আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান
বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার সড়কের পাহাড়ী দুর্গম এলাকা গ্রাম মেওয়া পাড়া। এটি সদর উপজেলার ১নং রাজবিলা ইউনিয়নের ৯নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত । আঁকাবাকা পাহাড়ের পথ পেরিয়ে হেটে যেতে হয় প্রায় কয়েক ঘন্টা। পাড়ায় ঘরের চারপাশে বেড়া দিয় বিভিন্ন গাছগাছালির লাগিয়ে বনের পরিবেশ তৈরী করে অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি করেছেন মুরগীর খামার। সেখানে বনমোরগ ও মুরগি’র খামার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন হ্লাশৈ অং মারমা (৪০) ও শৈমেচিং (৩৬) মারমা নামে এক দম্পতি।
দম্পতি সাথে কথা বলে জানা গেছে, ৫ বছর আগে গহীন পাহাড়ে জুম কাটতে যাওয়ার সময় ৬-৭টি ডিমসহ একটি বন মুরগির বাসা দেখতে পেয়েছিলেন । সেখান থেকে তিনটি ডিম নিয়ে এসে ঘরে দেশী মুরগী মায়ের বাসায় রেখে দেন। ৩টি ডিম থেকে ১টি ডিম পচে নষ্ট যায়। বাকি দুটো ডিম থেকে একটি মোরগ- মুরগী বাচ্চা ফুটে। সি বাচ্চাগুলো পরিবেশ সাথে মানিয়ে নিতেবনা পেরে মরার অবস্থায় হয়ে পড়ে। কোন উপায় না পেয়ে ধানের শক্ত দানা ও জঙ্গলে পিঁপড়ে ডিমসহ হরেক রকম পোকা-মাকড় খাওয়ানো পর বাচ্চাগুলো সুস্থ হয়ে উঠে। প্রতিদিন বাচ্চা গুলোকে ঘাসের ফড়িং, পোকা মাকড়, আর ধানের দানা খাওয়ানো শুরু করেন। এরপর শুরু করেন মুরগী খামার। গত পাঁচ বছরে প্রায় দেড়শোর মত বন মুরগি লালন পালন করে পালটে দিয়েছে এই দম্পতি জীবন। ভবিষ্যতে দেশি মুরগির মতো চাহিদা মিটাতে বন মুরগির বানিজ্যিক উপায়ে বড় আকারে খামার বানিয়ে চাষ করার স্বপ্ন দেখছেন এই দম্পতি।
জানা গেছে, বনের মুরগিকে মারমা ভাষায় বলা হয় ” তহ্ক্রাক” অর্থাৎ বনমোরগ। মুলত বনের মধ্যে জন্ম ও বনের বসবাস করে থাকেন এই বনপ্রানীরা। তাদের খাবার মূলত পছন্দ পোকামাকড়, ধানের দানা। বনের মোরগের গঠন, আকার-আকৃতি, ডাক সবই এক এবং অভিন্ন। তাছাড়া মানুষের আওয়াজ শোনার মাত্র উড়াল দিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু সেই বনপ্রানীকে পোষ মানিয়ে শুরু করেছেন খামার।
পাড়াবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দম্পতির দুইজনই লেখাপড়া জানেন নাহ। শুধু নিজের ভাষা ছাড়া বাংলা ভাষায়ও বলতে পারেন নাহ। দম্পতির কৃষিকাজ করে চলে সংসার। বনের প্রাণীকে ঘরে এনে পোষ মানিয়ে পালন করছেন এই দম্পতির। তাদের বনমোরগ খামার দেখে অবাক এলাকাবাসী। তাদের এক অভিনব কায়দা দেখে এলাকার সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে এই দম্পতির নাম। উৎসাহ জেগেছে অনেকেই।

হ্লাশৈ অং মারমা ও তার সহধর্মিণী শৈমেচিং দম্পতি সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। জানান, বন মুরগী ওজন দেশি মুরগীর মতো নয়। এদের সাইজ দেশী মুরগীর তুলনায় ছোট, ওজনও কম । পরিপক্ক মোরগের ওজন সর্বোচ্চ ৭০০-৮০০গ্রাম হয়। আর মুরগীর ওজন হয় ৬০০-৭০০গ্রাম। তবে মা মুরগীর ক্ষেত্রে ডিম থাকলে ওজন একটু বেশী হয়ে থাকে। তাছাড়া ছোট বাচ্চা, মাঝারি ও বড় মিলে প্রায় ৫৫টি মুরগীর জন্য প্রতিদিন ৬ কেজির মত ধানের প্রয়োজন হয়। চাহিদা বাড়াতে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার দেওয়া রয়েছে। আর বিক্রি করে বেশ ভালো দামও পাওয়া যায়।
বান্দরবান বন বিভাগের বন্যপ্রাণী বিষয়ক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর জানান, কোন ব্যক্তি বন্য প্রাণীকে ধরে নিয়ে এসে বাড়িতে রাখলে বন্য প্রাণী নিধন আইনে অপরাধী হবেন। যে বন্য মুরগির কথা বলা হয়েছে সেটির ক্ষেত্রে মুরগিগুলো একপ্রকার গৃহপালিত বলা যেতে পারে। আমার মতে সে নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছে। তাছড়া তাদের উদ্যোগ খুবই প্রসংসানীয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে বাড়ি আঙ্গিনায় খামারে ২২টি মুরগী পরিপক্ক (ডিম দেওয়া সম্ভাব্য), ১৩টি পরিপক্ক মোরগ, ২টি শিকারী মোরগ, ১৭টি বাচ্চাসহ তিনটি মা, ৯টি ডিমসহ মা আছে একটি। পরিপক্ক মোরগ বিক্রয় করেন আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। মুরগী এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা করে বিক্রি করেন। এবছরে ৮টি মুরগী ও ৫টি মোরগ বিক্রি করেছেন। তাছাড়া খামারের ছোট বাচ্চা, মাঝারি ও বড় মিলে প্রায় ৫৫টি মুরগীর রয়েছে।
এব্যাপারে জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. পলাশ কান্তি চাকমা জানান, দেশী মুরগীর মতো বন মোরগেরও রোগ বালাই কম হয়। মাঝে মধ্যে রানিক্ষেত, কলেরা, ফক্স এই রোগগুলো হয়ে থাকে। তবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে এই রোগ থেকেও প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। খামারি যদি প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ে এসে যোগাযোগ করলে চিকিৎসা ও পরিচর্চার ক্ষেত্রে পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।


























