০১:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আবু সাঈদ একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের অমর নায়ক

পীরগঞ্জের মেঠো পথ ধরে যে ছেলেটির বেড়ে ওঠা, যার চোখে ছিল ইংরেজি সাহিত্যের অপার বিস্ময়, সে হয়তো কখনো ভাবেনি তার নিজের জীবনটাই হয়ে উঠবে জাতির ইতিহাসের এক অলিখিত মহাকাব্য। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের সেই টগবগে তরুণ আবু সাঈদের স্বপ্ন ছিল শব্দ দিয়ে জগৎ গড়ার। কে জানতো, তার নিঃশব্দ আত্মত্যাগই হয়ে উঠবে একটি গণজাগরণের সবচেয়ে শক্তিশালী শব্দ?
সময়টা ছিল ২০২৪ সালের জুলাই। কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’। এটি কোনো দলীয় বা সহিংস আন্দোলন ছিল না, ছিল মেধা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তরুণ প্রজন্মের এক শান্তিপূর্ণ আকুতি। আবু সাঈদ ছিলেন সেই অহিংস স্রোতেরই একজন। সহপাঠীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, বিভাগের ক্লাস শেষে, টিউশন শেষে কিংবা লাইব্রেরির পড়ার ফাঁকে তিনি যোগ দিতেন এই যৌক্তিক দাবিতে। তাঁর শান্ত স্বভাব আর স্থির দৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক দৃঢ় প্রত্যয়।
দিনটা ছিল ১৬ই জুলাই। রংপুরের রাজপথ সেদিন হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর। মিছিলে হাঁটার সময় আবু সাঈদের মনে হয়তো কাজ করছিল শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডির কোনো চরিত্র, অথবা ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাওয়া মুক্তির আনন্দ। কিন্তু বাস্তব সেদিন ছিল কল্পনার চেয়েও নিষ্ঠুর। যৌক্তিক দাবির জবাবে যখন নেমে এলো রাষ্ট্রীয় শক্তির সহিংসতা, তখন মুহূর্তেই বদলে গেল সব। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়া গুলির শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল স্বপ্নের মিছিল।
সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই, আদর্শকে বুকে ধারন করে দুহাত প্রসারিত করে রেখে সহযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আবু সাঈদ। একটি বুলেট এসে যখন তাঁর বুক বিদ্ধ করলো, তখন শুধু একটি দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েনি, লুটিয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রের প্রতি একজন তরুণের বিশ্বাস। তাঁর রক্তে ভেজা মায়ার চেহারা আর কালো টিশার্টের সেই স্থিরচিত্রটি আধুনিক প্রযুক্তির ডানায় ভর করে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছবিটি হয়ে উঠল এই আন্দোলনের অঘোষিত পোস্টার, আর আবু সাঈদ হয়ে গেলেন প্রতিবাদের অমর প্রতীক।
তাঁর মৃত্যু ছিল সেই স্ফুলিঙ্গ, যা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। যে তরুণেরা এতদিন দ্বিধায় ছিলেন, তারাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। আবু সাঈদের মৃত্যু তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, এটি আর কেবল কোটা সংস্কারের দাবি নয়, এটি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ‘আমার ভাই মরলো কেন?’—এই প্রশ্নটি আর কোনো সাধারণ স্লোগান রইল না, এটি হয়ে উঠল কোটি তরুণের বুকে জমা হওয়া ক্ষোভ ও যন্ত্রণার সম্মিলিত হুংকার।
আবু সাঈদ ছিলেন ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র প্রথম শহীদ। এই ‘প্রথম’ শব্দটিই তাকে ইতিহাসের এক বিশেষ মর্যাদায় আসীন করেছে। যেমনটা করেছিল ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ। প্রথম শহীদের রক্ত একটি আন্দোলনকে নৈতিকভাবে পবিত্র করে তোলে, তাকে আর কোনো শক্তি দিয়েই দমন করা যায় না।
আজ যখন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, তখন সেই অধ্যায়ের প্রথম পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে পীরগঞ্জের সেই তরুণের নাম—আবু সাঈদ। ইংরেজি সাহিত্যের যে ছাত্রটি হয়তো একটি কালজয়ী উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন, তিনি তার জীবন দিয়ে এমন এক বাস্তবতার জন্ম দিয়ে গেলেন, যা ছাপিয়ে গেছে যেকোনো কল্পনার উপন্যাসকে। তিনি আজ আর ব্যক্তি নন, তিনি একটি চেতনার বাতিঘর, যে বাতিঘর আগামী প্রজন্মকে দেখাবে সাহস ও আত্মত্যাগের পথ।
এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

আবু সাঈদ একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের অমর নায়ক

আপডেট সময় : ০৮:৫৬:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

পীরগঞ্জের মেঠো পথ ধরে যে ছেলেটির বেড়ে ওঠা, যার চোখে ছিল ইংরেজি সাহিত্যের অপার বিস্ময়, সে হয়তো কখনো ভাবেনি তার নিজের জীবনটাই হয়ে উঠবে জাতির ইতিহাসের এক অলিখিত মহাকাব্য। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের সেই টগবগে তরুণ আবু সাঈদের স্বপ্ন ছিল শব্দ দিয়ে জগৎ গড়ার। কে জানতো, তার নিঃশব্দ আত্মত্যাগই হয়ে উঠবে একটি গণজাগরণের সবচেয়ে শক্তিশালী শব্দ?
সময়টা ছিল ২০২৪ সালের জুলাই। কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’। এটি কোনো দলীয় বা সহিংস আন্দোলন ছিল না, ছিল মেধা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তরুণ প্রজন্মের এক শান্তিপূর্ণ আকুতি। আবু সাঈদ ছিলেন সেই অহিংস স্রোতেরই একজন। সহপাঠীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, বিভাগের ক্লাস শেষে, টিউশন শেষে কিংবা লাইব্রেরির পড়ার ফাঁকে তিনি যোগ দিতেন এই যৌক্তিক দাবিতে। তাঁর শান্ত স্বভাব আর স্থির দৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক দৃঢ় প্রত্যয়।
দিনটা ছিল ১৬ই জুলাই। রংপুরের রাজপথ সেদিন হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর। মিছিলে হাঁটার সময় আবু সাঈদের মনে হয়তো কাজ করছিল শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডির কোনো চরিত্র, অথবা ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাওয়া মুক্তির আনন্দ। কিন্তু বাস্তব সেদিন ছিল কল্পনার চেয়েও নিষ্ঠুর। যৌক্তিক দাবির জবাবে যখন নেমে এলো রাষ্ট্রীয় শক্তির সহিংসতা, তখন মুহূর্তেই বদলে গেল সব। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়া গুলির শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল স্বপ্নের মিছিল।
সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই, আদর্শকে বুকে ধারন করে দুহাত প্রসারিত করে রেখে সহযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আবু সাঈদ। একটি বুলেট এসে যখন তাঁর বুক বিদ্ধ করলো, তখন শুধু একটি দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েনি, লুটিয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রের প্রতি একজন তরুণের বিশ্বাস। তাঁর রক্তে ভেজা মায়ার চেহারা আর কালো টিশার্টের সেই স্থিরচিত্রটি আধুনিক প্রযুক্তির ডানায় ভর করে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছবিটি হয়ে উঠল এই আন্দোলনের অঘোষিত পোস্টার, আর আবু সাঈদ হয়ে গেলেন প্রতিবাদের অমর প্রতীক।
তাঁর মৃত্যু ছিল সেই স্ফুলিঙ্গ, যা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। যে তরুণেরা এতদিন দ্বিধায় ছিলেন, তারাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। আবু সাঈদের মৃত্যু তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, এটি আর কেবল কোটা সংস্কারের দাবি নয়, এটি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ‘আমার ভাই মরলো কেন?’—এই প্রশ্নটি আর কোনো সাধারণ স্লোগান রইল না, এটি হয়ে উঠল কোটি তরুণের বুকে জমা হওয়া ক্ষোভ ও যন্ত্রণার সম্মিলিত হুংকার।
আবু সাঈদ ছিলেন ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র প্রথম শহীদ। এই ‘প্রথম’ শব্দটিই তাকে ইতিহাসের এক বিশেষ মর্যাদায় আসীন করেছে। যেমনটা করেছিল ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ। প্রথম শহীদের রক্ত একটি আন্দোলনকে নৈতিকভাবে পবিত্র করে তোলে, তাকে আর কোনো শক্তি দিয়েই দমন করা যায় না।
আজ যখন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, তখন সেই অধ্যায়ের প্রথম পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে পীরগঞ্জের সেই তরুণের নাম—আবু সাঈদ। ইংরেজি সাহিত্যের যে ছাত্রটি হয়তো একটি কালজয়ী উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন, তিনি তার জীবন দিয়ে এমন এক বাস্তবতার জন্ম দিয়ে গেলেন, যা ছাপিয়ে গেছে যেকোনো কল্পনার উপন্যাসকে। তিনি আজ আর ব্যক্তি নন, তিনি একটি চেতনার বাতিঘর, যে বাতিঘর আগামী প্রজন্মকে দেখাবে সাহস ও আত্মত্যাগের পথ।
এমআর/সবা