মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে অসংখ্য মসজিদ গড়ে তুলেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মসজিদ। সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস ও ভালোবাসার আলোকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা একেক অঞ্চলে একেক রকম মসজিদ নির্মাণ করে থাকেন।
সাধারণত নামাজ শেষে মসজিদগুলোর দরজা-জানালা তালা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। পশু-পাখি বা কোনো অবুঝ ব্যক্তি যেন ধর্মীয় গ্রন্থের কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন না করতে পারে—এজন্যই এমন ব্যবস্থা করেন সংশ্লিষ্ট মসজিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তবে এদিক থেকে ব্যতিক্রম নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী জামে মসজিদ। কেননা এ মসজিদে নেই কোনো দরজা-জানালা। নামাজ পড়ার জন্য ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে মসজিদটি। যা মসজিদটিকে আলাদা করেছে অন্য সব মসজিদ থেকে। ১৯টি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট মসজিদটিকে কেউ কেউ ‘খোলা মসজিদ’ বা ‘দরজা-জানালাহীন’ মসজিদ বলে। তবে মসজিদটির প্রকৃত নাম ‘আদমজী জামে মসজিদ’।

সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী জেনেভা ক্যাম্পের পাশেই মসজিদটির অবস্থান। মসজিদটির নির্মাণকাজ সাদামাটা হলেও ভেতরে সব সময় শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। যা মুসুল্লি ও পথিকদের জন্য অনেকটা স্বস্তিদায়ক। ৭৩ বছরের পুরোনো এই মসজিদের রয়েছে অজানা ইতিহাস। ১৯৪৫ সালে আদমজী জুট মিল স্থাপনের সময় তৎকালীন ধনাঢ্য বাইশ পরিবারের একজন ছিলেন ‘গুল মোহাম্মদ’। মুসল্লিরা যেন ৫ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি অন্যান্য নফল নামাজও আদায় করতে পারেন, তাই আদমজী জুট মিলের শ্রমিক-কর্মকর্তাদের জন্য মিলের অভ্যন্তরে ১৯৫২ সালে নির্মাণ করা হয় এই সুদর্শন মসজিদটি। প্রায় দুই একর জায়গার ওপর অবস্থিত নামাজের মূল স্থান, পুকুর ও মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসিক স্থান।
৯০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৬৫ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট ১২টি সুদর্শন থামের ওপর স্থাপিত এই মসজিদটি। পশ্চিম দিক ছাড়া বাকি তিন দিকেই রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬০ ফুট প্রস্থ তিন পাশের বারান্দার ছাদটি মোট ৪৮টি পিলারের ওপর নির্মিত। মসজিদটির উপরিভাগে রয়েছে ছোট ছোট আটটি গম্বুজ ও একটি বড় গম্বুজ। রয়েছে সুন্দর একটি মিনারও। পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে আজান দেয়ার জন্য আলাদা একটি মিনার। যেখানে এক সময় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকায় খালি গলায় মুয়াজ্জিন আজান দিতেন। বর্তমানে এ মসজিদে একসঙ্গে আড়াই হাজারেরও অধিক মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের মুসুল্লিরা জানান, আদমজী জুট মিলের একমাত্র স্মৃতি এই মসজিদ। তাদের শঙ্কা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদ সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে হয়তো বিলীন হয়ে যাবে কোনো একসময়।
২০০২ সালের ৩০ জুন আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আদমজী উম্মুল ক্বোরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হাকিম মো. জয়নুল আবেদীন কয়েকজন মুসুল্লিকে নিয়ে মসজিদের হাল ধরেন এবং বিভিন্নজনের সহযোগিতায় মসজিদের উন্নয়নকাজ চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে তিনি মসজিদটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
জয়নুল আবেদীন সবুজ বাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, আদমজী জুট মিলের নিজস্ব ২৯৭ একর জায়গায় আদমজী জুট মিলের পাশাপাশি এই মসজিদসহ প্রায় ১৩টি মসজিদ ছিল। মিল বন্ধের পর এটি ছাড়া সব মসজিদ বন্ধ হয়ে যায়। এই মসজিদটিও ভেঙে ফেলার টেন্ডার হয়। কিন্তু আমরা বিহারি (অবাঙালি) কলোনির মুসলমানদের জন্য এই মসজিদ রক্ষা করি। তবে সে সময় মসজিদের ফ্যান-লাইট, মাইক, সাউন্ডবক্স খুলে নিয়ে যায় মিল কর্তৃপক্ষ। সেই থেকে সরকারি কোনো অনুদান না পেয়ে প্রতিদিন মাগরিবের নামাজ ও জুম্মার নামাজের পর উত্তোলিত অর্থের টাকায় চলছে এ মসজিদ।
তিনি আরও বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা থাকাকালীন মসজিদের ছাদ নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান পেয়েছিলেন। এরপর আর কোনো অনুদান পাওয়া যায়নি মসজিদের সংস্কার বা উন্নয়নের জন্য। তবে মসজিদের পুকুরের তিন দিকে বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণসহ মসজিদের যাবতীয় কাজের জন্য এখন অর্থের প্রয়োজন।

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. বিল্লাল হোসেন রবিন বলেন, ১৯৫১ সালে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিলস প্রতিষ্ঠাকালীন আদমজী কর্তৃপক্ষ মিল অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করেন। তার একটি হলো এই আদমজী জামে মসজিদ। ২০০২ সালের ৩০ জুন মিল বন্ধের পর চরম সংকটে পড়ে মসজিদটি। কারণ ওই সময় মসজিদের সব ফ্যান খুলে নেয়া হয়, কেটে দেয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। এক ভুতুড়ে ঘরে পরিণত হয় মসজিদটি। মসজিদের সংকটময় সময়ে সভাপতি হাকিম জয়নুল আবেদীন ও বর্তমান ইমাম হাফেজ সোলাইমান ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। যে মসজিদে শত শত মুসুল্লি কাতারবন্দি হয়ে নামাজ আদায় করতেন সেই মসজিদে অন্ধকারে মোমের আলোয় হাতে গোনা কয়েকজন মুসুল্লি নামাজ পড়তেন। সংকটময় ওই সময়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী, কিছু ব্যক্তিবর্গ ও মুসুল্লিদের আর্থিক সহায়তায় ধীরে ধীরে মসজিদটি ঘুরে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, এলাকার মুসুল্লি ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে ভালোবাসার টানে অনেক মুসুল্লি এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। বিশেষ করে জুমা, শবেবরাত, শবেকদর ও ঈদের নামাজ পড়তে আসেন শতাধিক মুসুল্লি।
মসজিদের বড় ধরনের নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই উল্লেখ করে বিল্লাল হোসেন রবিন আরও বলেন, ইমাম-মোয়াজ্জেম এবং খাদেমদের নিয়মিত বেতন-বোনাস পরিশোধের পাশাপাশি বছর জুড়ে মসজিদের ছোটখাটো উন্নয়ন চলমান থাকে। বর্তমানেও মসজিদের কিছু উন্নয়নমূলক কাজ চলমান রয়েছে। মসজিদের একমাত্র পুকুরটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় বাউন্ডারি দেয়ালটি পুনর্নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাউন্ডারি দেয়াল না থাকায় অনেকে পুকুরে ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এতে পুকুরের পানি নোংরা হয়ে যাওয়ায় ওজু করতে পারছেন না মুসল্লিরা। সরকারিভাবে অনুদান পেলে পুকুরের বাউন্ডারি দেয়ালসহ অন্যান্য উন্নয়নগুলো সম্পন্ন করা সহজ হবে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসে ঐতিহ্যবাহী খোলা মসজিদ দেখতে এবং নামাজ আদায় করতে।
আদমজী এলাকার বাসিন্দা ও এই মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি হাজি কামাল হোসেন বলেন, ‘মসজিদটি আদমজী জুট মিল কর্তৃপক্ষ তৎকালে এভাবেই তৈরি করেছেন। জানালা, দরজা, কপাট না থাকায় আলো-বাতাস পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। এতে মুসল্লিরা ইবাদত করে তৃপ্তি পান।’
আলী হোসেন নামের আরেকজন মুসল্লি জানান, মসজিদ ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে দরজা-জানালাহীন খোলা অবস্থায় থাকলেও কখনো চুরির ঘটনা ঘটেনি। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এখানে নামাজ আদায় করছেন।
অনেক দিন ধরে এ মসজিদে খাদেমের দায়িত্ব পালন করছেন বরকতুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘মসজিদটিতে দরজা না থাকায় সহজেই ধুলাবালি ময়লা ঢুকে যায়। তাই সব সময় এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখি।’
প্রায় দুই যুগ ধরে মসজিদটির ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ সোলাইমান। তিনি সবুজ বাংলার প্রতিবেদককে জানান, প্রতি শুক্রবারের জুমা ছাড়াও দুই ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর ও ঈদে মিলাদুন্নবীর সময় মুসল্লিদের ব্যাপক ভিড় হয়। অনেক সময় সবাইকে জায়গা দেয়া যায় না। আর নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট আয় না থাকলেও মুসল্লিদের দানের টাকায় মসজিদটি পরিচালিত হয়।
তিনি জানান, অনেক মসজিদের পাশে দোকান থাকে। সেখান থেকে নির্দিষ্ট একটা অর্থ আসে। তবে আদমজী জামে মসজিদের নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। মসজিদের কয়েকটা ফল গাছ আছে ও মসজিদের পুকুরে মাছ আছে। এগুলো বিক্রি করে কিছু অর্থ আসে। আর প্রতি জুমায় মুসল্লিরা দান করেন। এগুলো দিয়েই মসজিদের খরচ বহন করা হয়।
কথা হয় আদমজী জামে মসজিদ কমিটির সদস্য জসিমউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন এ মসজিদের হাল ধরি তখন এমনও সময় গেছে আমরাই মসজিদ ঝাড়ু দিয়েছি। তবে এখন সবার সহযোগিতায় মসজিদটি আধুনিকায়ন হয়েছে। এখানে ইমাম-মুয়াজ্জিন ছাড়াও দু’জন খাদেম রয়েছে।’
পরিশেষে মসজিদ কমিটির সভাপতি হাকিম জয়নাল আবেদিন বলেন, সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা না থাকায় মুসল্লিদের অনুদানেই তাঁরা মসজিদটি পরিচালনা করে আসছেন। সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা থাকা অবস্থায় ছাদ করার জন্য সামান্য কিছু অনুদান ছাড়া আর কখনো কোনো সরকারি অনুদান মেলেনি। বিশেষ দিনগুলোতে মসজিদটি কানায় কানায় ভরে যায়। তখন মুসল্লিদের নামাজ আদায় করতে কষ্ট হয়। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা পেলে মসজিদটি আরো ভালোভাবে পরিচালনা করা যাবে।
ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নারায়ণগঞ্জ শাখার উপপরিচালক মুহাম্মদ জামাল হোসাইন বলেন, মসজিদ উন্নয়নের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন কোনো অনুদান দেয় না। মসজিদের সব আর্থিক অনুদান ধর্ম মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাজ হচ্ছে যেসব মসজিদে অনুদান দরকার, সেসব মসজিদের অনুদানের তালিকা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে দেয়া। ধর্ম মন্ত্রণালয় তখন এসব তালিকা বিবেচনা করে একটি প্রজেক্ট পাশ করে অনুদান দিয়ে থাকে।
এসএস/সবা


























