইউনাইটেড পাওয়ারকে গ্যাসের নতুন রেটে ডিমান্ড লেটার ইস্যু করে কেজিডিসিএল। ওই ডিমান্ড লেটারে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে দেওয়া বিদ্যুতের জন্য আইপিপি ও ইপিজেড দুটিতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মূল্য ক্যাপটিভ পাওয়ার রেটে বিল করা হয়। ওই ডিমান্ড লেটারকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় ইউনাইটেড পাওয়ার। ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর ওই রিট খারিজ করেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের ওই আদেশের স্থগিতাদেশের আবেদন করা হলে আপিল বিভাগ খারিজ করে দেন। এরপর একই বিষয়ে সিভিল রিভিউ পিটিশন দাখিল করলে সবশেষ ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন।
আরো জানা গেছে, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ তারিখের চিঠির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনাইটেড পাওয়ারের মালিকানাধীন ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বিইআরসি ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর পরবর্তীসময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (সিওপিপি) হিসেবে লাইসেন্স দিয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত অবশিষ্ট অপরিশোধিত ৪২৫ কোটি ৮০ হাজার ৮২৯ টাকা পরিশোধের জন্য গত ২৯ মে এবং ১৮ জুন দুটি চিঠি দেওয়া হয় ইউনাইটেড পাওয়ারকে। কিন্তু গ্রাহক (ইউনাইটেড পাওয়ার) অদ্যাবধি বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেননি। ওই সভায় ইউনাইটেড পাওয়ারের সিইপিজেড প¬্যান্টের গ্যাস সরবরাহ বন্ধের অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২০২৫ সালের ১৮ জুন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যাপটিভ রেটে বকেয়া বিল আদায় ও চুক্তি সংশোধনের জন্য সিইপিজেড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পর ডিইপিজেডে ইউনাইটেড পাওয়ারে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তিতাস। এরপর দাবি করা পাওনার মধ্যে ৫০ কোটি টাকা পরিশোধও করে ইউনাইটেড পাওয়ার।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের পাওয়ার ডিভিশনের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স মো. শামীম মিয়া বলেন, ডিইপিজেড ও সিইপিজেডে আমাদের প¬্যান্টগুলো আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প¬্যান্ট)। কর্ণফুলী গ্যাস কিংবা তিতাসের সঙ্গে আমাদের চুক্তিও আইপিপি হিসেবে। ওই চুক্তি এখনো বলবৎ। চুক্তি অনুযায়ী আমরা এখনো আইপিপি রেটে গ্যাসের দাম পরিশোধ করে আসছি তিতাস ও কর্ণফুলী গ্যাসকে। চুক্তি অনুযায়ী আমাদের কোনো বকেয়া নেই। আমাদের চুক্তিতে ক্যাপটিভ রেটের কথা উলে¬খ নেই। তিতাস ও কর্ণফুলী গ্যাস থেকে ক্যাপটিভ রেট হিসেবে আমাদের যে ডিমান্ড ইস্যু করা হয়েছে, সেখানেও চুক্তি সংশোধনের কথা বলা। এখনো তো চুক্তি সংশোধন হয়নি।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন-দক্ষিণ) প্রকৌশলী মু. রইস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউনাইটেড পাওয়ারের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর মধ্যে ইউনাইটেড পাওয়ারের বকেয়া পাওনা পরিশোধ না হলে তাদের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সিইপিজেডে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

গ্যাসের ৯৫৫ কোটি টাকা ইউনাইটেড গ্রুপের পেটে

আপডেট সময় : ০৭:১৫:০৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

 

  • উচ্চ আদালতে হারার পরও পাওনা পরিশোধ করছে না ইউনাইটেড পাওয়ার
  • শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিলেও ক্যাপটিভ রেটে গ্যাসের মূল্য দিতে অনীহা
  • তিন ইপিজেডে বিকল্প ব্যবস্থা করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের
  • তিতাস গ্যাস ব্যবস্থা নিলেও অদৃশ্য কারণে নিশ্চুপ কেজিডিসিএল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটা বড় নাম ইউনাইটেড গ্রুপ। চট্টগ্রাম ও ঢাকার তিন ইপিজেডে নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তারা। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে দুই ইপিজেডে প্রতিষ্ঠা করে গ্যাসনির্ভর দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করলেও সরকার নির্ধারিত ক্যাপটিভ রেটে গ্যাসের মূল্য দিতে অনীহা ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ইউপিজিডি)। দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তিতাস (টিজিটিডিএল) ও কর্ণফুলী গ্যাসের (কেজিডিসিএল) সরবরাহ করা গ্যাসের ৯৫৫ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা এই গ্রুপের পেটে থাকলেও তা আদায় করতে পারছে না তিতাস ও কর্ণফুলী। অন্যদিকে বকেয়া আদায় না হওয়ায় ইতোমধ্যে তিন ইপিজেডের কারখানাগুলোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থায় পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করে ইউনাইটেড পাওয়ারের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ডিইপিজেডে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে টিজিটিডিএল ব্যবস্থা নিলেও অদৃশ্য কারণে নিশ্চুপ কেজিডিসিএল।
পিডিবি, ইউপিজিডি, পেট্রোবাংলা, টিজিটিডিএল ও কেজিডিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ডিইপিজেডে ৩৫ মেগাওয়াট ও ২০০৯ সালের আগস্টে সিইপিজেডে ৪৪ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার আলাদা দুটি বিদ্যুৎ প¬্যান্ট নির্মাণ করে ইউনাইটেড গ্রুপ। দুই প¬্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রথমে ডিইপিজেড ও সিইপিজেডের কারখানাগুলোর পাশাপাশি জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে পিডিবিকে সরবরাহ করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ডিইপিজেডের প¬্যান্টে তিতাস গ্যাস ও সিইপিজেডের প¬্যান্টে কেজিডিসিএল গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। শিল্প গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করলেও সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্য আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প¬্যান্ট) রেটে পরিশোধ করে ইউনাইটেড পাওয়ার। এর মধ্যে গত সরকারের আমলে পাওয়ার প¬্যান্ট দুটির ব্যাপ্তি বাড়িয়ে বর্তমানে ডিইপিজেডের প¬্যান্টটি থেকে ৮৬ মেগাওয়াট ও সিইপিজেডের প¬্যান্টটি থেকে ৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ডিইপিজেডের প¬্যান্ট থেকে ডিইপিজেড, পিডিবি, বিআরইবির পাশাপাশি বাইরের শিল্প গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ইউপিজিডি। সিইপিজেড প¬্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সিইপিজেড, সংলগ্ন কর্ণফুলী ইপিজেড ও পিডিবিকে সরবরাহ করা হয়।
মূলত সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি), বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (সিওপিপি) এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে আলাদা রেটে গ্যাস সরবরাহ করে পেট্রোবাংলার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে আইপিপিগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে পিডিবিকে সরবরাহ করে। অন্যদিকে ক্যাপটিভ পাওয়ার মূলত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব উদ্যোগ ও বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত। ক্যাপটিভ পাওয়ার শ্রেণির বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ নিজেদের কারখানায় ব্যবহার করে। এজন্য আইপিপির চেয়ে ক্যাপটিভ পাওয়ারে সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্য তুলনামূলক বেশি থাকে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া আইপিপিগুলোতে গ্যাসের মূল্য প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা। ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারির আগে এ রেট ছিল ১৪ টাকা। একইভাবে পুরোনো ক্যাপটিভ পাওয়ারগুলোতে বর্তমানে গ্যাসের রেট প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা। প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট থাকায় বর্তমানে এলএনজি আমদানি করে গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ দেয় পেট্রোবাংলা।
গত ১৯ জুন কেজিডিসিএলের ২৩৩তম বোর্ডসভায় আলোচনার একটি গোপনীয় নোট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে আইপিপি রেটে গ্যাসের দাম দিয়ে এলেও ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে পিডিবি ও বিআরইবিকে সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মূল্য আইপিপি রেটে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মূল্য ক্যাপটিভ পাওয়ার রেটে আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে ২০১৯ সালের ২৯ মে ইউনাইটেড পাওয়ারকে গ্যাসের নতুন রেটে ডিমান্ড লেটার ইস্যু করে কেজিডিসিএল। ওই ডিমান্ড লেটারে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে দেওয়া বিদ্যুতের জন্য আইপিপি ও ইপিজেড দুটিতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মূল্য ক্যাপটিভ পাওয়ার রেটে বিল করা হয়। ওই ডিমান্ড লেটারকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় ইউনাইটেড পাওয়ার। ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর ওই রিট খারিজ করেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের ওই আদেশের স্থগিতাদেশের আবেদন করা হলে আপিল বিভাগ খারিজ করে দেন। এরপর একই বিষয়ে সিভিল রিভিউ পিটিশন দাখিল করলে সবশেষ ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন।
আরো জানা গেছে, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ তারিখের চিঠির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনাইটেড পাওয়ারের মালিকানাধীন ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বিইআরসি ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর পরবর্তীসময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (সিওপিপি) হিসেবে লাইসেন্স দিয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত অবশিষ্ট অপরিশোধিত ৪২৫ কোটি ৮০ হাজার ৮২৯ টাকা পরিশোধের জন্য গত ২৯ মে এবং ১৮ জুন দুটি চিঠি দেওয়া হয় ইউনাইটেড পাওয়ারকে। কিন্তু গ্রাহক (ইউনাইটেড পাওয়ার) অদ্যাবধি বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেননি। ওই সভায় ইউনাইটেড পাওয়ারের সিইপিজেড প¬্যান্টের গ্যাস সরবরাহ বন্ধের অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২০২৫ সালের ১৮ জুন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যাপটিভ রেটে বকেয়া বিল আদায় ও চুক্তি সংশোধনের জন্য সিইপিজেড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পর ডিইপিজেডে ইউনাইটেড পাওয়ারে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তিতাস। এরপর দাবি করা পাওনার মধ্যে ৫০ কোটি টাকা পরিশোধও করে ইউনাইটেড পাওয়ার।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের পাওয়ার ডিভিশনের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স মো. শামীম মিয়া বলেন, ডিইপিজেড ও সিইপিজেডে আমাদের প¬্যান্টগুলো আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প¬্যান্ট)। কর্ণফুলী গ্যাস কিংবা তিতাসের সঙ্গে আমাদের চুক্তিও আইপিপি হিসেবে। ওই চুক্তি এখনো বলবৎ। চুক্তি অনুযায়ী আমরা এখনো আইপিপি রেটে গ্যাসের দাম পরিশোধ করে আসছি তিতাস ও কর্ণফুলী গ্যাসকে। চুক্তি অনুযায়ী আমাদের কোনো বকেয়া নেই। আমাদের চুক্তিতে ক্যাপটিভ রেটের কথা উলে¬খ নেই। তিতাস ও কর্ণফুলী গ্যাস থেকে ক্যাপটিভ রেট হিসেবে আমাদের যে ডিমান্ড ইস্যু করা হয়েছে, সেখানেও চুক্তি সংশোধনের কথা বলা। এখনো তো চুক্তি সংশোধন হয়নি।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন-দক্ষিণ) প্রকৌশলী মু. রইস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউনাইটেড পাওয়ারের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর মধ্যে ইউনাইটেড পাওয়ারের বকেয়া পাওনা পরিশোধ না হলে তাদের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সিইপিজেডে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।