১০:৪৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘যানজটের দুঃখ’ নিত্যসঙ্গী ঢাকাবাসীর!

  • চালকদের কোনো আগ্রহ নেই নিয়ম মানার
  • প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে
  • পরিবহন খাতে নেই উল্লেখযোগ্য সংস্কার
  • ঢাকার রাস্তায় চলা গণপরিবহনেরই নেই বৈধ ফিটনেস সনদ

গণপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী যানবাহন হচ্ছে বাস সার্ভিস। কিন্তু ঢাকা শহরে এই সার্ভিসের কোনো ধরনের অগ্রাধিকার বা পরিকল্পনা নেই-ড. আদিল মুহাম্মদ খান, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ

রাজধানীতে যানজট এক নির্মম বাস্তবতা। এতে আটকা পড়ে প্রতিদিন রাস্তায় অপচয় হয় অসংখ্য কর্মঘণ্টা। এতে সাধারণের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। উন্নতির বদলে দিনের পর দিন পরিস্থিতির অবনতিই হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈজ্ঞানিক উপায় উপেক্ষা করে গণপরিবহন কমিয়ে পরিকল্পনাহীনভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এ অবস্থায় রাস্তায় ধারণক্ষমতার বেশি গাড়ি চলছে। ফলে যানজট নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
‘দি ফিউচার প্ল্যানিং আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটে শুধু রাজধানীতে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজটের কারণে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এ গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। সামান্য দূরত্বের এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যেতেও মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও সময়ের অপচয় এখন অস্বাভাবিক মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। হাঁটার গতি আর যন্ত্রচালিত যানবাহনের গতি এখন প্রায় কাছাকাছি।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা। সকাল ৯টার দিকেই দাঁড়িয়ে আছে শত শত গাড়ি। বাতাসে ধোঁয়া, বাসের হর্ন আর মানুষের বিরক্ত মুখ- সব মিলে এক অস্থির দৃশ্য। এমন চিত্র শুধু তেজগাঁও নয়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় নিত্যদিনের বাস্তবতা। যানজট এখন ঢাকার মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই নগরজীবনের যন্ত্রণার পেছনে মূল কারণ শৃঙ্খলার অভাব। ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলার ছিটেফোঁটাও নেই। বাসগুলো যেখানে সেখানে থামছে, স্টপেজ বলে কোনো কিছু কার্যতই নেই। ব্যস্ততম সড়কের মাঝখানে হঠাৎ বাস থেমে যায়, যাত্রী ওঠানামা করে, আর তার পেছনে আটকে যায় অ্যাম্বুলেন্স, স্কুলবাস কিংবা অফিসমুখী গাড়ি। চালকদের কোনো আগ্রহ নেই নিয়ম মানার, এসব বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক কিছুই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিবহন খাতে সংস্কার খুব একটা চোখে পড়েনি। শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহনব্যবস্থায় অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যেখানে-সেখানে বাস থেমে যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে, যা যানজট বাড়ার অন্যতম কারণ। ফিটনেসবিহীন বাসগুলো এখনো রাস্তায় চলাচল করছে, যা যাত্রীদের জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। এছাড়াও, মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে, যা স্পষ্টতই আইনবহির্ভূত হলেও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যাত্রীবাহী বাসগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালকের বেপরোয়া মনোভাবকে উৎসাহ দিচ্ছে, বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। অন্যদিকে, রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা পরিবহনব্যবস্থার দুর্দশাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মিরপুর-১০ নম্বর থেকে কাজীপাড়া পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে অনেক সময় লেগে যায় আধা ঘণ্টা। কারণ, প্রতিটি মোড়ে অন্তত পাঁচ থেকে দশটি বাস দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রী তুলতে। ফুটওভার ব্রিজ ফাঁকা থাকলেও মানুষ নিচ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছে, বাসগুলো সেই সুযোগেই হঠাৎ থেমে যাত্রী নেয়। এমনভাবে প্রতিটি জায়গাই পরিণত হয়েছে অঘোষিত বাসস্টপে। মহাখালীর ডিওএইচএস এ থাকেন শামীমা আক্তার। কাজ করেন পল্টনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যেই বাসে উঠতে হয় তাকে, অফিস শুরু হয় নয়টায়। তিনি বলেন, ‘রাস্তার যা অবস্থা, সময় ধরে কিছু বলা যায় না। কখন যে বাস দাঁড়িয়ে যাবে, কেউ জানে না। কখনো আধাঘণ্টার পথ দেড় ঘণ্টায়ও পার হওয়া যায় না। অনেক দিন এমন হয়েছে, সময়মতো বের হয়েও অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। মাথার ভেতর তখন টেনশন কাজ করে। তাই প্রতিদিন দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে বের হই।’ এইক রুটে চলাচলকারী শরিফ বলেন, ‘ফুটওভার ব্রিজ আছে, তাও মানুষ নিচ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছে। মাঝখানে বাস থেমে যাত্রী তোলে, পেছনে অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে। আমি নিজে দেখেছি, রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে, আর বাসচালক চালাচ্ছেন নিজেদের নিয়মে। এ শহরে চলার কোনো শৃঙ্খলা নেই। যানজট এখন শুধু সময় নষ্ট নয়, এটা একটা মানসিক চাপ। রোজ ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি, যেন অফিস না, যুদ্ধ করে এসেছি।
শুধু বাস থামানোর বিশৃঙ্খলাই নয়, ঢাকার রাস্তায় চলা বহু গণপরিবহনেরই নেই বৈধ ফিটনেস সনদ। বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, অন্তত ২০ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলছে ফিটনেসবিহীনভাবে। এই গাড়িগুলোর একাংশ এত পুরনো যে, চলার সময় কাঁপে, হঠাৎ ব্রেক ফেল করে। রাজধানীর মিরপুর থেকে গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী একটি বাসের চালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমরা বেতন পাই না, দিনে যাত্রী যত তুলব, ইনকাম তত। রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী না তুললে মালিক বলে লস করছি। সব দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপায়, কিন্তু যাত্রীও রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি না থামলে পেছনের বাস থামে। ফিটনেস সনদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা মালিকের দায়িত্ব। গাড়ি বন্ধ থাকলে আমাদের রোজগারও বন্ধ। শৃঙ্খলা দরকার, কিন্তু আগে আমাদের সিস্টেমটা ঠিক করা লাগবে। রাজধানী ছাড়িয়ে যানজটের ছায়া পড়েছে শহরতলীর দিকেও। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ বা সাভার থেকে ঢাকায় প্রবেশের মুখে প্রধান সড়কগুলোতে দেখা যায় ব্যাটারিচালিত রিকশা। আইন অনুযায়ী এই যানগুলো মহাসড়কে চলতে পারার কথা নয়। আরেক বড় সমস্যা বাসগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। একই রুটে চলা একাধিক কোম্পানির বাস যাত্রী তুলতে গিয়ে রাস্তার মাঝেই শুরু করে রেষারেষি। অনেক সময় যাত্রী তোলার লড়াই প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সড়কে নেমে এসেছিল হাজারো শিক্ষার্থী। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। চালকেরা আজও কমিশনভিত্তিক বেতন পায় না, যাত্রী যত বেশি তুলবে, আয় তত বেশি। ফলে রাস্তায় তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত লড়াই চলে কে আগে যাবে, কে বেশি যাত্রী তুলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেস ছাড়া গাড়ি চলতে দেওয়া মানেই শহরের প্রতিটি মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। অথচ এই ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন লাখো মানুষ চলাফেরা করছে রাজধানীতে। এসব সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সুস্পষ্ট নীতি, কার্যকর নজরদারি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। নইলে রাজধানীর গণপরিবহনব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দেশের সরকার পতন হয়, প্রশাসন পতন হয়, মন্ত্রী বদল হয়, সচিব বদল হয় কিন্তু এ বাসগুলোর চিত্র বদল হয় না, তাদের কাহিনি বদল হয় না। অনতিবিলম্বে দেশকে পরিবর্তন করতে হলে এ বাসগুলোর চেহারা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের যে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থাগুলো আছে, সেগুলোর চরম ব্যর্থতা লক্ষ্য করছি। আমাদের যে রাষ্ট্রীয় পরিবহন ব্যবস্থাগুলোতে অনিয়ম, দুর্নীতি, পরিচালনার অযোগ্যতা, অদক্ষতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—এই সব কারণে আমরা যে বিষয়টি লক্ষ্য করি, তা হলো এই জটিলতাগুলোর কারণেই পরিবহনগুলো পাল্টানো যাচ্ছে না।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আসলে গণপরিবহনের মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে সাশ্রয়ী যানবাহন হচ্ছে বাস সার্ভিস। সবখানে বাস সার্ভিসের অগ্রাধিকার থাকে। কিন্তু ঢাকা শহরে কোনো ধরনের অগ্রাধিকার বা পরিকল্পনা নেই। এখন কথা বলতে হচ্ছে, সেই শহর নিয়ে যেখানে মেট্রো রেলের মতো একটি সার্ভিস চালু করা সম্ভব হয়েছে, সেখানে সড়কের বাসগুলো সঠিক স্থানে নামে কি না, যাত্রী ছাউনিতে থামে কি না বা তার পুরো ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। শুধু এই কারণে যে, বিগত সরকারগুলো কোনো সরকারই আসলে সহজভাবে যেই সার্ভিসটাকে ডেভেলপমেন্ট করা যেত, সেটা নিয়ে কাজ করেনি। অথচ তারা চাইলেই মেট্রোর মতো বড় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়া যেত, বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া যেত।’

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

‘যানজটের দুঃখ’ নিত্যসঙ্গী ঢাকাবাসীর!

আপডেট সময় : ০৭:১১:১৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫
  • চালকদের কোনো আগ্রহ নেই নিয়ম মানার
  • প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে
  • পরিবহন খাতে নেই উল্লেখযোগ্য সংস্কার
  • ঢাকার রাস্তায় চলা গণপরিবহনেরই নেই বৈধ ফিটনেস সনদ

গণপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী যানবাহন হচ্ছে বাস সার্ভিস। কিন্তু ঢাকা শহরে এই সার্ভিসের কোনো ধরনের অগ্রাধিকার বা পরিকল্পনা নেই-ড. আদিল মুহাম্মদ খান, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ

রাজধানীতে যানজট এক নির্মম বাস্তবতা। এতে আটকা পড়ে প্রতিদিন রাস্তায় অপচয় হয় অসংখ্য কর্মঘণ্টা। এতে সাধারণের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। উন্নতির বদলে দিনের পর দিন পরিস্থিতির অবনতিই হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈজ্ঞানিক উপায় উপেক্ষা করে গণপরিবহন কমিয়ে পরিকল্পনাহীনভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এ অবস্থায় রাস্তায় ধারণক্ষমতার বেশি গাড়ি চলছে। ফলে যানজট নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
‘দি ফিউচার প্ল্যানিং আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটে শুধু রাজধানীতে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজটের কারণে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এ গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। সামান্য দূরত্বের এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যেতেও মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও সময়ের অপচয় এখন অস্বাভাবিক মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। হাঁটার গতি আর যন্ত্রচালিত যানবাহনের গতি এখন প্রায় কাছাকাছি।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা। সকাল ৯টার দিকেই দাঁড়িয়ে আছে শত শত গাড়ি। বাতাসে ধোঁয়া, বাসের হর্ন আর মানুষের বিরক্ত মুখ- সব মিলে এক অস্থির দৃশ্য। এমন চিত্র শুধু তেজগাঁও নয়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় নিত্যদিনের বাস্তবতা। যানজট এখন ঢাকার মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই নগরজীবনের যন্ত্রণার পেছনে মূল কারণ শৃঙ্খলার অভাব। ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলার ছিটেফোঁটাও নেই। বাসগুলো যেখানে সেখানে থামছে, স্টপেজ বলে কোনো কিছু কার্যতই নেই। ব্যস্ততম সড়কের মাঝখানে হঠাৎ বাস থেমে যায়, যাত্রী ওঠানামা করে, আর তার পেছনে আটকে যায় অ্যাম্বুলেন্স, স্কুলবাস কিংবা অফিসমুখী গাড়ি। চালকদের কোনো আগ্রহ নেই নিয়ম মানার, এসব বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক কিছুই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিবহন খাতে সংস্কার খুব একটা চোখে পড়েনি। শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহনব্যবস্থায় অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যেখানে-সেখানে বাস থেমে যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে, যা যানজট বাড়ার অন্যতম কারণ। ফিটনেসবিহীন বাসগুলো এখনো রাস্তায় চলাচল করছে, যা যাত্রীদের জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। এছাড়াও, মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে, যা স্পষ্টতই আইনবহির্ভূত হলেও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যাত্রীবাহী বাসগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালকের বেপরোয়া মনোভাবকে উৎসাহ দিচ্ছে, বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। অন্যদিকে, রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা পরিবহনব্যবস্থার দুর্দশাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মিরপুর-১০ নম্বর থেকে কাজীপাড়া পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে অনেক সময় লেগে যায় আধা ঘণ্টা। কারণ, প্রতিটি মোড়ে অন্তত পাঁচ থেকে দশটি বাস দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রী তুলতে। ফুটওভার ব্রিজ ফাঁকা থাকলেও মানুষ নিচ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছে, বাসগুলো সেই সুযোগেই হঠাৎ থেমে যাত্রী নেয়। এমনভাবে প্রতিটি জায়গাই পরিণত হয়েছে অঘোষিত বাসস্টপে। মহাখালীর ডিওএইচএস এ থাকেন শামীমা আক্তার। কাজ করেন পল্টনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যেই বাসে উঠতে হয় তাকে, অফিস শুরু হয় নয়টায়। তিনি বলেন, ‘রাস্তার যা অবস্থা, সময় ধরে কিছু বলা যায় না। কখন যে বাস দাঁড়িয়ে যাবে, কেউ জানে না। কখনো আধাঘণ্টার পথ দেড় ঘণ্টায়ও পার হওয়া যায় না। অনেক দিন এমন হয়েছে, সময়মতো বের হয়েও অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। মাথার ভেতর তখন টেনশন কাজ করে। তাই প্রতিদিন দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে বের হই।’ এইক রুটে চলাচলকারী শরিফ বলেন, ‘ফুটওভার ব্রিজ আছে, তাও মানুষ নিচ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছে। মাঝখানে বাস থেমে যাত্রী তোলে, পেছনে অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে। আমি নিজে দেখেছি, রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে, আর বাসচালক চালাচ্ছেন নিজেদের নিয়মে। এ শহরে চলার কোনো শৃঙ্খলা নেই। যানজট এখন শুধু সময় নষ্ট নয়, এটা একটা মানসিক চাপ। রোজ ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি, যেন অফিস না, যুদ্ধ করে এসেছি।
শুধু বাস থামানোর বিশৃঙ্খলাই নয়, ঢাকার রাস্তায় চলা বহু গণপরিবহনেরই নেই বৈধ ফিটনেস সনদ। বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, অন্তত ২০ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলছে ফিটনেসবিহীনভাবে। এই গাড়িগুলোর একাংশ এত পুরনো যে, চলার সময় কাঁপে, হঠাৎ ব্রেক ফেল করে। রাজধানীর মিরপুর থেকে গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী একটি বাসের চালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমরা বেতন পাই না, দিনে যাত্রী যত তুলব, ইনকাম তত। রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী না তুললে মালিক বলে লস করছি। সব দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপায়, কিন্তু যাত্রীও রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি না থামলে পেছনের বাস থামে। ফিটনেস সনদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা মালিকের দায়িত্ব। গাড়ি বন্ধ থাকলে আমাদের রোজগারও বন্ধ। শৃঙ্খলা দরকার, কিন্তু আগে আমাদের সিস্টেমটা ঠিক করা লাগবে। রাজধানী ছাড়িয়ে যানজটের ছায়া পড়েছে শহরতলীর দিকেও। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ বা সাভার থেকে ঢাকায় প্রবেশের মুখে প্রধান সড়কগুলোতে দেখা যায় ব্যাটারিচালিত রিকশা। আইন অনুযায়ী এই যানগুলো মহাসড়কে চলতে পারার কথা নয়। আরেক বড় সমস্যা বাসগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। একই রুটে চলা একাধিক কোম্পানির বাস যাত্রী তুলতে গিয়ে রাস্তার মাঝেই শুরু করে রেষারেষি। অনেক সময় যাত্রী তোলার লড়াই প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সড়কে নেমে এসেছিল হাজারো শিক্ষার্থী। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। চালকেরা আজও কমিশনভিত্তিক বেতন পায় না, যাত্রী যত বেশি তুলবে, আয় তত বেশি। ফলে রাস্তায় তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত লড়াই চলে কে আগে যাবে, কে বেশি যাত্রী তুলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেস ছাড়া গাড়ি চলতে দেওয়া মানেই শহরের প্রতিটি মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। অথচ এই ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন লাখো মানুষ চলাফেরা করছে রাজধানীতে। এসব সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সুস্পষ্ট নীতি, কার্যকর নজরদারি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। নইলে রাজধানীর গণপরিবহনব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দেশের সরকার পতন হয়, প্রশাসন পতন হয়, মন্ত্রী বদল হয়, সচিব বদল হয় কিন্তু এ বাসগুলোর চিত্র বদল হয় না, তাদের কাহিনি বদল হয় না। অনতিবিলম্বে দেশকে পরিবর্তন করতে হলে এ বাসগুলোর চেহারা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের যে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থাগুলো আছে, সেগুলোর চরম ব্যর্থতা লক্ষ্য করছি। আমাদের যে রাষ্ট্রীয় পরিবহন ব্যবস্থাগুলোতে অনিয়ম, দুর্নীতি, পরিচালনার অযোগ্যতা, অদক্ষতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—এই সব কারণে আমরা যে বিষয়টি লক্ষ্য করি, তা হলো এই জটিলতাগুলোর কারণেই পরিবহনগুলো পাল্টানো যাচ্ছে না।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আসলে গণপরিবহনের মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে সাশ্রয়ী যানবাহন হচ্ছে বাস সার্ভিস। সবখানে বাস সার্ভিসের অগ্রাধিকার থাকে। কিন্তু ঢাকা শহরে কোনো ধরনের অগ্রাধিকার বা পরিকল্পনা নেই। এখন কথা বলতে হচ্ছে, সেই শহর নিয়ে যেখানে মেট্রো রেলের মতো একটি সার্ভিস চালু করা সম্ভব হয়েছে, সেখানে সড়কের বাসগুলো সঠিক স্থানে নামে কি না, যাত্রী ছাউনিতে থামে কি না বা তার পুরো ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। শুধু এই কারণে যে, বিগত সরকারগুলো কোনো সরকারই আসলে সহজভাবে যেই সার্ভিসটাকে ডেভেলপমেন্ট করা যেত, সেটা নিয়ে কাজ করেনি। অথচ তারা চাইলেই মেট্রোর মতো বড় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়া যেত, বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া যেত।’