রাশিয়ার পূর্ব উপকূলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সুনামির ঝুঁকি দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই, জাপান, চিলিসহ মোট ১৫টি দেশ ও অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কামচাটকার আশপাশের দ্বীপগুলোয় পাঁচ মিটার (১৬ ফুট) পর্যন্ত সুনামির ঢেউ আঘাত হানে। পানির নিচে তলিয়ে যায় পুরো উপকূল রেখা। বন্দরের ঘাট থেকে ভেসে গেছে অনেক জাহাজ। ভূমিকম্পের তীব্রতায় দ্বীপের ক্লিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছে। গতকাল বুধবার ফ্রান্সের পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের কিছু অংশকে চার মিটার (১৩ ফুট) পর্যন্ত ঢেউয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের কামচাটকা উপদ্বীপে গতকাল আঘাত হানা ভূমিকম্পটি ইতিহাসে রেকর্ডকৃত ষষ্ঠতম শক্তিশালী ছিল। বিশ্বজুড়ে গত এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প দেখা যায়নি। রুশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কামচাটকায় ভূমিকম্পটি ১৯৫২ সালের পর থেকে এ অঞ্চলে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮। তবে প্রথমে রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৮ দশমিক ৭। ভূমিকম্পটি রাশিয়ার পেত্রোপাভলোভস্ক-কামচাতস্কি শহর থেকে প্রায় ৭৮ মাইল বা ১২৬ কিলোমিটার দূরে ১৮ কিলোমিটার গভীরে আঘাত হানে।
কামচাটকার গভর্নর ভ্লাদিমির সোলোদভ একটি ভিডিওতে বলেন, আজকের ভূমিকম্পটি ছিল গুরুতর এবং কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। মনে হচ্ছিল, যে কোনো মুহূর্তে দেয়াল ভেঙে পড়তে পারে। কম্পনটি কমপক্ষে তিন মিনিট টানা স্থায়ী হয়েছিল।
শক্তিশালী ভবন ও সুনামির আগেই মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ায় রাশিয়ায় প্রাণহানি হয়নি বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন। তবে প্রত্যন্ত ও কম জনবহুল দূর-পূর্ব সমুদ্র উপকূলে বিশৃঙ্খলার দৃশ্য ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতির বিক্ষিপ্ত খবর পাওয়া গেছে। কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত এবং বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
পরে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই জাপান, হাওয়াই, রাশিয়ার কিছু অংশ এবং ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলের সুনামি সতর্কতা প্রত্যাহার করা হয়। তবে ফরাসি পলিনেশিয়া কর্তৃপক্ষ প্রত্যন্ত মার্কেসাস দ্বীপপুঞ্জের বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাকে উঁচু ভূমিতে সরে যেতে এবং সরকারি নির্দেশাবলি অনুসরণ করতে সতর্ক করেছে। ভোরের দিকে ঢেউগুলো কিছু দ্বীপে আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গতকালের ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সুনামির ঢেউ রেকর্ড করা হয়েছে কামচাটকার দক্ষিণে উত্তর কুরিল দ্বীপপুঞ্জের সেভেরো-কুরিলস্কে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই ভূমিকম্প একটি মেগাথ্রাস্ট ফল্টে ঘটেছে। এখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঘন প্লেট অপেক্ষাকৃত হালকা উত্তর আমেরিকান প্লেটের নিচে সরে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের অনারারি রিসার্চ ফেলো রজার মাসন বলেছেন, কামচাটকা ভূমিকম্প অঞ্চলটি প্যাসিফিক রিং অব ফায়ারের আশপাশে অন্যতম সক্রিয় সাবডাকশন জোন। এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটটি বছরে প্রায় ৮০ মিমি (৩ ইঞ্চি) গতিতে পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে। একটি প্লেট অন্যটির নিচে চলে গেলে সাবডাকশন ঘটে। এতে শক্তিশালী ভূমিকম্প তৈরি হয়।
ভূমিকম্পের পর কামচাটকা উপদ্বীপের ক্লিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছে। এটি ইউরেশিয়ার সবচেয়ে উঁচু সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হিসেবে পরিচিত। এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ক্লিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে সতর্কতা
ভূমিকম্পের পর জাপানের প্রশান্ত মহাসাগরীয় শহরগুলোয় সুনামি সতর্কতা বাজানো হয়। ২০১১ সালের সুনামিতে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হওয়া জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের সব কর্মীকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক কেন্দ্রে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি।
জাপানি আসাহি টিভি জানিয়েছে, মধ্য জাপানের মিয়ে প্রদেশে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সময় গাড়িসহ পাহাড়ের খাদে পড়ে ৫৮ বছর বয়সী এক নারী মারা গেছেন। এ ছাড়া টোকিও এবং আশপাশ এলাকার লাখ লাখ যাত্রী বাড়ি ফেরার পথে আটকা পড়েন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে রেললাইনও বন্ধ রাখা হয়েছে। দেশটিতে ২০ লাখের বেশি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
হাওয়াইতে ১ দশমিক ৭ মিটার (৫ দশমিক ৫ ফুট) পর্যন্ত ঢেউ রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে জাপানে সবচেয়ে বড় ঢেউ রেকর্ড করা হয়েছে ১ দশমিক ৩ মিটার। গতকাল সন্ধ্যার পর বেশির ভাগ এলাকায় সুনামি সতর্কতা নামিয়ে আনা হয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় সুনামি সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, হাওয়াইতে আর বড় ধরনের সুনামির আশঙ্কা নেই। পরিবহন বিভাগ জানিয়েছে, সন্ধ্যায় হনলুলু বিমানবন্দর থেকে বিমান চলাচল পুনরায় শুরু হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রায় আধা মিটার উঁচু ঢেউ লক্ষ্য করা গেছে। ছোট ঢেউ কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে আঘাত হেনেছে।
এমআর/সবা


























