১০:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজউক: এখনও অধরা হাজার কোটি টাকার প্লট খেকোরা

  • সুযোগ পেয়ে সবাই বাগিয়ে নিয়েছিলেন প্লট-ফ্ল্যাট
  •  বিতর্কিতদের বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ দেয়া হয় প্লট
  • এখনও সে সব প্লট বাতিল করেনি রাজউক

‘সরকারের সন্তোষভাজন আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্লট দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু যে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে তা নয় বরং নগর পরিকল্পনায়ও নগ্ন হস্তক্ষেপ হয়েছে। জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে’- অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, নগর পরিকল্পনাবিদ

‘হাইকোর্ট একটি হাইপাওয়ার তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। এটা নিয়ে কাজ চলছে। যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে’- ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, রাজউক

বিভিন্ন সময়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এ তালিকায় উঠে আসে প্রভাবশালী আমলা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বেশকিছু গণমাধ্যম কর্মীর নাম; যারা মূলত ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্পে তারা পান প্লট কিংবা ফ্ল্যাট বরাদ্দ। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এসব সম্পদের বরাদ্দ বাতিলের দাবি ওঠে। কিন্তু এক বছর হতে চললেও বাতিল করা হয়নি বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ পাওয়া বিতর্কিতদের প্লট। এখনও অধরা রয়ে গেছেন এই প্লট খেকোরা। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, সরকারের সন্তোষভাজন আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্লট দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু যে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে তা নয় বরং নগর পরিকল্পনায়ও নগ্ন হস্তক্ষেপ হয়েছে। জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এদিকে রাজউক বলছে, হাইকোর্ট একটি হাইপাওয়ার তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। এটা নিয়ে কাজ চলছে। যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
জানা গেছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আইন সংশোধন হয় ১৯৮৬ সালে। নতুন আইনে বলা হয়, ‘সরকার যাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তাকেই প্লট বরাদ্দ দিতে পারবে।’ ওই ধারাটির মাধ্যমে সরকারি আবাসন প্রকল্পগুলো হয়ে ওঠে ক্ষমতাবলয়ের কাছের লোকদের সুবিধা দেয়ার হাতিয়ার। রাজনৈতিক বিশে¬ষকরা বলছেন, স্বৈরশাসক তার শাসন টিকিয়ে রাখতে বরাবরই আমলা, রাজনীতিবিদসহ সমাজের প্রতাপশালী ও প্রশাসনিক ক্ষমতাধরদের ওপর বেশি নির্ভর করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, প্রশাসন, রাজনীতিবিদসহ সংশি¬ষ্ট বিভিন্ন পক্ষের নানা ব্যক্তির সমর্থনেরও প্রয়োজন পড়েছে। এ সমর্থনের বিনিময়ে এসব মানুষকে সম্পদ বাড়ানোর পথ প্রশস্ত করে দেয়া হয় নানাভাবে। পাশাপাশি উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হয় নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা। গত সরকারের আমলেও রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত আবাসিক এলাকা ও সরকারি প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন বিচার বিভাগ সংশি¬ষ্ট ব্যক্তি, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, চলচ্চিত্র শিল্পীসহ সরকারঘনিষ্ঠ বিভিন্ন ব্যক্তি।
এদিকে রাজউকের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প পূর্বাচল। মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন চাহিদা মেটাতে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল। যদিও পূর্বাচলের এ জমি সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারাই। প্রথম পর্যায়ের লটারির মাধ্যমে তাদের ১ হাজার ৬৩২টি প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিজীবীদের ৬৫৪, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি কোটায় ৪৭২, বেসরকারি চাকরিজীবীদের ৫৯১, প্রবাসী কোটায় ৫৯১, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২৯৬, সচিব কোটায় ২৪, আইনজীবী কোটায় ১১০, বিচারপতি কোটায় ১৪, সংসদ সদস্য কোটায় ৫৭, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোটায় ৫৭, অন্যান্য কোটায় ১৮১, শিল্পী কোটায় ১৫১ ও সাংবাদিক কোটায় ৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। রাজউক কর্মকর্তা, সংরক্ষিত ও প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যও দেয়া হয় প্লট বরাদ্দ। লটারির পরও বিভিন্ন সময় পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী।
এদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচল নতুন শহরে জমি বরাদ্দ নেয়ার অভিযোগে ১৬ জনকে আসামি করে গত জানুয়ারিতে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পাশাপাশি জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল¬া খন্দকারকেও আসামি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজউকের প্লট বরাদ্দে যত অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো তদন্ত করতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৪ অক্টোবর রুলসহ এ বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। ১২০ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মতো কেরানীগঞ্জে রাজউকের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পেও ‘অনুগত ও তোষামোদকারীদের’ মূল্যবান প্লট দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারি চাকরি, জনসেবা ও সমজাতীয় খাতে জাতীয়ভাবে ‘অসামান্য অবদানের’ নামে ঝিলমিলে দেয়া হয় দুই শতাধিক প্লট।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার বলেন,‘গুলশান-বনানী থেকে শুরু করে পরিকল্পিত যত আবাসিক এলাকা ছিল, সবগুলোয় দেখা যাবে মনঃপুত ব্যক্তিকে প্লট দিয়েছে সরকার। আর সেটি করতে গিয়ে প¬্যানের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক বরাদ্দ শুধু যে স্বৈরাচার সরকারকে টিকিয়ে রাখে কেবল তা নয়, একটি নগরীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। যার ভুক্তভোগী ওই নগরীতে বসবাস করা প্রতিটি নাগরিক। এ ধরনের বরাদ্দের উদাহরণ আগেও ছিল। যারাই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ পেয়েছে তাদের প্লট বাতিল করার পাশাপাশি যারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প¬্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে দামি হলো জমি। সরকার কারো কর্মে খুশি হলে তাকে পদ-পদবিসহ জমিও উপহার দেয়। এজন্য আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে রাজউক ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। গত এক বছরে শেখ হাসিনা সরকারের পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্লট বরাদ্দ বাতিল না হওয়া প্রমাণ করে এ সরকার জুলাই চেতনা ধারণ করে না। এসব অবৈধভাবে দেয়া বরাদ্দ বাতিল করার দাবি ছিল জনগণের। অন্তর্র্বর্তী সরকার এটা বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারেনি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ চলমান। হাইকোর্ট একটি হাইপাওয়ার তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। সেখানে একজন সাবেক সচিব, তার সঙ্গে বাইরের একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং আমাদের একজন সদস্য (প্রশাসন) আছেন। তারা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

রাজউক: এখনও অধরা হাজার কোটি টাকার প্লট খেকোরা

আপডেট সময় : ০৭:৪০:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫
  • সুযোগ পেয়ে সবাই বাগিয়ে নিয়েছিলেন প্লট-ফ্ল্যাট
  •  বিতর্কিতদের বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ দেয়া হয় প্লট
  • এখনও সে সব প্লট বাতিল করেনি রাজউক

‘সরকারের সন্তোষভাজন আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্লট দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু যে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে তা নয় বরং নগর পরিকল্পনায়ও নগ্ন হস্তক্ষেপ হয়েছে। জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে’- অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, নগর পরিকল্পনাবিদ

‘হাইকোর্ট একটি হাইপাওয়ার তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। এটা নিয়ে কাজ চলছে। যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে’- ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, রাজউক

বিভিন্ন সময়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এ তালিকায় উঠে আসে প্রভাবশালী আমলা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বেশকিছু গণমাধ্যম কর্মীর নাম; যারা মূলত ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্পে তারা পান প্লট কিংবা ফ্ল্যাট বরাদ্দ। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এসব সম্পদের বরাদ্দ বাতিলের দাবি ওঠে। কিন্তু এক বছর হতে চললেও বাতিল করা হয়নি বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ পাওয়া বিতর্কিতদের প্লট। এখনও অধরা রয়ে গেছেন এই প্লট খেকোরা। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, সরকারের সন্তোষভাজন আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্লট দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু যে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে তা নয় বরং নগর পরিকল্পনায়ও নগ্ন হস্তক্ষেপ হয়েছে। জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এদিকে রাজউক বলছে, হাইকোর্ট একটি হাইপাওয়ার তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। এটা নিয়ে কাজ চলছে। যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
জানা গেছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আইন সংশোধন হয় ১৯৮৬ সালে। নতুন আইনে বলা হয়, ‘সরকার যাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তাকেই প্লট বরাদ্দ দিতে পারবে।’ ওই ধারাটির মাধ্যমে সরকারি আবাসন প্রকল্পগুলো হয়ে ওঠে ক্ষমতাবলয়ের কাছের লোকদের সুবিধা দেয়ার হাতিয়ার। রাজনৈতিক বিশে¬ষকরা বলছেন, স্বৈরশাসক তার শাসন টিকিয়ে রাখতে বরাবরই আমলা, রাজনীতিবিদসহ সমাজের প্রতাপশালী ও প্রশাসনিক ক্ষমতাধরদের ওপর বেশি নির্ভর করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, প্রশাসন, রাজনীতিবিদসহ সংশি¬ষ্ট বিভিন্ন পক্ষের নানা ব্যক্তির সমর্থনেরও প্রয়োজন পড়েছে। এ সমর্থনের বিনিময়ে এসব মানুষকে সম্পদ বাড়ানোর পথ প্রশস্ত করে দেয়া হয় নানাভাবে। পাশাপাশি উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হয় নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা। গত সরকারের আমলেও রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত আবাসিক এলাকা ও সরকারি প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন বিচার বিভাগ সংশি¬ষ্ট ব্যক্তি, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, চলচ্চিত্র শিল্পীসহ সরকারঘনিষ্ঠ বিভিন্ন ব্যক্তি।
এদিকে রাজউকের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প পূর্বাচল। মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন চাহিদা মেটাতে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল। যদিও পূর্বাচলের এ জমি সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারাই। প্রথম পর্যায়ের লটারির মাধ্যমে তাদের ১ হাজার ৬৩২টি প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিজীবীদের ৬৫৪, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি কোটায় ৪৭২, বেসরকারি চাকরিজীবীদের ৫৯১, প্রবাসী কোটায় ৫৯১, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২৯৬, সচিব কোটায় ২৪, আইনজীবী কোটায় ১১০, বিচারপতি কোটায় ১৪, সংসদ সদস্য কোটায় ৫৭, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোটায় ৫৭, অন্যান্য কোটায় ১৮১, শিল্পী কোটায় ১৫১ ও সাংবাদিক কোটায় ৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। রাজউক কর্মকর্তা, সংরক্ষিত ও প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যও দেয়া হয় প্লট বরাদ্দ। লটারির পরও বিভিন্ন সময় পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী।
এদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচল নতুন শহরে জমি বরাদ্দ নেয়ার অভিযোগে ১৬ জনকে আসামি করে গত জানুয়ারিতে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পাশাপাশি জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল¬া খন্দকারকেও আসামি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজউকের প্লট বরাদ্দে যত অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো তদন্ত করতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৪ অক্টোবর রুলসহ এ বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। ১২০ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মতো কেরানীগঞ্জে রাজউকের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পেও ‘অনুগত ও তোষামোদকারীদের’ মূল্যবান প্লট দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারি চাকরি, জনসেবা ও সমজাতীয় খাতে জাতীয়ভাবে ‘অসামান্য অবদানের’ নামে ঝিলমিলে দেয়া হয় দুই শতাধিক প্লট।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার বলেন,‘গুলশান-বনানী থেকে শুরু করে পরিকল্পিত যত আবাসিক এলাকা ছিল, সবগুলোয় দেখা যাবে মনঃপুত ব্যক্তিকে প্লট দিয়েছে সরকার। আর সেটি করতে গিয়ে প¬্যানের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক বরাদ্দ শুধু যে স্বৈরাচার সরকারকে টিকিয়ে রাখে কেবল তা নয়, একটি নগরীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। যার ভুক্তভোগী ওই নগরীতে বসবাস করা প্রতিটি নাগরিক। এ ধরনের বরাদ্দের উদাহরণ আগেও ছিল। যারাই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ পেয়েছে তাদের প্লট বাতিল করার পাশাপাশি যারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প¬্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে দামি হলো জমি। সরকার কারো কর্মে খুশি হলে তাকে পদ-পদবিসহ জমিও উপহার দেয়। এজন্য আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে রাজউক ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। গত এক বছরে শেখ হাসিনা সরকারের পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্লট বরাদ্দ বাতিল না হওয়া প্রমাণ করে এ সরকার জুলাই চেতনা ধারণ করে না। এসব অবৈধভাবে দেয়া বরাদ্দ বাতিল করার দাবি ছিল জনগণের। অন্তর্র্বর্তী সরকার এটা বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারেনি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ চলমান। হাইকোর্ট একটি হাইপাওয়ার তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। সেখানে একজন সাবেক সচিব, তার সঙ্গে বাইরের একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং আমাদের একজন সদস্য (প্রশাসন) আছেন। তারা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।